Advertisement
E-Paper

‘ভুল’ চিকিৎসা, স্যালাইন দিতে গিয়ে হাত বাদ তরুণীর

গ্যাসট্রাইটিসের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। এ ক্ষেত্রে শতকরা ৯৯ জন রোগীকে যা করা হয়, তাই করা হয়েছিল। স্যালাইন দেওয়া হয়েছিল তাঁর বাঁ হাতে। কিন্তু ন’দিন পরে যখন বাড়ি এলেন, তখন সেই বাঁ হাত কেটে বাদ দিতে হয়েছে! মাত্র ক’দিনের ব্যবধানে সুস্থ, উচ্ছল তেইশ বছরের তরুণী হয়ে গিয়েছেন ‘শারীরিক প্রতিবন্ধী’।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৫ ০১:৪৫
পারমিতা চৌধুরী

পারমিতা চৌধুরী

গ্যাসট্রাইটিসের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। এ ক্ষেত্রে শতকরা ৯৯ জন রোগীকে যা করা হয়, তাই করা হয়েছিল। স্যালাইন দেওয়া হয়েছিল তাঁর বাঁ হাতে। কিন্তু ন’দিন পরে যখন বাড়ি এলেন, তখন সেই বাঁ হাত কেটে বাদ দিতে হয়েছে! মাত্র ক’দিনের ব্যবধানে সুস্থ, উচ্ছল তেইশ বছরের তরুণী হয়ে গিয়েছেন ‘শারীরিক প্রতিবন্ধী’।

জুন থেকে চিকিৎসকেরা তাঁকে বাড়ির বাইরে বেরোনোর অনুমতি দেন। শরীর-মনের বিপর্যয় নিয়েও সেই থেকে থানা, স্বাস্থ্য দফতর, রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল দৌড়ে বেড়াচ্ছেন গরফা স্কুল লেনের বাসিন্দা পারমিতা চৌধুরী। একটাই প্রশ্ন, কেন সামান্য স্যালাইন দিতে গিয়ে হাতে গ্যাংগ্রিন হবে? সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ এনে তিনি জানতে চেয়েছেন, কেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে না? অভিযোগে পারমিতা লিখেছেন, ‘তবে কি এ বার থেকে স্যালাইন চললেই প্রস্তুত থাকতে হবে, হাত বাদ যেতে পারে?’

একমাত্র সন্তানের এই পরিস্থিতিতে কার্যত দিশেহারা সমীরকুমার চৌধুরী ও তনু চৌধুরী। তনুদেবী বলেন, ‘‘সামান্য স্যালাইন দিয়ে মেয়েটার হাত চলে গেল। ওকে বাঁচাতে ৮ লক্ষ টাকার উপরে খরচ হয়েছে। ওর ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দিলেন ডাক্তারেরা। কী করে চাকরি হবে? কী করে বিয়ে দেব?’’

পারমিতার মনের জোর এখনও অটুট। বললেন, ‘‘ভূগোলে এমএ পড়ছিলাম। অনেক প্র্যাক্টিক্যাল করতে হয়। এক হাতে অসম্ভব। আমি ‘রিমোট সেন্সিং ম্যাপিং’ নিয়ে ডিপ্লোমা করেছিলাম। তা-ও করতে পারব না।’’

পারমিতা জানান, গ্যাসট্রাইটিসের যন্ত্রণা নিয়ে ১৬ জানুয়ারি তিনি শরৎ বসু রোডের এক বেসরকারি হাসপাতালে সার্জন অশোককুমার শরাফের অধীনে ভর্তি হন। বিকেল থেকে তাঁর বাঁ হাতে স্যালাইন চালু হয়। অভিযোগ, ১৭ জানুয়ারি স্যালাইন খোলার পরে হাত কালো হয়ে ফুলতে থাকে। যন্ত্রণা শুরু হলে নার্সরা আইসপ্যাক দেন। ১৮ তারিখ তিনি বাড়ি এলে কালো হওয়া আর যন্ত্রণা এত বাড়ে যে, রাতে ফের তাঁকে ওই হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যান বাড়ির লোকেরা। তাঁদের অভিযোগ, পারমিতাকে ভর্তি না করে ব্যথার ইঞ্জেকশন দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। ১৯ জানুয়ারি দুপুরে ফের তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অভিযোগ, চিকিৎসক অশোক শরাফ আসেন বিকেল সাড়ে তিনটেয়। রোগীকে দেখে তিনি ‘ফ্যাসিওটোমি’ (কালো হয়ে যাওয়া জায়গাগুলি কেটে রক্ত বার করে দেওয়া) করেন।

পারমিতার পরিজনদের অভিযোগ, ২০ জানুয়ারি তাঁর বাঁ হাতের কব্জির তলা থেকে ফের কালো হতে থাকে। ফের ‘ফ্যাসিওটোমি’ করেও লাভ হয়নি। পরদিন চিকিৎসকেরা জানান, তাদের পরবর্তী চিকিৎসার পরিকাঠামো নেই। বাবা-মা মেয়েকে নিয়ে যান মুকুন্দপুরে এক বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসকেরা জানান, হাতে গ্যাংগ্রিন শুরু হয়েছে। হাত বাঁচানোর বহু চেষ্টার পরে ২৫ তারিখ বাঁ হাত কনুইয়ের তলা থেকে বাদ দিতে হয়। দু’দিন ভেন্টিলেশনে ছিলেন পারমিতা। মে মাস পর্যন্ত বাড়িতে শয্যাশায়ী ছিলেন।

কেন স্যালাইন দিতে গিয়ে হাতে গ্যাংগ্রিন হবে? অভিযুক্ত চিকিৎসক অশোকবাবু বলেন, ‘‘মেয়েটির ‘ভাস্কুলাইটিস’ ছিল। এটা আগে থেকে বোঝা যায় না।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘যা যা করণীয়, করা হয়েছে। দু’বার ফ্যাসিওটোমি হয়েছে। এর পরেও দুর্ভাগ্যবশত কিছু রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসায় সাড়া মেলে না। এ ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।’’ তবে কি অনেকেরই স্যালাইন দিতে গিয়ে এমন হতে পারে? অশোকবাবুর উত্তর, ‘‘কিছু ক্ষেত্রে হতে পারে বৈকি।’’ অন্য হাসপাতালে রেফার করা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘নিশ্চিত ভাবে ভাস্কুলাইটিস কি না ও শিরায় রক্তপ্রবাহ কোথায়, কতটা আটকাচ্ছে জানতে ডপলার টেস্ট দরকার। আমাদের সেই মেশিন ছিল না বলেই এই সিদ্ধান্ত।’’

প্রশ্ন হল, যখন দ্বিতীয় দিনই দেখা গেল পারমিতার হাত কালো হয়ে যাচ্ছে, তখনই কেন অন্যত্র পাঠিয়ে ডপলার করানো হল না? উত্তর দেননি অশোকবাবু। তবে ওই হাসপাতালের তরফে সম্পাদক স্বামী সত্যদেবানন্দ জানান, তাঁদের হাসপাতালে ডপলার মেশিন থাকলেও ২৪ ঘণ্টা চলে না।

ভাস্কুলার সার্জন কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতে, এমন অবস্থাকে ‘কম্পার্টমেন্ট সিনড্রোম’ বলে। এতে স্যালাইন শিরার পাশাপাশি মাংসপেশীতে পৌঁছে রক্ত সঞ্চালনে বাধা দেয়। তখন ডপলার স্টাডি ও ফ্যাসিওটোমি করা হয়। কিন্তু কখন এগুলি করতে হবে, সেই সময়ের হিসেব খুব গুরুত্বপূর্ণ। আবার কার্ডিওভাস্কুলার সার্জন কুণাল সরকার জানান, হাত কালো হওয়া বাড়তে থাকলে তৎক্ষণাৎ ডপলার করিয়ে সহযোগী চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক সময়েই তৎপরতা দেখানোর ক্ষেত্রে হাসপাতালগুলির তরফে ত্রুটি থাকে, এটা দুর্ভাগ্যজনক।

parijat bandyopadhyay lost hand gangrene wrong treatment medical negligence paromita choudhuri student handicapped vasculitis hand gangrene student lost hand abpnewsletters
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy