Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

থ্যালাসেমিয়া রোগে দরকার একটু সচেতনতার

জন্ম থেকেই এই রোগে আক্রান্ত হয় শিশু। সারা জীবন চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়। কিন্তু বাবা-মা বিয়ের আগে রক্তপরীক্ষা করালে এই রোগ আটকানো সম্ভব। পরামর্শ দিলেন চিকিৎসক সঞ্জীব সামন্তথ্যালাসেমিয়া একটি গ্রিক শব্দ। থ্যালাসা কথার অর্থ সমুদ্র। আনেমিয়া কথার অর্থ রক্তাপ্লতা। কথিত আছে, গ্রিসের কোনও এক সমুদ্রের ধারে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে।

রোগী দেখছেন চিকিৎসক। ছবি: উদিত সিংহ

রোগী দেখছেন চিকিৎসক। ছবি: উদিত সিংহ

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:০০
Share: Save:

প্রশ্ন: থ্যালাসেমিয়া রোগটি আসলে কী?

উত্তর: থ্যালাসেমিয়া একটি গ্রিক শব্দ। থ্যালাসা কথার অর্থ সমুদ্র। আনেমিয়া কথার অর্থ রক্তাপ্লতা। কথিত আছে, গ্রিসের কোনও এক সমুদ্রের ধারে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। ১৯২৫ সালে আমেরিকার টমাস কুলি ও পারোল লি এই রোগটি চিহ্নিত করেন। এটি রক্তের বংশগত অসুখ। প্রধানত জিনগত সমস্যা থেকেই এই রোগ হয়। বংশানুক্রমিক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগ হলে রক্ত স্বাভাবিক ভাবে তৈরি হয় না। হিমোগ্লোবিনে ত্রুটি থেকে যায়। লোহিত রক্ত কণিকার আয়তন ছোট হয়। তাই রোগাক্রান্তকে অন্য রক্তদাতার রক্ত গ্রহণ করতে হয়।

প্রশ্ন: থ্যালাসেমিয়া রোগটি কেন হয়?

উত্তর: কোনও বাহ্যিক কারণ নেই। বাবা-মায়ের কাছ থেকেই সন্তানের শরীরে এই রোগ আসতে পারে। অর্থাৎ বাহকের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রশ্ন: এই রোগ ছোঁয়াচে বলে ধারণা রয়েছে। এটি কি ঠিক?

উত্তর: না, একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা। রোগটি কোনও ভাবেই ছোঁয়াচে, এমনকি, সংক্রামকও নয়। এক জন থ্যালাসেমিয়া রোগীর দেহের রক্ত যদি অন্যের শরীরে দেওয়া হয় তা হলেও ওই ব্যক্তির থ্যালাসেমিয়া হবে না। থ্যালাসেমিয়া রোগীর সঙ্গে যৌন সংসর্গেও এই রোগ ছ়়ড়াবে না।

প্রশ্ন: এই রোগটি কত রকম হয়?

উত্তর: থ্যালাসেমিয়া রোগটি প্রধানত দুই প্রকার— মেজর ও মাইনর। মাইনর থ্যালাসেমিয়া বলা হয় তাঁদের, যাঁরা এই রোগের বাহক। মেজর থ্যালাসেমিয়া হয় সদ্যজাতদের। অর্থাৎ যারা এই রোগের শিকার হয়ে জন্ম নিচ্ছে তারা।

প্রশ্ন: কী ভাবে বোঝা সম্ভব যে কেউ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন?

উত্তর: মাইনর থ্যালাসেমিয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যায় না। পরীক্ষা করলে তবেই বোঝা যায় ওই ব্যক্তি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। এই মাইনর থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তদের কোনও সমস্যা হয় না। কোনও কারণে পরীক্ষা না করালে তাঁরা জানতেও পারেন না যে তাঁরা থ্যালাসেমিয়ার বাহক। অন্য দিকে, মেজর থ্যালাসেমিয়া শিশু জন্ম নেওয়ার প্রথম ছ’মাসের মধ্যেই ধরা যায়। কারণ, এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করে। শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, খাওয়া-দাওয়া কম হওয়া, জ্বর, সর্দি, ফ্যাকাসে ভাব থেকে শুরু করে স্বাভাবিক বৃদ্ধি হার কমে যাওয়ার মতো নানা সমস্যা দেখা যায়। তাই মনে রাখতে হবে এই সব সমস্যা থাকলে শিশুদের মেজর থ্যালাসেমিয়া হতেও পারে। তবে নির্দিষ্ট পরীক্ষার পরেই নিশ্চিত হওয়া যায় শিশুটি মেজর থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে কি না।

প্রশ্ন: কোন পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব?

উত্তর: এই রোগ নির্ণয়ের জন্য এইচপিএলসি পরীক্ষার করা দরকার। পরীক্ষাটির পুরো নাম হল ‘হাই পাওয়ার লিকুইড ক্রোমাটোগ্রাফি’।

প্রশ্ন: থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ার পরে চিকিৎসার ব্যবস্থা কী আছে?

উত্তর: এই রোগের চিকিৎসা সে ভাবে কিছু নেই। অন্তত মাইনর থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে এই রোগের কোনও চিকিৎসাই নেই। বলা ভাল মাইনর থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের ক্ষেত্রে কোনও চিকিৎসার প্রয়োজনই নেই। অন্য দিকে, মেজর থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসা বলতে রক্ত গ্রহণ করা।

প্রশ্ন: থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের কত দিন অন্তর রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন?

উত্তর: বিষয়টি চিকিৎসকের উপরে নির্ভরশীল। তবে এই ক্ষেত্রে তিনটি ভাগ রয়েছে। শিশুর জন্মের প্রথম ছ’মাসের মধ্যে অর্থাৎ মেজর থ্যালাসেমিয়ার জন্য সুপার ট্রান্সফিউশন প্রোগ্রাম নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে রক্তে হিমোগ্লোবিন ১২ গ্রামের কমে নামতে দেওয়া হয় না। এই চিকিৎসার ফলে এক জন রোগী ৩০ বছর পর্যন্ত ভাল থাকতে পারেন। অন্য দিকে, পূর্ণবয়স্কদের জন্য প্রয়োগ করা হয় হাইপার ট্রান্সফিউশন। এখানে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ রক্তে ১০ থেকে ১২ গ্রামের মধ্যে রাখা হয়। আর একটি পদ্ধতি হচ্ছে সেফ লেভেল। এই লেভেল বা স্তর হল রক্তে ৭-৯ গ্রাম হিমোগ্লোবিন। সপ্তাহে এক দিন করে রোগীকে হিমোগ্লোবিনের লেভেল বা স্তর ধরে রাখতে রক্ত দিতে হয়।

প্রশ্ন: এই রক্ত নিলেই কি রোগী সুস্থ থাকতে পারবেন? না, আরও কিছু করতে হবে?

উত্তর: রক্ত নেওয়ার পরে অনেক রকম সমস্যা হতে পারে। সেই সমস্যাগুলির জন্য চিকিৎসকদের তরফে কয়েকটি বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যেমন, বার বার রক্ত নেওয়ার ফলে শরীরে আয়রন জমে যায়। শরীর থেকে অতিরিক্ত আয়রন বের করার জন্য ওষুধ দিতে হয়। এই ওষুধের নামটি ডেফেরোঅক্সামিন (Deferoxamine)। ঠিকঠাক রক্ত সঞ্চালনের জন্য এই সময়ে ভিটামিন-ডির প্রয়োজন হয়। একই ভাবে নিওসাইড ইনফিউশন প্রয়োগ করা হয়। এই চিকিৎসার ফলে দু’বার রক্ত নেওয়ার মধ্যের সময় ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়।

প্রশ্ন: আধুনিক চিকিৎসা হিসেবে এ ক্ষেত্রে অস্থিমজ্জার প্রতিস্থানে কি সুফল মিলতে পারে?

উত্তর: অস্থিমজ্জার প্রতিস্থাপন একটি আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি। এটি বেশ ব্যয়বহুল এবং একই সঙ্গে যন্ত্রণাদায়কও বটে। এই ক্ষেত্রে অস্থিমজ্জা অন্যের শরীর থেকে নিয়ে এসে রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। কিন্তু এই বিষয়ে একটি কথা বলে রাখা ভাল, এই চিকিৎসা করিয়েও খুব আশাব্যঞ্জক ফলাফল এখনও সে ভাবে পাওয়া যায়নি।

প্রশ্ন: চিকিৎসার দিক তো গেল। কী ভাবে এই রোগ থেকে বাঁচা যাবে সেই বিষয়ে যদি পরামর্শ দেন?

উত্তর: পরামর্শ একটাই। সচেতনতা। কয়েকটি কথা আপ্তবাক্যের মত খেয়াল রাখতে হবে।

১) বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে যান যে আপনি থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না।

২) এক জন থ্যালাসেমিয়ার বাহক যেন আর এক জন বাহককে বিয়ে না করেন।

৩) বিয়ের পরে যদি দেখা যায় স্বামী অথবা স্ত্রীর মধ্যে এক জন এই রোগের বাহক তা হলে অবশ্যই অন্য জন রক্তপরীক্ষা করান।

৪) যদি দেখা যায়, স্বামী ও স্ত্রী দু’জনেই থ্যালাসেমিয়ার বাহক তা হলে গর্ভাবস্থায় ৮ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে ভ্রূণের পরীক্ষা করান।

৫) যদি কোন পরিবারের এক জন থ্যালাসেমিয়া বাহক হন তা হলে পরিবারের সকলেই রক্তপরীক্ষা করান।

প্রশ্ন: গর্ভাবস্থায় ৮ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে ভ্রূণের পরীক্ষা করানোর পরে যদি দেখা যায়, সেই ভ্রূণ এই রোগে আক্রান্ত, তা হলে কী করতে হবে?

উত্তর: শুনতে খারাপ লাগলেও আমরা এক্ষেত্রে ভ্রূণ নষ্টের কথাই পিতামাতাকে বলি। কারণ, তা না হলে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত একটি শিশু পৃথিবীতে আসবে এবং জন্ম থেকেই এই সমস্যা নিয়েই আমৃত্যু লড়াই করবে।

প্রশ্ন: আপনি তো অনেক দিন এই রোগের চিকিৎসা করছেন। বর্ধমানে এই রোগের প্রকোপ কেমন?

উত্তর: বর্ধমানের বেশ কয়েক জন এই রোগে আক্রান্ত মানুষ রয়েছেন। তবে একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এই রোগ নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনার অভাব রয়েছে। এই রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা নিয়ে মানুষ এখনও সে ভাবে সজাগ নয়।

প্রশ্ন: এই রোগের চিকিৎসা কোথায় কোথায় মিলতে পারে?

উত্তর: সব মেডিক্যাল কলেজে থ্যালাসেমিয়া ইউনিট রয়েছে। এ ছাড়াও জেলা হাসপাতালেও এই ইউনিট রয়েছে। মেডিক্যাল কলেজে পরীক্ষা করা যায় থ্যালাসেমিয়া রয়েছে কি না। হাসপাতালগুলিতে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য বর্হিবিভাগ এবং রক্ত সঞ্চালন কেন্দ্র বা ডে-কেয়ার ব্যবস্থা আছে।

প্রশ্ন: সরকার এই রোগ নিয়ন্ত্রণে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে?

উত্তর: সম্প্রতি সরকারি নির্দেশ সব বিবাহযোগ্য ছেলেমেয়ের বিনামূল্যে এই রোগের পরীক্ষা করা হয়। স্কুল ও কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত ভাবে বিনামূল্যে এই রোগের নির্ণয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়াও গর্ভবতী মা ও থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীর পরিবারের সদস্যদের বিনামূল্যে এই রোগের পরীক্ষা করে দেওয়া হয়। সরকারি স্তরে এই সব সুযোগ সুবিধা মেলে। তবে বেসরকারি ভাবে এই রোগের চিকিৎসা খরচ বছরে প্রায় ২ লক্ষ টাকার মতো।

সাক্ষাৎকার: সুপ্রকাশ চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

thalassemia Health Awareness
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE