E-Paper

দাম চার হাজার পার, আমাকে ঝোলা বোলো না

বস্তুত ‘ঝোলা অর্থনীতি’ শব্দবন্ধটি বহুল পরিচিত হয়ে ওঠে দুই দিকপাল অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বনাম জগদীশ ভগবতীর বিতর্কের সূত্র ধরে।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০২৫ ০৭:০০
অনলাইনে মিলছে এমন ঝোলা।

অনলাইনে মিলছে এমন ঝোলা। নিজস্ব চিত্র।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ‘‘হম তো ফকির আদমি হ্যায়, ঝোলা লেকে চল পড়েঙ্গে!’’ ফকিরি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে তাঁর মুখে উঠে এসেছিল ঝোলার কথা। মোদীর ‘বন্ধু’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশে এখন আর সে কথাটি বলার জো নেই। ঝোলা সেখানে এখন মহার্ঘ বস্তু, ভারতীয় সংস্কৃতির অভিজ্ঞান। আমেরিকার শৌখিন বিপণি নর্ডস্ট্রোমের ওয়েবসাইটে জাপানি ব্র্যান্ডের হাত ঘুরে ঝোলার নামকরণ হয়েছে, ‘ইন্ডিয়ান স্যুভেনির ব্যাগ’। দাম, ৪৮ ডলার! মানে ভারতীয় মুদ্রায় চার হাজার টাকারও বেশি।

৪৮ ডলার খরচা করে এই ঝোলা যাঁরা কিনছেন, তাঁরা কি ‘ঝোলা অর্থনীতি’তে বিশ্বাসী? ৪৮ ডলার দাম ধার্য করে এই ঝোলা যাঁরা বেচছেন, তাঁরা কি জানেন গেরুয়া ভারতে আজকাল উদারবাদীদের ‘ঝোলা’ বলে ডেকে কটাক্ষ করা হয়? দু’টো উত্তরই ‘না’ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ ইয়াঙ্কি ওয়েবসাইটের চোখে ঝোলা বড় উচ্চমার্গীয়, ঝোলা মানে ‘এক টুকরো ভারত’। ভারতীয় সংস্কৃতিকে ভালবাসেন? ভারতের মতো সুন্দর একটা দেশকে ভালবাসেন? ঝোলা নিয়ে যান! প্রায় এই ভাষাতেই ঝোলাওয়ালার সংখ্যা বৃদ্ধি করার আহ্বান জানানো হয়েছে সেখানে। দেখে-শুনে মনে পড়ে যেতেই পারে অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ়-এর একটি বিখ্যাত বইয়ের নাম— সেন্স অ্যান্ড সলিডারিটি: ঝোলাওয়ালা ইকনমিক্স ফর এভরিওয়ান!

বস্তুত ‘ঝোলা অর্থনীতি’ শব্দবন্ধটি বহুল পরিচিত হয়ে ওঠে দুই দিকপাল অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বনাম জগদীশ ভগবতীর বিতর্কের সূত্র ধরে। বিশেষ করে ২০১৩ সালে এই নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়। জঁ দ্রেজ় নিজেও দীর্ঘদিন অমর্ত্যের সহযোগী। অর্থনীতির গবেষণায় মাঠেঘাটে ঘুরে তথ্য সংগ্রহের গুরুত্বের কথা তিনি বলেছেন তাঁর বইয়ে। কাঁধে ঝোলাব্যাগ ঝুলিয়ে ঘোরা অর্থনীতিবিদের মানসছবি সেই গবেষণা-পদ্ধতির সঙ্গে ওতপ্রোত। ক্রমে সামাজিক ন্যায়ের উপরে জোর দেওয়া অর্থনীতিবিদদের ঝোলাগোত্রীয় বলাটা রেওয়াজ হয়ে ওঠে। নর্ডস্ট্রোম বিপণিতে যে ঝোলা এখন বিক্রি হচ্ছে, সেটাকে বাঙালিরা অবশ্য থলি বলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন। ছোট হাতলওয়ালা বাজারের থলি। বাঙালির কাছে ঝোলা মানে মূলত কাঁধে নেওয়ার লম্বা ব্যাগ। সে ব্যাগ হতে পারে খাদির, হতে পারে নরম সুতির, এমনকি চট, পশম বা ডেনিমেরও। বিভিন্ন প্রাদেশিক হস্তশিল্প বিপণিতে রকমারি ঝোলাব্যাগএক নয়, বরং বহুবর্ণ ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে।

শত বসন্ত পার করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব ডিন অব স্টুডেন্টস হিমেন্দু বিশ্বাস। কিংবদন্তিসম ‘বিশ্বাসদা’। দীর্ঘ জীবনের কত পর্বেই না ঝোলার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল! ছোটবেলা কেটেছে শ্রীহট্টে। তখন কাঁধে ঝোলা দেখলেই বোঝা যেত, নির্ঘাত রাজনীতির লোক! খাদির ব্যাগ নেওয়া কংগ্রেস কর্মী! চল্লিশের দশকের মধ্যভাগে পড়তে এলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিজের কাঁধেও উঠল কাপড়ের ঝোলা। চাকরিজীবনেও সেটি সঙ্গ ছাড়েনি। বইখাতা, জরুরি কাগজপত্র মায় টিফিনবাক্সটি অবধি সেই ব্যাগে থাকত।

বিজ্ঞানী সুকন্যা সিংহ স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করেছেন শান্তিনিকেতনে। ওঁর বাবা নৃতত্ত্ববিদ সুরজিৎ সিংহ তখন বিশ্বভারতীর উপাচার্য। সুকন্যা বলছিলেন, মধ্য সত্তরের সেই শান্তিনিকেতনে ঝোলাব্যাগই চলত সবচেয়ে বেশি। ঝোলাব্যাগ, সাইকেল আর রোদ থেকে বাঁচতে মাথায় টোকা জাতীয় টুপি— এই নিয়েই শান্তিনিকেতন। ভুবনডাঙায় এত দোকান তখন হয়নি। শ্রীনিকেতনের সমবায় থেকে কেনা হত তাঁতের কাপড়ের ব্যাগ। শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে ছাত্রছাত্রী, সকলেই ব্যবহার করতেন। বাটিক বা কাঁথা কাজের ডিজাইন ব্যাগে তখনও চালু হয়নি। পরে অবশ্য সেগুলো খুবই জনপ্রিয় হয়।

আর্ট কলেজের পড়ুয়ারা আবার অনেকেই বড়বাজার থেকে খাপি টেকসই কাপড় কিনে দর্জি দিয়ে বানিয়ে নিতেন প্রয়োজনীয় ঝোলাটি। আশির দশকে আর্ট কলেজে পড়েছেন ফটোগ্রাফার-তথ্যচিত্রনির্মাতা বিজয় চৌধুরী। বললেন, ‘‘রঙের টিউব, তুলির গোছা, জলের মগ, রঙ গোলার জন্য চিনেমাটির প্যালেট, এমনকি ফোল্ডিং টুল অবধি ভরে নেওয়া যেত সেই ব্যাগে। আউটডোরে যেতে হলে তার মধ্যেই ঢুকে যেত জামাকাপড়, গামছা। ওই ব্যাগ ছাড়া আমরা চলতেই পারতাম না।’’

তুলনামূলক ভাবে সস্তা, হালকা ঝোলাব্যাগ দশকের পর দশক ধরে এ ভাবেই একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের চিহ্ন হয়ে থেকেছে— সাহিত্য, রাজনীতি, সারস্বত চর্চা, নাট্যচর্চার আবশ্যিক সঙ্গী হয়ে এসেছে। ঠাকুরমার ঝুলি আর দাদামশাইয়ের থলেকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠেছে শৈশব। ফকিরি ঝোলা, কাবুলিওয়ালার ঝোলা, ডাকপিওনের ঝোলার পাশাপাশি তার এক ছোট সাইজের সংস্করণ কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বইপাড়া, নাটকের গ্রিনরুম থেকে রাজপথের মিছিলে কাঁধে কাঁধে ঘুরেছে। ‘অপুর সংসার’-এর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কিংবা ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’র ঋত্বিক ঘটক— ঝোলাব্যাগ ছাড়া ভাবা যায় না কাউকেই। মান্না দে-র গাওয়া কফিহাউসের গানে অমলের অবধারিত বর্ণনা— কবি কবি চেহারা, কাঁধেতে ঝোলানো ব্যাগ!

আমেরিকার বিপণির অবশ্যই এত ভাবার সুযোগ নেই। বাজার অর্থনীতি নিশ্চিন্তে বাজারের থলিতে ভারতকে পুরে ডলার কামিয়ে নিচ্ছে। ঝোলাওয়ালারা এত দিন স্বদেশে গঞ্জনার মুখে পড়লে বলার চেষ্টা করতেন, ‘হতে পারি দীন তবু নহি মোরা হীন!’ এখন ঝোলা সাহেবি নামঠিকানা পেল। এ বার বুক বাজিয়ে বলা যাবে, আমাকে ঝোলা বোলো না!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Narendra Modi america

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy