Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Adolescent

আড়ালও জরুরি

প্রাক্-বয়ঃসন্ধিতে শরীরের পরিবর্তন নিয়ে হঠাৎ সমস্যায় পড়ে ছোটরা। ওদের প্রয়োজন অভিভাবকের সংবেদনশীলতা, আর একটু আড়ালও।

চিরশ্রী মজুমদার 
শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২১ ০৮:১৩
Share: Save:

গরম পড়ে যাওয়ার পরেও জামার উপরে জ্যাকেট পরে থাকত রায়না। অস্বস্তিতে ওর মা। ওর ওয়ার্ড্রোবের অন্তর্বাস অংশে নতুন সংযোজনের সময়টা এসে পড়েছে ভীষণ তাড়াতাড়ি।

পিপিংয়ের জামাকাপড় থেকে ঘামের গন্ধ যায়ই না। এ নিয়ে কথা উঠলে চোখ সরিয়ে গোমড়া হয়ে যায় ছেলে।

এগারো-বারোর ছেলেমেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি ছুটে চলে টিন-এজের দিকে। ওদের শরীরে প্রাক্-বয়ঃসন্ধির পরিবর্তন দেখা দেয়। অঙ্গের সৌষ্ঠব বদলায়, রোম মোটা হয়ে যায়, কণ্ঠস্বর বদলায়। আয়নায় নিজেদের দেখে অবাক হয়, লজ্জাও পায়। আবার কো-এড স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গেও ওকে মিলেমিশে থাকতে হবে। বাড়িতে ভাই-বোনের মাঝেও একটু যেন আড়াল এসে পড়ে এ সময়ে। তাই সেক্স এডুেকশনের সমান্তরালেই ওদের নতুন শরীরকে মেনে নেওয়াও শিখে নিতে হবে। নিজের এবং অপরের শরীরকে সম্মান করা, আচরণে সংযম ও আব্রুর গুরুত্বও শিখতে হবে। তার জন্যও অভিভাবকের সংবেদনশীল সাহচর্য জরুরি।

তুমিও বড়দেরই মতো

শরীরে পরিবর্তন ফুটে ওঠার পরে সচেতন হওয়ার চেয়ে, আগেই প্রস্তুতি নিলে অভিভাবক ও সন্তান উভয়ের ক্ষেত্রেই বিষয়টি অনেক সহজ হবে। বাচ্চাদের হঠাৎ ‘বড়’ হয়ে যাওয়ার সময়টা কিন্তু এগিয়ে এসেছে। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বললেন, ‘‘বয়স দুই সংখ্যার ঘরের দিকে গেলেই সজাগ হবেন। সাধারণত দশ বছর হলেই প্রি-টিন এজে প্রবেশ করে শিশুরা। ১০ থেকে ১২-ই প্রাক্-বয়ঃসন্ধি।’’

আস্তে আস্তে ওর ব্যক্তিগত পরিসর, নিভৃতি, আড়ালের প্রয়োজন হবে। ওকে সেই সুযোগ দিন এবং সহজ ভাবে বড়দের জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিন। পায়েলের পরামর্শ, গল্পের ছলে, অ্যালবাম দেখিয়ে ওকে শরীরের পরিবর্তনগুলিকে চিনিয়ে দিন। অঙ্গসৌষ্ঠবে শ্রী ধরে রাখতে অন্তর্বাসের প্রয়োজনীয়তার কথা বলুন। বিভিন্ন অন্তর্বাসের ছবি, বিজ্ঞাপন দেখিয়ে ওর সঙ্গেই বসে একটি পছন্দ করুন। দোকানে নিয়ে গিয়ে ওর মাপ নিয়ে, ফিটিংস অনুযায়ী অন্তর্বাস বাছতে সাহায্য করুন। এতে আলাদা ধরনের জীবনযাপনের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। অন্যের সামনে নিজেকে মেলে ধরার ক্ষেত্রে শোভন-অশোভনের বোধ, পোশাকের বাছবিচার তৈরি হবে। মা-বাবা এই আড় ভাঙার, বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়ে এগিয়ে চলার কাজে সাহায্য করতে পারেন। গলা ভাঙলে বাচ্চা ছেলেরা অস্বস্তিতে পড়ে। বোঝান, গলা ভাঙা খুব স্বাভাবিক। এতে ওরই ব্যক্তিত্ব আকর্ষক হয়ে উঠবে।

শরীরে রোম বাড়লে, রোম মোটা হতে শুরু করলে পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে বেশি যত্নবান হতে হবে। এসেনশিয়াল অয়েল দিয়ে স্নান করার আরাম, বডি-পার্ট ওয়াশের সাহায্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিষ্কার থাকার রীতি বুঝিয়ে দিন। এ সব কথা বকুনি দিয়ে বললে হবে না। গল্পের মাধ্যমে আস্তে আস্তে সুঅভ্যেস গড়ে তুলুন। সুগন্ধী, হ্যান্ডমেড সাবান উপহার দিতে পারেন।

এ সময়ে ওরা সাজগোজ করাও শুরু করে। তবে মুখের অবাঞ্ছিত রোম তাতে বাদ সাধে বা হরমোনজনিত কারণে অনেকের ওজনও বেড়ে যায়। সে ক্ষেত্রে সন্তানের পাশে বন্ধুর মতো দাঁড়ান, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

এখন বয়সে ছোট শিশুকেই গুড টাচ, ব্যাড টাচের পার্থক্য বুঝিয়ে দেওয়া হয়। অচেনা অজ্ঞাত পুরুষের সঙ্গে দূরত্ব রাখাও শেখাতে হবে। যে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ‘হাগিং’, ‘টাচিং’ সম্পর্ক আছে, সেখানেও রাশ টানতে হবে। ছোটবেলায় সকলের কোলে ওঠা বা জড়িয়ে ধরার প্রবণতা থাকে। বাড়িতে নিজের বা তুতো দাদা, ভাই থাকলে তাদের সামনে যাওয়ার আগেও যে একটা প্রস্তুতি দরকার এ বার, সেটা বোঝাতে হবে। ‘কো-স্লিপিং’ থেকে বেরিয়ে এলে এই অভ্যেসগুলিও বদলাবে। সপ্তাহে এক দিন করে আলাদা শোয়ার ব্যবস্থা করুন। এতে ওর নিজের জগৎ তৈরি হবে। দরজা বন্ধ করে পোশাক বদল করতে শুরু করুক এ বার। আলাদা আলমারি, পারলে আলাদা ঘরের কথাও ভাবুন। ছেলে হোক বা মেয়ে, যে কোনও সময়েই ওর ঘরে ঢোকার আগে দরজায় নক করুন। এতে ও প্রিভেসি সম্পর্কে সচেতন হবে। ওর ব্যক্তিগত পরিসরে কেউ বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করলে সতর্ক হবে। ভাই-বোন একসঙ্গে বড় হলেও এই অভ্যেস গড়ে তুলুন। দিদির ঘরে ঢুকতে গেলে ভাইকে বা ভাইয়ের ঘরে ঢুকতে গেলে দিদিকেও যে অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হবে, তা শেখান। একই ভাবে ছেলে-মেয়ে উভয়ের প্রতিই যেন সম্মান প্রদর্শন করে, সেই শিক্ষাও দিতে হবে। নিজের সন্তানকেও শেখাতে হবে যেন সে কারও ব্যক্তিগত পরিসরে বিনা অনুমতিতে ঢুকে না পড়ে। সে যদি তার বন্ধুও হয়, সে ক্ষেত্রেও তার অনুমতি দরকার। এতে বাইরের জগতেও ওর আচরণে আপনাকে লজ্জিত হতে হবে না।

আড়াল মানে গোপনীয়তা নয়

বড়দের মতো সুযোগ-সুবিধে, নিজের সময়, ‘স্পেস’ দেওয়ার মানে এই নয় যে, ওকে যথেচ্ছাচারের সুযোগ দেওয়া হবে। সন্তানের বিষয়ে অভিভাবক মাথা ঘামাবেন না, তা নয়। আট-ন’বছরের পর থেকেই বাচ্চাদের সঙ্গে আরও বেশি সংযোগ বজায় রেখে চলুন। দরকারে সম্পর্ক সহজ করুন। আস্তে আস্তে বড়দের সম্পর্ক, আবেগ নিয়ে বুঝিয়ে বলা শুরু করুন। ওর নিভৃত সময় থাকুক, কিন্তু কিছু লুকোচ্ছে কি না খেয়াল করুন।

পায়েলের মতে, ‘‘নিজস্ব পরিসর দেওয়ার আগে, সন্তানকে সময় নিয়ে বোঝাতে হবে। ওকে বোঝাবেন, নিজের মতো থাকতে পারো, কিন্তু তোমার উপরে নজর থাকবে। বাচ্চাদের উপরে এই নজর রাখার কাজটা অজান্তেই করা ভাল। কার সঙ্গে বেশি চ্যাট করছে, কোথায় ক্লিক করছে তার ধারণা রাখা খুব সহজ। এই বয়সে ওদের বিশেষ আকর্ষণ স্লিপওভার। কার বাড়িতে স্লিপওভারের পরিকল্পনা হচ্ছে, কে কে থাকবে, সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা রাখুন। প্রত্যেকের অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন।’’

ও এ বার বড় হবে। নতুন অনেক কিছু করবে, আবার পুরনো কিছু অভ্যেস ভুলে যেতে হবে। নিভৃত সময়, একটু একটু স্বাধীনতা পাবে। বদলে ওকে কিন্তু অভিভাবকের বিশ্বাসেরও মর্যাদাও ধরে রাখতে হবে। এই বোঝাপড়াটা যেন ছেলে বা মেয়ের মাথায় সব সময়ে থাকে। মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে, তাঁদের শেখানো মূল্যবোধ ওদের কাজে প্রতিভাত হবে বইকি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Adolescent
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE