Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

যন্ত্র বিকল ফেকোর মাঝে, আধকাটা চোখে সাত ঘণ্টা

ছানি কাটার জন্য ফেকো সার্জারি শুরু হয়েছে। বাড়ির লোক এটা ভেবেই অনেকটা নিশ্চিন্ত যে, নামী হাসপাতালে অনেক টাকা দিয়ে অস্ত্রোপচার হচ্ছে, ফলে ডায়ালিসিসের রোগী হলেও কোনও সমস্যা হবে না।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৩১
Share: Save:

ছানি কাটার জন্য ফেকো সার্জারি শুরু হয়েছে। বাড়ির লোক এটা ভেবেই অনেকটা নিশ্চিন্ত যে, নামী হাসপাতালে অনেক টাকা দিয়ে অস্ত্রোপচার হচ্ছে, ফলে ডায়ালিসিসের রোগী হলেও কোনও সমস্যা হবে না।

কিন্তু বৃথা নির্ভরতা, বৃথা বিশ্বাস। অভিযোগ উঠেছে, চৌষট্টি বছরের সেই রোগীকেই অর্ধেক কাটা চোখ নিয়ে সাত ঘণ্টা যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে অপেক্ষা করতে হয়েছে। কারণ, সেই নামী হাসপাতালেই অস্ত্রোপচারের মাঝে ফেকো সার্জারি মেশিন বিকল হয়ে পড়েছিল। বিকল্প যন্ত্রও ছিল না। এ দিকে, ঘণ্টা দু’য়েকের মধ্যেই তাঁর চোখে লোকাল বা টপিক্যাল অ্যানেস্থেশিয়ার প্রভাব কেটে প্রবল যন্ত্রণা। যন্ত্র সারিয়ে অস্ত্রোপচার করতে আট ঘণ্টা পার। কিন্তু জুনে অস্ত্রোপচারের পরে এখনও সেই চোখে ভাল দেখতে পাচ্ছেন না রোগী।

ক্ষুব্ধ ওই রোগীর পরিবার গত সপ্তাহে মুকুন্দপুরের ‘ভিশন কেয়ার হাসপাতাল’ এবং চিকিৎসকের বিরুদ্ধে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল ও ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। তাঁদের অভিযোগ, ৩০ হাজার টাকা নিয়ে নামী হাসপাতাল ফেকো সার্জারির আগে কেন বিকল্প মেশিন মজুত রাখবে না? তা হলে তাদের উন্নততর পরিষেবা দেওয়ার দাবির যথার্থতা কোথায়? যদি তারা ফেকোর বিকল্প যন্ত্র মজুত না রাখে, তবে অবশিষ্ট মেশিনের অবস্থা হাসপাতালের ইঞ্জিনিয়ারেরা কেন অস্ত্রোপচারের আগে পরীক্ষা করবেন না?

উত্তরপাড়ার বাসিন্দা ওই রোগী অমল প্রামাণিকের কথায়, ‘‘দিনটা ভুলব না। অস্ত্রোপচার শুরুর পরে সবে ছ’-সাত মিনিট কেটেছে। বাঁ চোখ অর্ধেক কাটা হয়েছে, তখন অস্ত্রোপচার আটকে গেল! বলা হল, দু’ঘণ্টায় যন্ত্র সারানো হবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছিল। চোখের পাতা ক্লিপজাতীয় কিছু দিয়ে টেনে খোলা। ক্রমশ চোখে সাড় ফিরছিল। যন্ত্রণায় ছটফট করছিলাম। ডাক্তারবাবু চোখে জল স্প্রে করতে করতে বলছিলেন, ‘একটু সহ্য করতে হবে। আবার অপারেশন শুরুর আগে ছাড়া অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া যাবে না!’’

অমলবাবুর ছেলে শঙ্খশুভ্র প্রামাণিক বলেন, ‘‘আমরা অসহায়, দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। অপারেশন শুরুর আট মিনিট পরে ডাক্তারবাবু বেরিয়ে বললেন, যন্ত্র খারাপ হয়েছে। হয় অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, নয়তো তা সারানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বাবার চোখ কাটা শুরু হয়ে গিয়েছিল। তখন কোথায় নিয়ে যাব? ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে যাচ্ছিল। চোখের সামনে বাবা ছটফট করছিলেন।’’ তাঁদের আরও অভিযোগ, অপেক্ষার সময়ে ব্লাড সুগারের রোগী অমলবাবুর চোখ প্যাড দিয়ে আটকানো হয়নি। সাত ঘণ্টা খালি পেটে অপেক্ষা করতে গিয়ে রোগী আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।

বিস্মিত অন্য চক্ষু বিশেষজ্ঞেরা। চিকিৎসক হিমাদ্রি দত্ত বলেন, ‘‘চিকিৎসক যতক্ষণে বুঝতে পারেন যে যন্ত্র কাজ করছে না, ততক্ষণে অস্ত্রোপচার অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার কথা। ওই অবস্থায় সাত ঘণ্টা অপেক্ষার কথা ভাবা যায় না। সামান্য কাঁকড় ঢুকলেই চোখে কী অবস্থা হয়, সবাই জানেন।’’

চক্ষু চিকিৎসক শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, ‘‘বিকল্প মেশিন জরুরি। তা না থাকলে ও যন্ত্র খারাপ হয়ে গেলে পুরনো পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচার শেষ করতে হবে। অর্ধেক অস্ত্রোপচার করে সাত ঘণ্টা অপেক্ষায় রাখা অভাবনীয়। তার উপরে রোগীর যেখানে ডায়ালিসিস চলে, সেখানে অতিরিক্ত সতর্কতা দরকার। সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।’’

যে হাসপাতালে ঘটনাটি ঘটেছে, সেখানকার মেডিক্যাল সুপার অর্ণব গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘অনভিপ্রেত দুর্ঘটনা। আমাদের হাসপাতালে কখনওই আগে এমন হয়নি। ইঞ্জিনিয়ারেরাও সব সময়ে যন্ত্র পরীক্ষা করেন। বিকল্প যন্ত্রটিও ঘটনার দিন কয়েক আগে খারাপ হয়েছে। সতর্কতা সত্ত্বেও অনেক সময়ে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়।’’ আর যে চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করেছিলেন, তাঁর কথায়, ‘‘যন্ত্রের ব্যাপার আমার দেখার কথা নয়। ওটা হাসপাতাল দেখবে। যা যা করণীয়, করেছি। রোগীর চোখের ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না।’’

সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলি কি সব সময়ে বিকল্প যন্ত্র মজুত রাখে? যদি না রাখে তখন একটি মাত্র যন্ত্রে কি পরিষেবা দেওয়া হয়? সেটা কতখানি ঝুঁকির? কলম্বিয়া এশিয়া বা ডিসানের মতো একাধিক হাসপাতাল জানিয়েছে ইসিজি, এক্স-রে, ফেকো-র মতো ছোট যন্ত্রগুলির বিকল্প রাখা হয়। লেজার বা সিটি স্ক্যানের মতো বড়, দামি যন্ত্রের বিকল্প থাকে না। তেমনযন্ত্র খারাপ হলে কাছাকাছি কোথাও থেকে করিয়ে আনা হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

abpnewsletters
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE