Advertisement
০২ এপ্রিল ২০২৩
পোস্ট-কোভিড কেয়ার অত্যন্ত জরুরি। না হলেই কিন্তু শরীরে থাবা বসাতে পারে নানা অসুখবিসুখ
Post Covid Treatment

আরোগ্য লাভে সময় সম্বল

ব্রিদিং এক্সারসাইজ় করতে হবে। তার জন্য ইনসেনটিভ স্পাইরোমেট্রি নামক ডিভাইস দেওয়া হয়।

নবনীতা দত্ত
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২০ ০০:০৭
Share: Save:

সপ্তাহখানেক আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন মৃণাল। রিপোর্ট নেগেটিভ আসায় বাড়ি ফিরেছেন দু’দিন হল। কিন্তু শরীরে কোনও বল পাচ্ছেন না। আবার কোভিড থেকে সেরে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এলেও সব ভুলে যাচ্ছেন মালবিকা। হয়তো কোনও রান্না বসিয়ে ভুলে গিয়ে স্নান করতে চলে গেলেন। একই ওষুধ ভুলে গিয়ে দু’বার খেয়ে ফেলছেন...

Advertisement

করোনা থেকে সেরে ওঠার পরেও এমনই সব রোগের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন জনের মধ্যে। ফলে কোভিড-পরবর্তী চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি।

কোভিড-পরবর্তী চিকিৎসা

মেডিসিনের চিকিৎসক ডা. অরুণাংশু তালুকদার বললেন, ‘‘কোভিডে আক্রান্ত হলে শরীরে সাইটোকাইন উৎপাদন হয়। এ সময়ে ভাইরাসের তুলনায় যদি সাইটোকাইন বেড়ে যায়, তখনই নানা সমস্যা তৈরি করে। অনেকের করোনা সেরে গেলেও সাইটোকাইন উৎপাদন হতে থাকে, তার থেকেও নানা সমস্যা হয়। এর ফলেই মস্তিষ্কে, যকৃতে, ফুসফুসে... শরীরের বিভিন্ন অংশে সমস্যা দেখা দিতে পারে। ধরুন, যদি ফুসফুসে সাইটোকাইন উৎপাদন বেড়ে যায়, তখন সেই রোগীর শ্বাসকষ্ট হবে, কারও কিডনিতে বেড়ে গেলে কিডনির সমস্যা হবে, মস্তিষ্কে বেড়ে গেলে তার স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাবে। তাই পোস্ট কোভিড কেয়ার অত্যন্ত জরুরি।’’ অনেক রোগী হাসপাতাল থেকে বাড়ি গিয়ে ভাবছেন তাঁরা একদম সুস্থ, কোনও চিকিৎসার আর দরকার নেই। কিন্তু কোভিড-পরবর্তী সময়ে নিয়ম মেনে চলা প্রয়োজন। কারণগুলি একে একে বুঝতে হবে। জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীর কুমার মণ্ডল বললেন, ‘‘করোনাভাইরাস প্রথমেই ক্ষতি করছে ফুসফুসের। লাংসের প্রাকৃতিক টিসু নষ্ট করে দিচ্ছে, ফলে সেখানে তৈরি হচ্ছে ফাইব্রাস টিসু। কোভিড-পরবর্তী সময়ে ফুসফুসের যত্ন না নিলে এই ফাইব্রাস টিসুই চিরস্থায়ী হয়ে যাবে, যা ফুসফুসকে দুর্বল করে দেবে। তাই রোগী সেরে ওঠার পরেও তাঁকে ব্রিদিং এক্সারসাইজ় দেওয়া হয়। কিছু রোগীর কিডনি ড্যামেজড হতে দেখা যায়। মস্তিষ্ক ও হৃৎপিণ্ডেরও ক্ষতি হচ্ছে। মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ কমে গিয়ে হাইপক্সিয়া হতে পারে। তখন মস্তিষ্কের কাজে বিঘ্ন ঘটে। ফলে সে কারও কথা শুনতে চায় না, সহজে উত্তেজিত হয়ে পড়ে, ভুলে যাওয়ার প্রবণতাও বাড়ে।’’

Advertisement

ডায়েটে নজর দিন

• খাবারে কার্বসের পরিমাণ বাড়াতে হবে। করোনায় ভুগলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। শরীরের হৃত এনার্জি ফিরে পেতে কার্বোহাইড্রেট খাওয়া জরুরি। ডায়াবিটিস না থাকলে গ্লুকোজ় ড্রিঙ্ক খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কারণ শর্করা তৎক্ষণাৎ এনার্জি দেয়। ব্লাড সুগার থাকলে তাঁর ডায়েট সাবধানে তৈরি করতে হবে।

• দরকার প্রোটিনও। পুষ্টিবিদ সুবর্ণা রায়চৌধুরী বললেন, ‘‘চিকেন, ডাল, ডিম, পনির রাখতে হবে ডায়েটে। ভিটামিন সি-র জন্য মুসাম্বি, পেয়ারা, পাতিলেবু, আমলকীও খেতে বলা হয়। রোজ একটু কাঁচা হলুদ, রসুন, আদা, লবঙ্গ আর কলওঠা ছোলা রাখুন খাদ্যতালিকায়। এগুলি দিনের যে কোনও সময়ের খাবারে যোগ করে নিতে পারেন। আর খুব জরুরি হাইড্রেটেড থাকা। দিনে পর্যাপ্ত লিকুইড দরকার। জল তো খাবেনই, ডালের জল, সুপ, ডাব ইত্যাদিও খেতে পারেন। অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টস থাকায় গ্রিন টি-ও উপকারী।’’

• রোগীর জন্য নতুন ডায়েট তৈরি না করে সহজপাচ্য খাবার দিন। এমন ভাবে খাদ্যতালিকা তৈরি করুন, যে খাবার খেতে তিনি অভ্যস্ত।

পোস্ট-কোভিড কেয়ার

• হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে সাত দিন আইসোলেশনে থাকতে হবে।

• ব্রিদিং এক্সারসাইজ় করতে হবে। তার জন্য ইনসেনটিভ স্পাইরোমেট্রি নামক ডিভাইস দেওয়া হয়। সেখানে বল থাকে, পাইপ দিয়ে হাওয়া টানলে সেই বলটা উঠে আসে। এতে ফুসফুসে হাওয়া প্রবেশ করায় তা প্রসারিত হয়। ফলে তা অক্সিজেন বেশি গ্রহণ করতে পারে।

• চিৎ হয়ে ঘুমোনোর চেয়ে এক দিকে পাশ ফিরে শোয়া ভাল। পর্যাপ্ত ঘুম জরুরি। মস্তিষ্ককে যথাসম্ভব বিশ্রাম দিন।

• করোনা থেকে সেরে ওঠার পরেই মাথার কাজ বেশি করা উচিত নয়। রোগীকে ডিসচার্জের সময়ে অন্তত কুড়ি দিন গাড়ি চালাতে বারণ করা হয়। ড্রাইভিংয়ে যে পরিমাণ মনোযোগ ও কুইক অ্যাকশন নেওয়া দরকার, তার জন্য কিন্তু রোগী প্রস্তুত নয় তখন। এই ভাইরাস মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলছে। ফলে মস্তিষ্ক পুরোপুরি সক্রিয় থাকে না। তার ভুল করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব নিলে তাঁর অজান্তেই ভুল হতে পারে।

• অ্যালকোহল ও ধূমপান বন্ধ রাখতে হবে। এই দু’টিই কিন্তু শরীর আরও দুর্বল করে দেবে।

• মাঝেমাঝে জল গরম করে স্টিম নিতে পারেন। আরাম পাবেন।

• করোনার রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পরেও অন্তত কুড়ি দিন মানসিক ও শারীরিক ভাবে বিশ্রামে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, এটা রিপেয়ারিং টাইম। এই সময়ে যদি শরীরকে পুরোপুরি সেরে ওঠার সময় না দেন, সেই ক্ষত কিন্তু চিরস্থায়ী হবে। পরে অন্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।

• বাইরে বেরোলে কোনও সারফেস স্পর্শ করলে স্যানিটাইজ়ার ব্যবহার করুন। একবার স্যানিটাইজ়ার লাগিয়ে অন্য কিছু স্পর্শ করা মানেই কিন্তু আবার এক্সপোজ়ড হলেন।

মনের অসুখে অবহেলা নয়

• করোনা রোগীরা সাংঘাতিক ভাবে ট্রমার শিকার হচ্ছেন। হয়তো হাসপাতালে যেখানে ভর্তি ছিলেন, তাঁর পাশাপাশি বেডের রোগীকে তিনি মারা যেতে দেখেছেন একই অসুখে। ফলে বাড়িতে ফিরে আসার পরেও দীর্ঘ দিন মৃত্যুভয় থাকে রোগীর। ডা. অরুণাংশু তালুকদার বললেন, ‘‘এই অসুখ শুরুই হয়েছিল মৃত্যু দিয়ে। প্রথম দিকে অনেক রোগী মারা গিয়েছেন। এখন যদিও সুস্থতার হার অনেক বেশি, তবুও সেই মৃত্যুভয় মানুষের মনে গেঁথে গিয়েছে। তাই করোনা হলেই সকলের আগে তাঁকে গ্রাস করছে মৃত্যুভয়।’’

• অনেক টাকা খরচ হওয়ায়, অর্থনৈতিক দিক দিয়েও বড় ধাক্কা। • গ্রহণযোগ্যতাও একটা বড় দিক আমাদের সমাজে। করোনা থেকে সেরে ওঠার পরেও প্রতিবেশীরা সেই পরিবার বা মানুষকে একঘরে করে রাখেন। সেটাও মানসিক আঘাত দেয় তাঁকে। রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসার পরেও সকলের মাঝে যেতে ভয় পান বা পরিবারের লোক হয়তো ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলেন। এতে অসুখ জয় করে ফিরে আসা মানুষটি এক অন্য রোগে আক্রান্ত হন— অবসাদ। মানসিক দিক দিয়েও রোগীর যত্ন জরুরি। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং করান রোগীকে। মানসিক বল পাবেন। মনের দিকে থেকে শক্তি পেলে শরীর সেরে উঠতেও বেশি সময় লাগবে না।

করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসা মানেই চিকিৎসা সম্পূর্ণ নয়। প্রয়োজন মতো চিকিৎসার মেয়াদ বাড়াতে পারেন ডাক্তার। এই ভাইরাসের প্রভাব নিয়ে এখনও পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। তাই অন্য রোগী কুড়ি দিনে আরোগ্য লাভ করলেও আপনার ক্ষেত্রে তা না-ও হতে পারে। শরীরকে সেরে ওঠার জন্য সময় দিন। সুস্থ হয়ে উঠবেন অচিরেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.