Advertisement
E-Paper

মাতৃত্ব কী? মায়ের দায়িত্বই বা কত? নানা প্রশ্ন উঠে এল শহরের এক মঞ্চে

মা এবং মাতৃত্ব, মায়ের দায়িত্ব এবং মা-সন্তানের সম্পর্ক— সুস্থ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য মাতৃত্বকে বোঝার চেষ্টায় কলকাতার রোটারি সদনে একত্র হলেন রত্নাবলী রায়, অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অপর্ণা সেন-সহ অনেকে।

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৫ ১১:৫৩
এক মঞ্চে মনোসামাজ কর্মী (বাঁ দিকে) রত্নাবলী রায় এবং মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)।

এক মঞ্চে মনোসামাজ কর্মী (বাঁ দিকে) রত্নাবলী রায় এবং মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র ।

‘মা’ কে? যিনি সন্তানের জন্ম দেন? ২৪টি ঘণ্টা যাঁকে সন্তান চাইলেই কাছে পেতে পারে? আর মাতৃত্ব? মায়ের দায়িত্ব?—সব। সমাজ অন্তত তা-ই বলে। কিন্তু এত সহজে, সাদা-কালোর নিরিখে বোধ হয় মাতৃত্বকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। সমাজের বলে দেওয়া কাঠামোয় বন্দি করলে তার বাইরে থেকে যায় হাজার হাজার উদাহরণ, হাজার হাজার ঘটনা। যে মা দত্তক নেন? যে মা মাতৃত্ব চাননি? যে মা 'নারী' নন? তা হলে তাঁদের কোন কাঠামোয় ফেলা হবে? এমনই আরও একাধিক প্রশ্ন হাওয়া ভেসে বেড়াচ্ছে। যার উত্তর খোঁজার চেষ্টা শুরু হয়েছে পৃথিবীর নানা কোণে। নতুন করে ভাবা প্রয়োজন মাকে নিয়ে, মাতৃত্বকে নিয়ে, মায়ের দায়িত্ব নিয়ে। তবেই হয়তো সুস্থ ভবিষ্যৎ গড়ার উদ্দেশ্যে পথচলা শুরু হবে।

কলকাতার রোটারি সদনে সেই সব প্রশ্ন তুলে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হল শুক্রবার সন্ধ্যায়। মঞ্চে মনোসামাজ কর্মী রত্নাবলী রায় এবং মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। মাতৃত্বের সংজ্ঞার প্রশ্নে উত্তর এল, মাতৃত্ব আসলে একটি ভূমিকা। নির্দিষ্ট সময়সীমায় সেই ভূমিকায় কেউ অবতীর্ণ হতে পারেন, আবার না-ও পারেন। তবে তার জন্য কি তাঁকে সত্যিই কেবল নারী হতে হবে? তাঁকে ‘বি-সমকামী’ হতে হবে? অথবা বিয়ে করতে হবে বা জন্ম দিতে হবে? কেউ হতে পারেন, আবার না-ও পারেন। ঠিক যেমন লিঙ্গের সঙ্গে মাতৃত্বের কোনও বিরোধ নেই, তেমনই বিয়ের সঙ্গেও মাতৃত্বের কোনও সম্পর্ক নেই। মাতৃত্বের নির্দিষ্ট কোনও রং নেই, আকৃতি নেই, আকারও নেই। কোনও একটিমাত্র নকশায় তাকে ছকে ফেলা যায় না।

প্রশ্ন এল দর্শকাসনে বসা এক মায়ের তরফ থেকে— তাঁর দুই সন্তান তাঁকে বলেন, ‘‘মা, তুমি মায়েদের মতো নও। তুমি সব সময়ে শাড়ি কেন পরো না?’’ ঠিক একই ভাবে রত্নাবলীর পুত্রসন্তান শৈশবে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘তোমায় ঠিক মা মা দেখতে নয়।’’ মায়েদের কি তবে বিশেষ চেহারা হয়? তাঁদের কি বিশেষ পোশাকবিধি মানতে হয়? দায় সন্তানদের নয়, দায় সেই সমাজের। যে সমাজ মাতৃত্বকে মহিমান্বিত করে মায়েদের ব্যক্তিসত্তাকে উধাও করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে যুগ যুগ ধরে।

মাতৃত্ব নিয়ে আলোচনায় রত্নাবলী এবং অনুত্তমা।

মাতৃত্ব নিয়ে আলোচনায় রত্নাবলী এবং অনুত্তমা। —নিজস্ব চিত্র।

কিন্তু নাগরিক চেতনা আয়োজিত অনুষ্ঠান ‘অনু-সঙ্গে রত্নাবলী’তে মাতৃত্বকে একটি ভূমিকা হিসেবে চিহ্নিত করা হল। সে ভূমিকায় থাকতে পারেন নারী, পুরুষ, রূপান্তরকামী নারী বা পুরুষ, নারী-পুরুষের ছকে না বাঁধা পড়া ব্যক্তিও। তাঁকে যে এই ভূমিকা সর্ব ক্ষণ পালন করে যেতে হবে, তারও কোনও মানে নেই।

অনুত্তমা মনে করেন, এই সময়ে মাতৃত্ব নিয়ে কথা বলাটা ভীষণ জরুরি, আর তাই তো প্রেক্ষাগৃহ ভিড় করে রয়েছেন এত মানুষ। তাঁদের কেউ মা, কেউ মা নন, কেউ মা হতে চান, কেউ চান না। মনোবিদের কথায়, ‘‘মাতৃত্ব নিয়ে সংলাপ অধরা রয়ে গিয়েছে এখনও। আমরা মাতৃত্বকে যে চিরাচরিত ধারণার মধ্যে আটকে থাকতে দেখেছি, সেই ধারণাগুলিকেই আদতে চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছি। যিনি এই ভূমিকায় রয়েছেন, তিনি কী ভাবে নিজেকে ভাল রাখবেন, এবং সন্তানের সঙ্গে সৎ, সহৃদয় সেতু নির্মাণ করবেন, তা নিয়েই আলোচনা করছি।’’

নাগরিক চেতনার মঞ্চে অভিনেত্রী অপর্ণা সেন।

নাগরিক চেতনার মঞ্চে অভিনেত্রী অপর্ণা সেন। — নিজস্ব চিত্র।

অনুত্তমার প্রশ্ন, সময়কাল যা-ই হোক না কেন, সন্তান লালনে মায়ের দায়িত্ব ঠিক কতখানি? তাঁকে কি নিজেকে সঁপে দিতে হবে এই ভূমিকায়? তাঁর ভাল থাকা, না থাকা? তাঁর মানসিক ভূগোল? সমাজ যেন বার বার সকলকে (বিশেষত নারীদের) আদর্শ মা হওয়ার পাঠ দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু ‘আদর্শ’ বলে কি আদৌ কিছু হয়? অনুষ্ঠানের আলোচনায় সেই নিখুঁত এবং আদর্শ মাতৃত্বের ধারণাকেই ভেঙে ফেলার চেষ্টা চলল। মায়েদের দায়িত্ব আসলে আদর্শ বা নিখুঁত হওয়া নয়, অকৃত্রিম হওয়া। যেখানে দাঁড়িয়ে সন্তান ও মায়ের মধ্যে গড়ে উঠতে পারে সুস্থ এক সম্পর্ক। সন্তানের সঙ্গে সততায় ভরা সংলাপে যেতে হবে মাকে। মায়েদেরও সব সময়ে মাতৃত্বের ভূমিকা পালন করে যেতে ভাল লাগে না। তাঁদেরও কোনও কোনও সময়ে নিজের মতো সময় কাটাতে ইচ্ছে করতে পারে। সে কথা সন্তানকে বলতে হবে। তার মতো করে। তার ভাষায়। সন্তানকে জানতে হবে, সারা জীবন মুখের সামনে কেউ বসে থাকবে না। মা-ও নন। সন্তানকে নিজের মতো ছেড়ে দিতে হবে। যাতে সে-ও তার মতো করে অভিজ্ঞতা লাভ করে। অনুষ্ঠানের সূচনা করার সময়ে অভিনেত্রী, পরিচালক অপর্ণা সেন ঠিক সেই কথাই বলতে চেয়েছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘বিনাইন নেগলিজেন্সের প্রয়োজন এখন। মানে, সন্তানকে ছেড়ে দিতে হবে নিজেদের মতো।’’ অর্থাৎ সব বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে কখনও কখনও অবহেলাও জরুরি বলে মনে করেন ৮০ বছরের অভিনেত্রী।

‘অনু-সঙ্গে রত্নাবলী’ অনুষ্ঠানে রত্নাবলী এবং অনুত্তমা।

‘অনু-সঙ্গে রত্নাবলী’ অনুষ্ঠানে রত্নাবলী এবং অনুত্তমা। —নিজস্ব চিত্র।

এই মুহূর্তে কেন হঠাৎ মাতৃত্ব নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন পড়ছে? কেনই বা নতুন করে ভাবতে হচ্ছে? মাতৃত্ব নিয়ে সংলাপ আসলে সমাজের আয়না। এমনটাই মনে করেন রত্নাবলী। আর তাই তাঁর কথায়, ‘‘মাতৃত্বে ভালবাসার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ভয়, অপরাধবোধ, ক্লান্তি আর প্রতি দিন নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা। মা শুধুই জন্মদাত্রী নন। মা একটি ভূমিকা, যেখানে তাঁর সামাজিক লিঙ্গ একমাত্র পরিচায়ক নয়। তিনি সেই মানুষ, যিনি টিকে থাকার, প্রতিরোধের, আর আশার ভাষা নতুন করে লেখেন। তাই মাতৃত্ব আসলে জৈব প্রক্রিয়া নয়| এটা এক সামাজিক ও রাজনৈতিক যাত্রা।’’ আর তাই প্রত্যেক মায়ের প্রয়োজন নিজের প্রতি যত্নবান হওয়া। সমাজের প্রয়োজন মায়ের দিকে আঙুল না তুলে তাঁকে নিরাপদ বোধ করানো।

Motherhood Journey Anuttama Banerjee Ratnaboli Ray Rotary Sadan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy