Advertisement
E-Paper

তোমার ফোনে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ! পরকীয়া এখন অনলাইন অশরীরী, তাতেও ভাঙছে দাম্পত্য

প্রেমে কোনও নিয়ম হয় না, সে কথা প্রচলিত। তবে নতুন যুগে বিবাহ-বহির্ভুত সম্পর্কের সংজ্ঞা এমনই বদলেছে যে, তা চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমীক্ষা বলছে, ৪০ শতাংশ বিবাহিত ভারতীয় বিশুদ্ধ ডিজিটাল প্রেমে মজেছেন।

সুচন্দ্রা ঘটক

শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০২৫ ১০:০২
ফোনেই প্রেম, ফোনেই ভবিষ্যৎ।

ফোনেই প্রেম, ফোনেই ভবিষ্যৎ। গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।

গত বছরের পুজোটা এক শিল্পী ও এক তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী একসঙ্গে কাটিয়েছেন। তবে তাঁদের কোনও মণ্ডপে হাত ধরাধরি করে দেখা যায়নি। একসঙ্গে কোনও রেস্তরাঁয় খাওয়াদাওয়া করতেও দেখেননি কেউ। কারও কাছে এমন তথ্য নেই যে, তাঁরা কলকাতা ছেড়েছিলেন একই দিনে। বরং শিল্পী নিজের পরিবারের সঙ্গে পুজোকর্তাদের নেমন্তন্ন রক্ষা করেছেন বলে ছবি দেখা গিয়েছে সমাজমাধ্যমে। তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীকেও যথারীতি অফিসে দেখতে পেয়েছেন সহকর্মীরা। তবে তাঁরা একসঙ্গে ছিলেন কী ভাবে? কোথায়? তাঁরা প্রেমে জড়িয়েছেন বলে রটল কেন? শিল্পী ঘনিষ্ঠদের কাছে স্বীকার করেছেন, ‘‘ওর সঙ্গেই তো ছিলাম গোটা পুজোটা। আমার প্রতি মুহূর্তের সব কথা ও জানে। সব সাজের ছবি দেখেছে। ওর কথা শুনে শাড়িও বেছেছি।’’

সম্পর্ক তাঁদের হয়েছে। তবে সবটাই ফোনে। বলা ভাল, চ্যাটে। সে প্রেম এখনও বহমান। একে অপরের সঙ্গে দেখা হয় না যদিও কখনওই।

ডিজিটাল ভারতে প্রেমও এখন ডিজিটাল। অন্তত তা যদি হয় পরকীয়া, তবে তা অনলাইনে চলার প্রবণতাই দিন দিন বাড়ছে। ভাল লাগা থেকে ভালবাসা প্রকাশ, কখনও ছলাকলা, কখনও ঝগড়া, কখনও ঈর্ষা, কখনও স্বপ্ন বিনিময়— সব হয়। তবে সবই হাতের নাগালের বাইরে থেকে। চোখের দেখাও থাকে না তাতে। তথ্য অন্তত তেমনই বলছে।

ফলে এতে নেই শার্টের কলারে লিপস্টিকের দাগ। নেই ক্রেডিট কার্ডের বিলে কোনও হোটেলের খরচ লুকনোর ঝক্কি। ঘন ঘন ‘অফিস ট্যুর’ নেই। এমনকি, অফিসে ভুল তথ্য দিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে কফি শপে যাওয়ারও কোনও ঘটনা ধরা পড়ে না। স্ত্রী বা স্বামী মাঝেমাঝে বড়জোর বিরক্তি প্রকাশ করেন সারা দিন ফোনে মুখ গুঁজে থাকার জন্য!

এতে নেই শার্টের কলারে লিপস্টিকের দাগ। নেই ক্রেডিট কার্ডের বিলে কোনও হোটেলের খরচ লুকনোর ঝক্কি।

এতে নেই শার্টের কলারে লিপস্টিকের দাগ। নেই ক্রেডিট কার্ডের বিলে কোনও হোটেলের খরচ লুকনোর ঝক্কি। — ফাইল চিত্র।

আরও সব ধরনের সম্পর্কের মতোই বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কেরও নানা প্রকার হয়। কিন্তু বিবাহিত জীবন সামলে প্রেমের জোয়ারে ভাসতে গিয়ে পচা শামুকে পা কাটার ঘটনা কম ঘটেনি। ইতিহাসে তা ভালই ধরা আছে।

প্রাচীন সাহিত্যে যে ধরনের পরকীয়ার কথা রয়েছে, সবেতেই আছে শারীরিক ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত— তা সে তারার গল্পই হোক বা পুলোমা। এ কালে হিন্দি ছবিতেও তেমনই দেখা গিয়েছে। ‘সিলসিলা’ থেকে ‘মার্ডার’, দূরে থেকে কাছে থাকার কথা কোথাওই বলা হয়নি। বরং পরকীয়াকে দেখানো হয়েছে চাঞ্চল্যকর। কারণ, কাছাকাছি না এসে প্রেমে জড়িয়ে থাকার উপায় এর আগে বোধ হয় সে ভাবে জানাও ছিল না।

সময় সে সবও বদলে দিচ্ছে। দিন দিন গতিময় হয়ে ওঠা ভারতীয় জীবনধারায় ঘরে থাকারই সময় হয় না, তার উপরে সংসার সামলে আবার একটি নতুন প্রেমে জড়ানোর বিলাসিতা এখন অনেকেরই নেই। আর সে কথাই ফুটে উঠেছে নতুন এক সমীক্ষায়।

বাকি সব কাজকর্ম যত ফোন-ল্যাপটপ নির্ভর হচ্ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে অনলাইন প্রেমও। সম্প্রতি বিবাহিতদের জন্য তৈরি একটি ডেটিং অ্যাপ সংস্থার তরফে সমীক্ষা চালানো হয়েছিল ডিজিটাল যুগের প্রেম নিয়ে। সেখানেই উঠে এসেছে এক গুরুতর তথ্য। ৪০ শতাংশ ভারতীয় নারী ও পুরুষ স্বীকার করেছেন, তাঁরা বিশুদ্ধ অনলাইন সম্পর্কে জড়িয়ে। তার মধ্যে শারীরিক ঘনিষ্ঠতা তো নেই-ই, আর তেমন ইচ্ছাও বিশেষ নেই বললেই চলে। ৬৫ শতাংশ জানিয়েছেন, কারও ক্ষতি না করে প্রেমে থাকার এটাই উপায়। এঁদের মধ্যে ৭২ শতাংশ কোনও দিনই নিজের দাম্পত্য ছেড়ে বেরিয়ে আসার ইচ্ছাও রাখেন না মনে। শুধু একটু ভালবাসায় থাকতে চান, সে বিয়ের দায়িত্বের বাইরে। আর তাঁরা মনে করেন, এ ভাবে কাউকে না ‘ঠকিয়ে’ যদি নিজে ভাল থাকা যায়, তবে ক্ষতি কী? তাই তাঁদের জীবনে সেই সম্পর্কগুলি নির্ভেজাল ভাবে ডিজিটাল।

কাজকর্ম যত ফোন-ল্যাপটপ নির্ভর হচ্ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে অনলাইন প্রেমও।

কাজকর্ম যত ফোন-ল্যাপটপ নির্ভর হচ্ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে অনলাইন প্রেমও। —ফাইল চিত্র।

বিশুদ্ধ ডিজিটাল সম্পর্ক ঠিক কেমন?

দেখাসাক্ষাৎ বিশেষ হয় না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে কখনওই হয় না। এ শুধুই মন দেওয়া-নেওয়া। কখনও মনের কথা বলা। আর শোনা। অধিকাংশটাই লিখে। যখন স্বামী বা স্ত্রী অন্য কাজে ব্যস্ত অথবা ঘুমের দেশে। সমীক্ষা বলছে, এই ধরনের সম্পর্কে থাকা ব্যক্তিরা মূলত রাত ১০টা থেকে ১টার মধ্যে একে অপরের সংস্পর্শে থাকেন। যদিও কলকাতারই একটি ব্যাঙ্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানালেন, তাঁর প্রেমিকের সঙ্গে মূলত কথা হয় কাজের ফাঁকে। বাড়ি ফিরে আর সময় পান না তিনি। বাড়িতে স্বামী আছেন। আছে তিন বছরের পুত্র। তাঁদের সময় দিতে হয়। ফলে দিনভর যখন তাঁরা দু’জনে শহরের দুই প্রান্তে দু’টি অফিসে কাজ করেন, তখনই চলে কথাবার্তা।

কিন্তু এ কি ঠকানো নয়?

অন্তত ৬৮ শতাংশ ব্যক্তি জানিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গীরা যদি এমন করেন, তবে তাঁরা কষ্ট পাবেন। কিন্তু নিজের এতে ভাল লাগে। এবং সঙ্গীর কোনও ক্ষতি তাঁরা করেন না বলেই দাবি।

সঙ্গীকে ঠকানো মানে, কারও সঙ্গে পুরোদস্তুর সম্পর্কে জড়ানো। এমনই মনে করেন অধিকাংশ। পুরোদস্তুর অর্থাৎ, তাঁকে রোজের জীবনে টেনে আনা। দেখা করা। ঘোরাফেরা করা। একসঙ্গে সময় কাটানো। এ ক্ষেত্রে সে সব কিছুই হয় না। দিনের কিছুটা সময় খালি কথা বলা। মূলত লিখে বার্তা বিনিময়। কখনও ছবি পাঠানো। কখনও শুধুই ইমোজি আদানপ্রদান। একে ঘর বাঁচিয়ে নিজের মন ভাল রাখার উপায় বলেই মনে করেন বেশির ভাগ। কিন্তু এর থেকে কি বিপদে পড়েন না কেউ? পড়েন। রাগারাগি, অশান্তি হয়। যেমন হয়েছিল মুম্বইয়ের বাসিন্দা অয়ন রায়ের। তিনি জানান, স্কুলের এক বান্ধবীর সঙ্গে মাঝে খুবই বেশি কথাবার্তা হত। সে সব লেখালেখি দেখে ফেলেছিলেন স্ত্রী। খুবই মনখারাপ হয়েছিল। কিন্তু সেই বান্ধবী থাকেন অন্য এক দেশে। তাঁদের কখনও দেখা হয় না। ফলে স্ত্রী বুঝতে পারেন, তিনি অহেতুক বেশি চিন্তা করছেন। তাই তাঁদের দাম্পত্য আবার আগের পর্যায়ে ফেরে। তবে সেই বান্ধবীর সঙ্গে এখন আর তেমন যোগাযোগ নেই। আর একে ঠিক প্রেম বলতেও চান না অয়ন। তবে মনের কথা বলা, কখনও ফ্লার্ট করা, কখনও ভিডিয়ো কলে একে অপরকে দেখা— এই সবই ছিল সেই আদানপ্রদানে।

বান্ধবীর সঙ্গে কথাবার্তা হত। সে সব লেখালেখি দেখে ফেলেছিলেন স্ত্রী। অশান্তি হয়েছিল।

বান্ধবীর সঙ্গে কথাবার্তা হত। সে সব লেখালেখি দেখে ফেলেছিলেন স্ত্রী। অশান্তি হয়েছিল। —ফাইল চিত্র।

কেন জড়ান এমন সম্পর্কে?

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এমন সম্পর্কে জড়াচ্ছেন। এঁদের বয়স মূলত ৩০ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। বহু নারী জানাচ্ছেন, তাঁরা এ ভাবেই একটু মনের কথা বলার জায়গা পান। যিনি তাঁর রোজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নেই, তিনি যেন খানিক বেশি শোনেন তাঁর মনের কথা। বহু পুরুষের বক্তব্য, এই নির্ভেজাল ঘনিষ্ঠতা রোজের জীবনের একঘেয়েমি থেকে দূরে রাখে। মনে হয়, এখনও কোথাও কেউ আছেন, যিনি তাঁর কথা শুনতে আগ্রহী।

তবে বদলাচ্ছে কি ব্যাভিচারের সংজ্ঞা?

এখনই তেমনটা যে দাবি করছেন লোকে, তা বলা চলে না। তবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনলাইন প্রেমিক-প্রেমিকাকে নিয়ে অশান্তির ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি বিয়েও ভেঙেছেন এক শিক্ষিকা, স্বামীর বহুপ্রেমের অভিযোগ তুলে। তার মধ্যে অধিকাংশ বান্ধবীই অনলাইন যোগাযোগে ছিলেন বলে স্বীকার করেছেন সেই মহিলা নিজেই।

অথচ খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। মাত্র ২০১৮ সালে ভারতীয় আইনবিধির ৪৯৭ ধারায় বদল আসে। তার আগে এই ধারা অনুযায়ী বিবাহ-বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পরস্ত্রীর সঙ্গে তেমন সম্পর্কে জড়ালে জেল খাটার বন্দোবস্তও হতে পারত। সে ধারায় অপরাধের লিঙ্গভেদ বিতর্ক যা-ই থাক না কেন, এটুকু প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, শারীরিক সম্পর্কে না জড়ালে তা বৈবাহিক বন্ধনকে অসম্মান করে না এবং বিপদেও ফেলে না। সে আইনে বদল এসেছে সবেই। তবে তার কারণ আরও নানা প্রকার ছিল। নারীর সম্মানের প্রসঙ্গও ছিল।

নব যুগে পরকীয়ার মাপকাঠি যে শরীরিক ঘনিষ্ঠতার গণ্ডি ছাপিয়ে চলে গিয়েছে ইন্টারনেটে, সে খেয়াল বুঝি এখনও করেননি অনেকেই। তবে এ কথা জানা থাক, পরকীয়া দণ্ডনীয় অপরাধ না হলেও, অনলাইন সম্পর্কও পরকীয়ার আওতায় পড়ে। বিবাহবিচ্ছেদের যথেষ্ট কারণ হিসাবেই একে দেখা হয়। সন্তানের হেফাজত পাওয়া নিয়েও সমস্যার কারণ হতে পারে এমন পরকীয়া।

Digital Affair Extra Marital Affair Love Affair Virtual Relationship
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy