প্রেম আর বন্ধুত্ব কি একই সুতোয় বাঁধা? ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’ দেখে যাঁরা বড় হয়েছেন, তাঁদের অনেকের কাছেই ‘প্যার দোস্তি হ্যায়’। সেই সিনেমার মুখ্য চরিত্র রাহুল (শাহরুখ খান) বলেছিল, ‘‘সে যদি আমার ভাল বন্ধুই না হতে পারে, তা হলে ওকে ভালবাসব কী করে? বন্ধুত্ব ছাড়া তো প্রেম হয় না।’’ তবে ২৭ বছর আগে শাহরুখের সেই সংলাপ কি আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক? প্রেম করার আগে কি এখনও একজন ভাল বন্ধুর খোঁজ করে মানুষ?
বলিউডের বাইরে বেরোলে অনেকেই হয়েতো মনে করেন প্রেম মানেই বন্ধুত্ব নয়। ছবির পর্দায় সংলাপগুলি শুনতে বেশ লাগলেও বাস্তবে এমনটা হয় না। ডেটিং অ্যাপের যুগে জেন জ়ি-রা এখন প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা বাছাই করে মোবাইলে সোয়াইপের মাধ্যমে। ‘সিচুয়েশনশিপ’, ‘ক্যাজ়ুয়াল ডেটিং’, ‘ব্লাইন্ড ডেটিং’, ‘অনলাইন ডেটিং’-এর হিড়িকে প্রেমের সম্পর্কে বন্ধুত্বটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে না তো?
বছর দশেক ধরে সম্পর্কে রয়েছেন অভিনেতা ঋদ্ধি সেন এবং অভিনেত্রী সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৩ সালে ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’ ছবিটি করতে গিয়ে প্রথম আলাপ। বছর দুয়েক পরে ‘আজকের সাজাহান’ নাটক দেখতে গিয়ে প্রথম প্রেমালাপ। তার পর একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দীর্ঘ দিনের পথ চলা। তাঁদের প্রেমের রসায়নটি কি বন্ধুত্বনির্ভর? ঋদ্ধি বলেন, ‘‘আমি আর সুরঙ্গনা যখন সম্পর্কে জড়িয়েছি, তখন দু’জনের বয়সই অল্প। তখন প্রেমের গভীরতা নিয়ে তেমন ধারণা ছিল না, তবে একে অপরের ভাল বন্ধু ছিলাম নিঃসন্দেহে। আমি মনে করি, কোনও সম্পর্কের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে বন্ধুত্ব। যদি মন খুলে নিজের কথা একে অপরকে বলতেই না পারেন, পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে আনন্দ-তর্কে না জড়াতে পারেন, একে অপরের ভাল বন্ধু না হয়ে উঠতে পারেন, তা হলে সেই সম্পর্ক পোক্ত হয় না। যে সম্পর্কে বন্ধুত্বের জায়গাটা কমে যায়, কেবল ভালবাসার ভিত্তিতে সেই সম্পর্কটি দীর্ঘমেয়াদি হওয়া মুশকিল।’’
ঋদ্ধি সেন এবং সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
এখন বেশির ভাগ সম্পর্ক তৈরি হয় সমাজমাধ্যম কিংবা ডেটিং অ্যাপে। তবে সেই সম্পর্কগুলির বেশির ভাগই খুব বেশি দিন স্থায়ী হয় না। কারণটা কী? ঋদ্ধির মতে, ডেটিং অ্যাপে তৈরি হওয়া সম্পর্কগুলিতে বন্ধুত্বের তুলনায় প্রেমটাই বেশি প্রাধান্য পায়। তাই বোধ হয় সম্পর্কগুলিতে নিরাপত্তাহীনতাও বেশি। নব্বইয়ের দশকেও প্রেমের সম্পর্কে নিরাপত্তাহীনতা ছিল, তবে এখন যেন সেটা প্রকাশের ধরনে অনেকখানি তারতম্য ঘটে গিয়েছে। বন্ধুত্ব মানে কিন্তু দু’জনেই সমান। কেউ বড় বা কেউ ছোট নয়। আর প্রেমের সম্পর্কে তাই বন্ধুত্বটা থাকা দরকার।
২০০৮ সালে মুক্তি পায় ইমরান খান এবং জেনেলিয়া ডি’সুজ়া অভিনীত ‘জানে তু... ইয়া জানে না’ ছবিটি। সেখানে প্রিয় বন্ধু জয়কেই শেষমেশ জীবনসঙ্গী হিসাবে বেছে নেয় ছবির নায়িকা অদিতি। ২০১০ সালে ‘ব্যান্ড বাজা বারাত’ ছবিতেও বিট্টু (রণবীর সিংহ) আর শ্রুতির (অনুষ্কা শর্মা) প্রেমকাহিনির নেপথ্যে ছিল সেই বন্ধুত্ব। ২০১৩ সালে রণবীর কপূর আর দীপিকা পাড়ুকোন অভিনীত ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’ ছবিতেও বনি আর নয়নার প্রেম শুরু হয় বন্ধুত্বের হাত ধরেই। বলিউড কিন্তু বরাবরই প্রেমের সম্পর্কে বন্ধুত্বকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। তবে ইদানীং বলিউডে সেই রকম ছবির সংখ্যা কমছে।
নিরঞ্জন মণ্ডল। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।
তা হলে এখন কি প্রেমের সম্পর্কে বন্ধুত্বটা ফিকে হয়ে যাচ্ছে? সমাজমাধ্যমের পরিচিত মুখ ‘লাফটারসেন’ নিরঞ্জন মণ্ডল। সম্পর্কের রসায়ন নিয়ে তৈরি করে নিরাঞ্জনের ভিডিয়োগুলি মন ছুঁয়ে যায় আট থেকে আশির। মুড়ির সঙ্গে জলের সম্পর্ক, বিড়ির সঙ্গে দেশলাইয়ের সম্পর্ক, এমনকি, অ্যাসিডিটি, দুধ চা আর লাল চায়ের মধ্যেও যে ত্রিকোণ প্রেমের সম্পর্ক হতে পারে, তা নিরঞ্জনের ভিডিয়ো না দেখলে বোঝার উপায় নেই। বাস্তবের প্রেম টিকিয়ে রাখতে বন্ধুত্ব কি জরুরি? জে়ন জ়ি হলেও নিরাঞ্জন কিন্তু মনে করেন বন্ধুত্ব ছাড়া প্রেম টেকে না। নিরাঞ্জন বলেন, ‘‘আমি আমার সম্পর্কের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, প্রেম দিয়ে শুরু হলেও একটা সময়ের পর কিন্তু সম্পর্কে বন্ধুত্বটাই বড় হয়ে যায়। শুনতে ফিল্মি লাগলেও, আমি কিন্তু সঙ্গীর মধ্যে সবার আগে একজন ভাল বন্ধুকেই খুঁজি।’’
এই প্রজন্মের অনেক ‘কমিটমেন্ট ফোবিক’ ছেলেমেয়েই এখন সম্পর্কে দায়বদ্ধতা চান না। তাঁরা এখন অনেক বেশি ‘সিচুয়েশনশিপে’ বিশ্বাসী, অর্থাৎ, অস্পষ্ট প্রেম কিন্তু গভীর। শারীরিক বা মানসিক হতেই পারে কিন্তু কোনও দায় নেই কারও। আবার কারও কাছে হয়তো সম্পর্ক মানে ‘ব্রেডক্রাম্বিং’, অর্থাৎ মিষ্টি মিষ্টি কথায় সে সঙ্গীকে আপন করে রাখবে, অনেক আশা দেখাবে কিন্তু কিছু দিন পরেই সবটা শেষ। আর সেই সম্পর্কে টিকিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সম্পর্কে বন্ধুত্ব নেই বলেই কি এমন পরিণতি?
শোলাঙ্কি রায়। ছবি: সংগৃহীত।
অতীতের সম্পর্কগুলিকে পিছনে ফেলে অভিনেত্রী শোলাঙ্কি রায় এখন একাই বেশ আছেন। অভিনেত্রীর কাছে কিন্তু এখনও ‘প্যার দোস্তি হ্যায়’। শোলাঙ্কি বলেন, ‘‘বন্ধুত্বই যে কোনও সম্পর্কের ভিত তৈরি করে। আমি অন্তত সেই রকমটাই মনে করি। তবে এখনকার প্রজন্মের কাছে সম্পর্কের পরিভাষা বদলে গিয়েছে। এখন তাঁরা একটি সম্পর্কে ‘রেড ফ্ল্যাগ’, ‘গ্রিন ফ্ল্যাগ’ এই ধারণাগুলিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আগে তো প্রেমিক-প্রেমিকা একে অপরের জন্য অপেক্ষা করবে, সেটাই ছিল স্বাভাবিক। অপেক্ষাটাই ছিল প্রেম। তবে এখনকার দিনে অপেক্ষা করতে হবে মানেই সেটা সম্পর্কের ‘রেড ফ্ল্যাগ’, সেই সম্পর্কে আর থাকাই যাবে না। তাদের আসলে ধৈর্যের বড় অভাব।’’ সম্পর্কে যদি বন্ধুত্ব হয়, তা হলে কিন্তু একে অপরকে বোঝার অনেকখানি সময় পাওয়া যায়। আর বন্ধুত্বের উপর নির্ভর করে যে সম্পর্কগুলি তৈরি হয়, সেটা টেকেও বেশি দিন। তবে এখন চটজলদি সম্পর্কের সিদ্ধান্ত নিতে বন্ধুত্বের গভীরতাটা যেন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে, এমনটাই মনে করেন শোলাঙ্কি।
সোহিনী সেনগুপ্ত এবং সপ্তর্ষি মৌলিক। ছবি: সংগৃহীত।
দু’জনের মধ্যে বয়সের ব্যবধান ১৪ বছর, তবুও টলিপাড়ার অন্যতম সফল জুটি সোহিনী সেনগুপ্ত এবং সপ্তর্ষি মৌলিক। বিয়ের ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও সোহিনী-সপ্তর্ষির মধ্যে রোম্যান্স, কিন্তু এতটুকুও কমেনি। সোহিনী বলেন তাঁদের সম্পর্কের শুরুটা কিন্তু বন্ধুত্ব থেকে হয়নি। অভিনেত্রী বলেন, ‘‘আগে আমরা একে অপরের প্রেমে পড়ি, বন্ধুত্বটা হয়েছে পরে। প্রজন্মের সঙ্গে প্রেমের সংজ্ঞা বদলে যায়, এটা আমি মনে করি না। বন্ধুত্বের মতো প্রেমের সম্পর্কেও কিন্তু একে অপরকে সমান ভাবাটা জরুরি। নইলে কিন্তু প্রেম টেকানো মুশকিল। সঙ্গীর সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকলে একে অপরকে বুঝতে অনেক সুবিধা হয়। তখন কিন্তু কিছু না বললেও একে অপরের দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ, ভাল লাগা, মন্দ লাগার মতো বিষয়গুলি সহজেই বুঝে ফেলা যায়। এখনকার দিনে মানুষের জীবন খুব কঠিন হয়ে গিয়েছে। সেই কারণেই মানুষেক হাতে এখন ফুরসত নেই। আর সেই কারণেই বোধ হয় প্রেমের সম্পর্কগুলিতেও জটিলতা এসেছে।’’
প্রেম বলেকয়ে আসে না। কখন কী ভাবে প্রেমের জোয়ারে হাবুডুবু খাবে মন, তা কি আর আগে থেকে বলা সম্ভব? তবে প্রেম সব সময়েই মধুর। আর প্রথম প্রেমের অনুভূতিই আলাদা। সব সময়েই ‘চোখে-হারানো’, ভালবাসার মানুষের জন্য বুক-দুরুদুরু, নতুন নতুন উপহার দিয়ে চমকে দেওয়া। প্রথম প্রথম প্রেমে বাঁধনহীন আবেগ থাকে, সঙ্গীর জন্য অন্তহীন অপেক্ষা থাকে, দু’চোখে থাকে স্বপ্ন। প্রেম যত পুরনো হয়, ততই উচ্ছ্বাস কমে, অভিজ্ঞতার ভারে তার ভিত আরও মজবুত, পাকাপোক্ত হয়। সম্পর্কের সমীকরণ ঠিক কতটা মজবুত হবে, তা শুধু একে-অপরের প্রতি ভালবাসার উপর নির্ভর করে না। ভালবাসা ছাড়াও সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে বন্ধুত্বটাও দরকার। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে এখনকার প্রজন্ম সেই বন্ধুটাকেই হারিয়ে ফেলছে না তো? প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাবে।