যৌনতার নিরিখে যাঁরা প্রান্তিক, তাঁদের সমস্যা এক এক ক্ষেত্রে এক এক রকম। মাঝেমধ্যেই খবর আসে, শহরের বিভিন্ন প্রান্তে রূপান্তরকামীরা নানা রকম হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। কখনও ঠাট্টা-তামাশা, তো কখনও আবার গালিগালাজ, মারধর। কিন্তু এমন সমস্যায় পড়লে কোথায় যাবেন? কোন বন্ধুকে পাশে পাবেন? সঙ্কটের সময়ে রূপান্তরকামীদের পাশে থাকতেই সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে মিলিত ভাবে নির্দিষ্ট একটি ‘হেল্পলাইন’ নম্বর চালু করার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এ বার থেকে ফোন ঘোরালেই রূপান্তরকামীরা জানাতে পারবেন নিজেদের সমস্যার কথা। সেই মতো মিলবে সাহায্যও।
২০১৯-এর ট্রান্সজেন্ডার অ্যাক্ট অনুযায়ী, এর মধ্যে বহু পরিবর্তন আসার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তব এখনও অনেক কঠিন। কর্মক্ষেত্র থেকে পরিবার, নানা জায়গায় রকমারি সমস্যার মুখে এখনও পড়তে হচ্ছে রূপান্তরকামীদের। তাই হেল্পলাইন চালু করার এই ভাবনা জরুরি বলে মনে করেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী আগামী তিন মাসের মধ্যেই চালু করতে হবে এই বিশেষ হেল্পলাইন নম্বর। সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশে কতটা আশাবাদী শহরবাসী?
সুপ্রিম কোর্টের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন শিল্পী সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। সুজয়প্রসাদ বলেন, ‘‘‘মেয়েলি ছেলে’ বা ‘পুরুষালি মেয়ে’ তকমায় গেঁথে বাড়িতে, স্কুল-কলেজে কিংবা কর্মক্ষেত্রে রীতিমতো কোণঠাসা হন তাঁরা। বিভিন্ন সময় নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাঁদের। দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাঁদের বিবিধ সমস্যার সমাধানের জন্য হেল্পলাইন চালু করার কথা ভেবেছে, সেটা তো খুব ভাল উদ্যোগ। আশা করছি, এই হেল্পলাইন নম্বরে যে যে অভিযোগ জমা পড়বে, সেগুলির তৎক্ষণাৎ সমাধানের ব্যবস্থা নেবে রাজ্য সরকারগুলি। আগেও তো রাজ্যের পরিসরে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে রূপান্তরকামীরা কতটা সুফল পেয়েছেন, সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। আশা করছি, এই হেল্পলাইন নম্বরটির ক্ষেত্রে অন্তত এমনটা হবে না। রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার যৌথ ভাবে রূপান্তরকামীদের হিতে কাজ করবে।’’
সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রায় ১০ বছর ধরে কাজ করছেন অনুপ্রভা দাস মজুমদার। তিনি নিজেও একজন রূপান্তরিত নারী। অনুপ্রভা বলেন, ‘‘রূপান্তরকামীদের সমানাধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশনামাটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে মনে করছি। রূপান্তরকামীরা হয়রানি, মানহানি বা বৈষম্যের শিকার হলেও অনেক সময়েই তাঁরা থানা-পুলিশের জটিলতায় সরাসরি জড়াতে চান না। তখন এ ধরনের হেল্পলাইন নম্বরে যদি তাঁরা সমস্যার কথা নথিভুক্ত করতে পারেন এবং সেই হেল্পলাইন থেকে তাঁদের আইনি পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করা হয়, তা হলে তো তাঁরা অনেকটাই উপকৃত হবেন। এই পদক্ষেপগুলি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, রাষ্ট্র কেবল রূপান্তরকামীদের কথা ভাবছেই না, সমাজে তাঁরা যেন সঠিক মর্যাদা পান, সেই লক্ষ্যেও কাজ করছে।’’
রূপান্তরকামীদের জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ রাজ্য ও জাতীয় স্তরে এর আগেও নেওয়া হয়েছে। তাঁদের সমস্যার কথা ভেবে পশ্চিমবঙ্গেও তৈরি করা হয়েছে বোর্ড। তবে সেগুলির কোনওটিরই ফলাফল তেমন আশাজনক হয়নি। অনুপ্রভার মতে, রাজ্যে এর আগেও রূপান্তরকামীদের জন্য নির্দিষ্ট বোর্ড গঠন করা হয়েছে আর নানা রকম প্রকল্প ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে, তবে সেগুলি কতটা কাজ করছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। এ ক্ষেত্রেও, হেল্পলাইন শুরু হওয়ার পর কী ভাবে তারা কাজ করবে, রাজ্যের মুখ্যসচিবদের নিয়ে তৈরি বোর্ডের কাছে যে অভিযোগগুলি জমা পড়বে, সেগুলির সমাধান কী ভাবে হবে, কত দ্রুত ফলাফল পাবেন রূপন্তরকারীরা— সে সবই এখন দেখার। ফোনের ও পারে বসে যাঁরা রূপান্তরকামীদের সমস্যার কথা শুনবেন, তাঁরা এই বিষয়ে কতটা প্রশিক্ষিত হবেন, সেটাও কিন্তু ভাবার বিষয়। অনুপ্রভা বলেন, ‘‘কোনও রকম ভুল আচরণ কিন্তু যিনি সাহায্য চাইছেন, তাঁকে আবারও অবসাদে নিয়ে যেতে পারেন। এক জন রূপান্তরকামী মানুষের প্রতি মুহূর্তের সংগ্রাম কিন্তু একজন রূপান্তরকামীই সবচেয়ে ভাল বুঝতে পারেন। তাই এই সব হেল্পলাইনে সমস্যার কথা শোনার জন্য যদি রূপান্তরকামীদেরই নিয়োগ করা হয়, তা হলে কিন্তু বিষয়টি আরও ভাল হবে বলে আমার মনে হয়।’’
জেন্ডার অ্যাক্টিভিস্ট ও রাইটস কর্মী বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়ের মতে, সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিতে পারে, তবে সেই নির্দেশিকা কী ভাবে কার্যকর করা হবে, সেটা কিন্তু সরকারের হাতে। বাপ্পাদিত্য বলেন, ‘‘রূপান্তরকামীদের বিষয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারই এখনও বড় উদাসীন। দেশ জুড়ে এই প্রান্তিক মানুষদের পক্ষে রাজনৈতিক সদিচ্ছা তৈরি না হলে কিন্তু কোনও হেল্পলাইন, কোনও বোর্ড, কোনও সংগঠনই ঠিক ভাবে কাজ করতে পারবে না। রাজ্যে রূপান্তরিত মানুষদের তৈরি বোর্ডে তো বড় বড় মাথারা বসে আছেন, তবে সেই বোর্ড কী কাজ করছে, সেই খরব ক’জন রাখছেন। সুপ্রিম কোর্ট হেল্পলাইন চালু করার কথা বলেছে ঠিকই, কিন্তু তার ফলে রূপান্তরকামী মানুষদের জীবনে দ্রুত বড় বদল এসে যাবে, এ বিষয়ে আমি খুব একটা আশাবাদী হতে পারছি না।’’