Advertisement
E-Paper

গল্প আমি খুব খারাপ লিখতাম না: শতবর্ষে আর এক ঋত্বিক

সোজাসুজি নিজের কথাটা বলার জন্য ছোটগল্প লিখতেন ঋত্বিক। সিনেমাকে আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়ার ঢের আগে।

আশিস পাঠক

শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২৫ ১০:০৫
Remembering Ritwik Kumar Ghatak on his birth centenary as a short story writer

পরিচালক হওয়ার আগে কলমকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন ঋত্বিক। ছবি: সংগৃহীত।

“আধুনিক ইতিহাসের এক নতুন উজ্জ্বল অধ্যায়ের শুরু। গজালের তীক্ষ্ণ মুখটা হাতুড়ির এক আঘাতে নরম মাংস ভেদ করে ঢুকে যায় কাঠে। শেরওয়ানীর মনে হচ্ছে যেন আগুন ছুটছে এক এক আঘাতে। ঝলকে ঝলকে তীব্র ব্যথা হাত থেকে কাঁধে, কাঁধ থেকে সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে।”

গল্প ‘ভূস্বর্গ অচঞ্চল’, গল্পকার ঋত্বিক ঘটক। 'শেরওয়ানী' মকবুল শেরওয়ানি। কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্সের সদস্য, মুসলিম লিগের ঘোর বিরোধী মকবুল শেরওয়ানি। ১৯৪৭-এর অক্টোবরে পাখতুন আদিবাসী আর পাক সেনারা বারামুলা দখল করে তাঁকেই ধরেছিল শ্রীনগর পৌঁছনোর সোজা পাহাড়ি পথটা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। মকবুল তাঁদের ঘুরপথে নিয়ে গিয়ে সময় নিচ্ছিলেন, ভারতের ফৌজ আসার অপেক্ষায়। কাশ্মীরের রাজকীয় সরকারের সেনা তখন ধসে গিয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য বলেন শেরওয়ানি ভারতীয় সেনাকে অচেনা দুর্গম পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে মোটরবাইক খারাপ হল। সেটা সারানোর সময়েই পাকিস্তানি সেনার কবলে পড়েন।

প্রবল অত্যাচারের পরে পাকিস্তানি সেনার গুলিতে তাঁর মৃত্যুটা নিয়ে অবশ্য দ্বিমত নেই। কাশ্মীরে শহিদের সম্মান পেয়েছেন মকবুল। মুলকরাজ আনন্দ তাঁকে নিয়ে ইংরেজিতে উপন্যাস লিখলেন ১৯৬৮-তে, ‘ডেথ অফ আ হিরো: এপিটাফ ফর মকবুল শেরওয়ানি’।

Remembering Ritwik Kumar Ghatak on his birth centenary as a short story writer

সোজাসুজি নিজের কথাটা বলার জন্য ছোটগল্প লিখতেন ঋত্বিক। ছবি: সংগৃহীত।

সাড়া-জাগানো সে উপন্যাসের কুড়ি বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল ঋত্বিক ঘটকের গল্প, 'ভূস্বর্গ অচঞ্চল', নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘গল্পভারতী’ পত্রিকার একুশতম সংখ্যায়। সে গল্পের ভাঁজে ভাঁজে মকবুল-হত্যার টাটকা-স্মৃতি। আমাদের স্মৃতির ভাঁজে ভাঁজে, এই জন্মশতবর্ষেও, বইয়ের হলুদ পাতার মতো বিবর্ণ ঋত্বিকের সেই সোজাসাপ্টা ছোটগল্প। বা, গল্প হলেও সত্যি।

সত্যিই তো! সে-গল্পের প্রধান সব চরিত্র বাস্তব। মকবুল শেরওয়ানি বাস্তব, মহম্মদ আলি জিন্না বাস্তব। গল্পে এক জায়গায় পাকিস্তানি ক্যাপটেন যখন শেরওয়ানিকে জিজ্ঞাসা করেন, “কায়েদ-ই-আজম যখন বড়মুলায় আসেন বিশ্রাম করতে, তখন তুমিই তাঁর সভায় গোল পাকিয়েছিলে!” তখন, “মকবুল শেরওয়ানী খুব মিষ্টি করে হাসেন—“না মিঃ জিন্না যখন এসেছিলেন, তাঁর সভামঞ্চে উঠে তখন দুটো কথা বলেছিলাম মাত্র। শ্রীনগরে শেখসাহেবের সামনে তিনি বলেছিলেন, আমাদের রাজনীতিতে তিনি মাথা ঘামাবেন না। তারপরই কিন্তু মুসলিম কনফারেন্সের হয়ে নানা কথা বলেন অন্য সভায়। এখানেও সেই ব্যাপারই করতে যাচ্ছিলেন, অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছিলেন, তাই আর কি তাঁর সভায় উঠে দুটো কথা বলছিলাম। ফলে ভয় পেয়ে তিনি এখান থেকে খুব তাড়াতাড়ি চলে যান। ডোগরা সৈন্যদের সাহায্যও নিয়েছিলেন। তা, এখানকার দুষ্টু লোকেরা বলে থাকে— বড়মূলাই ভারতে একমাত্র স্থান, যেখান থেকে জিন্নাকে প্রাণ হাতে করে পালাতে হয়েছে।””

সোজাসুজি নিজের কথাটা বলার জন্য ছোটগল্প লিখতেন ঋত্বিক। সিনেমাকে আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়ার ঢের আগে। এমনকি, জীবনভর চাকরি-বিমুখ সেই বোহেমিয়ান লেখা নিয়েই বাঁচতে চেয়েছিলেন একদিন। সুরমা ঘটককে চিঠিতে লিখেছেন, “পার্টির দিকটি ভাবিনি। তেমন অবস্থার উদ্ভব হলে ভাবব, জনতার দিকটা ভেবেছি। আমার স্বাভাবিক ক্ষমতা ছিল লেখাতেই। তোমার মধ্যেও চাপা রয়েছে সে ক্ষমতা। এসো আমরা লেখাটাকে আঁকড়ে ধরি। লেখাকে ডেভেলপ করব, নাটক-উপন্যাস-গল্প, প্রবন্ধ, তার থেকে অর্থোপার্জনটা এখনই কিছু বিশেষ হবে না, দুটো বছর লাগবে।”

Remembering Ritwik Kumar Ghatak on his birth centenary as a short story writer

ঋত্বিকের গল্পের বেশ ক’টির পটভূমিও বাংলার বাইরের— দিল্লি, কাশ্মীর, মধ্যভারতের অরণ্যাস্তীর্ণ ভূভাগের এক কোলিয়ারি শহর বা অন্যত্র। ছবি: সংগৃহীত।

আঁকড়ে ধরেননি। কেনই বা ধরবেন! মাধ্যমের প্রতি, রূপের প্রতি তো কোনও মোহই ছিল না তাঁর কোনও দিন। আসলে তো চেয়েছিলেন মানুষের কথা বলতে। চেয়েছিলেন শিল্প হোক উন্মুক্ত প্রতিবাদ। নিজেই বলছেন, “চারপাশে যে সমস্ত বদমাইসি অত্যাচার ইত্যাদি দেখছি তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক জীব হিসাবে সোচ্চার প্রতিবাদ করার ইচ্ছে থেকেই গল্প লেখার আর্জ এসেছিল সেই ছোট বয়সেই। গল্প আমি খুব খারাপ লিখতাম না। আমার এখনো মনে আছে আমার আর সমরেশের প্রথম ছাপা গল্প বেরোয় ‘অগ্রণী’তে, তারপর সজনীবাবুর 'শনিবারের চিঠি', গল্পভারতী'— নৃপেন্দ্রকৃষ্ণবাবু তখন এডিটর, ‘দেশ’—সব মিলিয়ে আমার গোটা পঞ্চাশ গল্প বেরিয়েছিল।”

পঞ্চাশটা নয়, পনেরোটা মাত্র ছোটগল্প উদ্ধার করে প্রথম প্রকাশ করেছিল ঋত্বিক মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, আটত্রিশ বছর আগে, আজকের মতোই এক ঋত্বিক-জন্মদিনে। প্রতিটি গল্পের সঙ্গে ছাপা হয়েছিল ছবি। অলঙ্করণ নয়, গল্প থেকে আঁকা আলাদা ছবি। নিজেরা গল্প চেয়ে নিয়ে সে-সব এঁকেছিলেন গণেশ হালুই, খালেদ চৌধুরী, চিত্তপ্রসাদ, গণেশ পাইন, শ্যামল দত্তরায়, সোমনাথ হোড়ের মতো শিল্পীরা। ছিল ঋত্বিকের করা দু-একটা স্কেচও, নানা চিত্রনাট্য থেকে।

নিতান্ত ব্যর্থ হয়ে কবিতাকে ছুটি দিয়েছিলেন ঋত্বিক। নানা সাক্ষাৎকারে সাফ বলতেন, "বাঙালী ছেলেদের যা বাঁধা এবং ফরাসিদেরও যা হয় শুনেছি যে, ভেতরে একটা ক্রিয়েটিভ আর্জ দেখা দিলেই প্রথমে কবিতা বেরোয়, তা দু-চারটে অতি হতভাগা লেখা দিয়ে আমার শিল্পচর্চা শুরু হোল। তারপর আমি দেখলাম ওটা আমার হবে না। কাব্যির এক লক্ষ মাইলের মধ্যে আমি কোনদিন যেতে পারব না।"

সেই সময়ই ঢুকে পড়ছেন রাজনীতিতে। চারপাশে তখন দ্রুত বদল— যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলন। নাড়িতে ছটফটে-টান-লাগা সেই সময়ের তারেই ছোটগল্পকার ঋত্বিকের বিস্তার। ১৯৪৭-এ রাজশাহীতে 'অভিধারা' নামে পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন। দেশভাগের পরে এ শহরে এসেও চলল সে-ধারা। একটি-দু’টি সংখ্যা ছাড়া আজ অবশ্য তার সবই লোপ করে খেয়েছে বিস্মৃতি। কীট-নষ্ট হয়েছে 'পণ্ডিতমশাই' নামে ছোটগল্প, ১৯৬৫-তে লেখা।

‘আকাশগঙ্গার স্রোত ধরে’, ‘এজাহার’, ‘শিখা’, ‘এক্সট্যাসি’, ‘রূপকথা’, ‘রাজা’, ‘পরশপাথর’, ‘স্ফটিকপাত্র’, ‘চোখ’, ‘কমরেড’—যা আছে তার বেশির ভাগই ১৩৫৪ থেকে ১৩৫৭-র মধ্যে লেখা। তার মানে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০, সিনেমার ঋত্বিক তখনও দূর। সে সব গল্পের বেশ ক’টির পটভূমিও বাংলার বাইরের— দিল্লি, কাশ্মীর, মধ্যভারতের অরণ্যাস্তীর্ণ ভূভাগের এক কোলিয়ারি শহর…। ছেলেবেলা থেকেই বাড়ি থেকে পালানো কুড়ি-পেরোনো তরুণটির নিজের বিচিত্র জীবন তৈরি করছে গল্পবীজ। সুরমা ঘটকের স্মৃতি বলছে, “…বড়দা কানপুরে নিয়ে গিয়ে টেক্সটাইলে ভর্তি করে দেন। দুরন্ত ছেলেটি এখানে ছিলেন দুবছর। খুব আর্থিক দুর্গতির মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। সামান্য পয়সার ডাল রুটি খাওয়া ও মজুরদের সঙ্গে মেশার ও ওদের জীবনকে জানার অভিজ্ঞতা তখনই হয়। ছোটগল্প লেখার প্রাথমিক রসদ ঐ সমস্ত অভিজ্ঞতা। বিখ্যাত 'রাজা' গল্পটি ওখানকার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই লেখা। … 'রাজা' গল্পটি বিয়ের আগে আমাকে পড়ে শুনিয়েছিলেন। কাশীনাথ (গুণ্ডা) চরিত্রটির উল্লেখ আছে ঐ গল্পে। পরে একটি অর্দ্ধসমাপ্ত উপন্যাসেও ঐ চরিত্রটির বর্ণনা ছিল। অর্দ্ধসমাপ্ত উপন্যাসটি আমার কাছে ছিল। পরে উই নষ্ট করে দেয়।”

জীবনের শেষের দিকে উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলেন আর একটা, নিজের ছেলেবেলা নিয়ে। তার একটা ছকও করেছিলেন। লিখে যেতে পারেননি। তাঁর সেই অ-পার বাংলার ছেলেবেলার স্মৃতির মতোই যেন শেষ হয়েও অ-শেষ থেকে গিয়েছে ঋত্বিকের জীবন-গল্প। হারিয়েছে, নষ্ট হয়েছে তাঁর সেই আত্মবিশ্বাসী ছোটগল্পগুলি।

সে-সব হয়তো আর এক অচেনা ঋত্বিকের গল্প। হয়তো ভবেশরঞ্জন বাগচীর গল্প। তাঁর একেবারে প্রথম দিকের এজাহার গল্পের কথক তো ওই ভবেশরঞ্জন বাগচীই।

ঋত্বিকেরই তো ডাকনাম ছিল ভবা, বংশগত পদবি বাগচী, জানে তাঁর জীবন-আখ্যান।

Ritwik Ghatak Bengali Literature
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy