বছর পঞ্চাশ আগের এক ৭ ফেব্রুয়ারির সকাল। বেলা গড়ালেও রোদ তেমন ছিল না। পিজি হাসপাতালের গেটে গোটা তিনেক জটলা। অদূরে আকাশবাণীর সাংবাদিক সত্যজিৎ রায়কে কিছু জিজ্ঞেস করছেন। এমার্জেন্সি গেটের পাশে রাস্তায় বসে কাঁদছেন বিজনবাবু। মৃণাল সেনকে উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে। একটু পিছনে অনুপ কুমার। আস্তে আস্তে এগিয়ে আমি হিমঘরের দরজা পেরিয়ে তাঁর পায়ে হাত রাখলাম। কী ঠান্ডা! মনে হল, রাজা লিয়ার যেন অনন্ত প্রশান্তিতে অমরাবতীতে বিশ্রাম নিচ্ছেন। গার্সিয়া মার্কেস থাকলে বলতেন, ‘আ পিসফুল লুনাটিক ওয়াকস ইনটু দি ফিউচার’। আমরা এখানে অনধিকার প্রবেশকারী। কী রিক্ত, নির্জন সেই মৃত্যু! তাঁর মৃত শরীরটিকে যেমন তেমন করে বহন করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছিল একটি ম্যাটাডোর জাতীয় গাড়িতে। ভাগ্যিস যাদবপুরের ক’জন ছাত্র আর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন অনুরাগী বাধা দেয়! মুহূর্তে জনতার অবরোধ তৈরি হল। দৌড়ে এলেন মহাকরণ থেকে সে যুগের তথ্যমন্ত্রী। অবশেষে ফুলমালাশোভিত ঋত্বিক ঘটক লরিতে উঠলেন। অনতিকাল পরেই চিরপ্রণম্য অগ্নি শুদ্ধ করে নেবে। রাষ্ট্র ও মিডিয়া তোপধ্বনি করেনি। প্রায় নিঃশব্দে জ্বলে উঠেছে কারুকার্যময় বহ্নি, হা-হা চুল্লি: মঞ্চস্থ হয়েছে আলোর অপেরা। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার স্বাধীনতা আমৃত্যু বজায় রেখেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। শিল্পের সামান্য জয় তো এ রকমই চূড়ান্ত নির্বিকল্প, নিঃসঙ্গ স্বর্গাভিযানকামী। শিল্পীরা এ রকমই। সময়ের পাঁচিল টপকে উড়ে যাওয়া সন্ত্রস্ত দেবদূত।
১৯২৫-এর যে হেমন্তদিনে ঋত্বিককুমার ঘটক জন্ম নিচ্ছেন ঢাকায়, প্রায় তখনই সের্গেই আইজ়েনস্টাইন তাঁর কারুবাসনা ছড়িয়ে দিচ্ছেন মস্কো শহরে, যুদ্ধজাহাজ পটেমকিনের ফ্রেম থেকে ফ্রেমে। ঋত্বিক তা হলে ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’-এর সমবয়স্ক। তাই হয়তো ওডেসা সিঁড়ির বৃত্তান্তের মতোই তাঁরও জীবনবৃত্তান্তে রক্ত ও স্বপ্ন মিলেমিশে মৃত্যুকে ছলনা করে। নির্জন পথে জ্যোৎস্নালোকে সন্ন্যাসী একা যাত্রী। সঙ্গে মাত্র আটটি কাহিনিচিত্র, কয়েকটি তথ্যচিত্র, কিছু অসমাপ্ত ছবি। একদম একাকী হয়ে তিনি যাচ্ছেন চলচ্চিত্রের মতো নরকে, যেখানে টাকার ঋতু, টাকার আকাশ, টাকার সমুদ্র। যেখানে রূপসীর স্তনোচ্ছ্বাস, নির্বোধ কন্দর্পকুমার, সেখানে শিল্পের সময় কতটুকু? সিনেমা তো জন্মলগ্নেই জনপদবধূ বা কুরুরাজ সভায় দ্রৌপদী, তা হলে ঋত্বিক ঘটক সিনেমাকে কেন বেছে নিলেন আত্মপরীক্ষার জন্য?
তাঁর স্মরণসভায় সত্যজিৎ রায় নিজের তুলনায় ঋত্বিককে অধিকতর বাঙালি বলে চিহ্নিত করেন, তা কিন্তু মূল পর্যবেক্ষণ ছিল না। সত্যজিৎ যাতে সূচনা থেকেই অবাক হন যে, বাংলা ছবিতে তিনি-সুদ্ধ সবাই যখন কমবেশি হলিউড দ্বারা প্রভাবিত, ঋত্বিক সেই জলবায়ুতে পৃথক। তিনি বরং সোভিয়েট নির্বাক ছবির কিছুটা অনুগামী। বস্তুত চলচ্চিত্র-রচনার সাধারণ কোনও পদ্ধতির মধ্যেই ঋত্বিককে ধরা যায় না। যে জন্য তাঁর কোনও উত্তরাধিকার নেই। তাঁর ছাত্ররাও তাঁর নন্দনতাত্ত্বিক অপত্য নন। কোনও কোনও সময় তার কোনও কোনও শট অনুকৃত হয়েছে, যেমন পায়েল কাপাডিয়া ‘অল উই ইম্যাজিন অ্যাজ় লাইট’ ছবিতে ‘তিতাস’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ও ‘সুবর্ণরেখা’র উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন কম্পোজ়িশনে, কিন্তু তাকে ঋত্বিকতন্ত্র বলা যাবে না। পুণের বিখ্যাত ছাত্রদল তাঁকে কিংবদন্তি ভেবেছে, কিন্তু অনুসরণ করেননি। বাংলা ছবির তো প্রসঙ্গই ওঠে না। সত্যজিৎ রায় যেমন উত্তরপুরুষের নির্মাণে কখনও কখনও স্বাক্ষরিত থাকেন, ঋত্বিক শিল্পগত সত্যে এখনও একাকী, নিঃসন্তান। আজ আমি নিশ্চিত যে, ঋত্বিক চলচ্চিত্রকে প্রতিচিত্রণের গূঢ় মিনতি থেকে পরিত্রাণ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর ছবি আমাদের বিস্মিত করে বাস্তবে রক্তমাংস ছাড়িয়ে আত্মায় হাত রাখে বলে নয়, বরং তাঁর ছবি দেখার পর দৃশ্য অন্যতর প্রতিস্থাপনা দাবি করে বলেই ঋত্বিক দেখার পর পৃথিবীর অনেক দেখাই তাৎপর্যহীন মনে হয়, যেমন অধিকতর তাৎপর্যেরও মনে হয় আরও অনেক কিছু। কবিদের মতোই তিনি বাস্তবের আয়তন অক্ষুণ্ণ রেখেও বাস্তবের বিন্যাস পাল্টে দিতে পারেন। এই যে দেখার রকমফের, ব্যক্তিকে ইতিহাস ও নিসর্গের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার রাজনীতি, ঋত্বিক ঘটক তা শুধু আইজ়েনস্টাইন, বুনুয়েল বা ব্রেশটের থেকে আত্মসাৎ করেননি, তাঁকে পথ চিনিয়েছিল স্বদেশের উপলব্ধির ঐশ্বর্য— মূলত গান ও লোককথা। এক দিকে কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথ, অন্য দিকে অবনীন্দ্রনাথের ‘বুড়ো আংলা’ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর পাথেয় ছিল, ফলে সময়ের শরীরে সংলগ্ন থেকেও ঋত্বিক শুনে গেলেন দেশজ উপাখ্যান ও ইতিহাসের পরপার থেকে আসা সুরের প্রতিধ্বনি। কুরোসাওয়া নয়, একদা তিনি আমাকে সত্যিকারের জাপান, প্রাচ্য জাপানকে জানার জন্য মিজ়োগুচির ছবি দেখার পরামর্শ দেন। অথচ তাঁর এই গহন শিকড়-সন্ধান কোনও মতেই তাঁকে বাধা দেয় না আন্তর্জাতিক আধুনিকতার সঙ্গে সন্ধিপ্রস্তাব রচনায়।
আইজ়েনস্টাইন এক বার বলেছিলেন, এল গ্রেকোর শ্রেষ্ঠ প্রতিকৃতিসমূহ আসলে তাঁর ল্যান্ডস্কেপ। ঋত্বিক তাঁর চরিত্রবর্ণনায় নিসর্গকে অনেক সময়ই প্রাপ্যের অধিক গুরুত্ব দেন, যেমন ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ও ‘কোমল গান্ধার’-এ তা হয়ে দাঁড়ায় ‘সারপ্লাস অব আইকনোগ্রাফিক সাইনস’। এই রীতি কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার। আমাদের প্রধান ভুল প্রাপ্ত চলচ্চিত্রীয় মূল্যবোধের নিরিখে ঋত্বিকের ছবি দেখা। ফলে তাতে অনিয়মের রাজত্বই চোখে পড়ে, আর বার বারই মনে হয়, সমুদ্র যদি আর একটু শৃঙ্খলাপরায়ণ হত! বস্তুত ঋত্বিক ঘটকের কেন্দ্রীয় সমস্যা এক ধরনের চ্যুতি। এই ‘ডিসপ্লেসমেন্ট’ শুধু সচরাচর যেমন ভাবা হয়, উদ্বাস্তু সমস্যা, তা নয়। এই অপসারণ আসলে ‘আত্ম’চ্যুতি। মার্ক্স যার দার্শনিক নাম দেন ‘এলিয়েনেশন’। ‘সুবর্ণরেখা’য় প্রেসকর্মীর সেই বিখ্যাত প্রশ্ন ‘কে উদ্বাস্তু নয়?’ বরং আমাদের জানিয়ে দেয়, ঋত্বিক শুধু দেশভাগজনিত হিন্দু উদ্বাস্তুর কথা ভাবেননি, তিনি অনেক গহনে ভূমিক্ষয়ের সর্বনাশা রূপ চিনতে পেরেছিলেন। আজ যখন রাডক্লিফ রোয়েদাদ ছাড়িয়ে আলবেনিয়া মেক্সিকো গাজ়া শ্রীলঙ্কায় শুধুই বিসর্জনের বাজনা, তখন জীবনানন্দের বিলাপ মনে পড়ে, “দূরে কাছে কেবলি নগর, ঘর ভাঙ্গে/ গ্রাম পতনের শব্দ হয়...।” স্থানচ্যুতি, নির্বাসন, লুকিয়ে থাকা— তার চেয়েও এক জন ছিন্নমূল মানুষের আতঙ্ক হল দু’টি স্মৃতির মধ্যবর্তী শূন্যতার পরিসর, যার শিকড় নেই তার সাংস্কৃতিক ঠিকানা কী হবে? ঋত্বিক জানতে চেয়েছিলেন। তাই তাঁর ইমেজ, চিত্রে বা ধ্বনিতে কাহিনির বেড়াজাল ভাসিয়ে চলে যায় অনন্তের দিকে।
ঋত্বিকের কেন্দ্রীয় সমস্যা প্রকৃতই বাস্তবহীনতার ‘মেঘে ঢাকা তারা’ থেকেই এই সঙ্কটের একটি ভৌগোলিক বিগ্রহ রূপ পেতে শুরু করে। তবুঈষৎ ময়নাতদন্তই দেখিয়ে দেবে, ঋত্বিকের চরিত্ররা— যেমন আন্তোনিয়োনির চরিত্ররাও— কেউ গৃহস্থ নয়, তারা দেশভাগ-নিরপেক্ষ ভাবেই নষ্টনীড়। হয় গৃহচ্যুত, নয় তাদের বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ সমাসন্ন, নয় তারা পথচারী। তাঁর ‘নাগরিক’ ছবিটিতে আমরা দেখি ভ্রষ্টকুলায় মধ্যবিত্তের প্রস্থচ্ছেদ। প্রত্যক্ষ অর্থে তারা উচ্ছেদেরও শিকার। সবিস্ময়ে খেয়াল করি, শহরে যে দিন দুর্গাপ্রতিমার আগমন, সে দিনই এই উচ্ছেদ। দেবীর আগমন ও ভাড়াটের নিষ্ক্রমণকে এক বন্ধনীর মধ্যে জুড়ে দিয়েছেন, বৈপরীত্যের ঐক্য সমন্বয় করেছেন আইজ়েনস্টাইনের এই নবীন ছাত্র।
দ্বিতীয় ছবি ‘অযান্ত্রিক’-এও (১৯৫৮) মূল চরিত্র বিমলের গৃহ নেই, যা আছে তা খ্রিস্টান কবরখানার পাশে এক নড়বড়ে আস্তানা। যদিও দেশ-বিভাগ ও শরণার্থী সমস্যা ঋত্বিকের মূল অভিপ্রায় হয়ে ওঠেনি, তথাপি এই ছবিতেও উপস্থিত নষ্টনীড় মানবক ও গৃহপ্রবেশের আকাঙ্ক্ষা। ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ (১৯৫৯) থেকে তিনি ছিন্নমূল মানুষ ও দেশভাগের মনোবিপর্যয় দেখতে শুরু করেন।
সেখানে সাধারণ প্রতিপাদ্যই: হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনওখানে। নৈশ বিজ্ঞপ্তির মতো ঋত্বিক স্থানচ্যুতির ইতিবৃত্ত লিখে যাবেন; আজাদগড় কলোনি থেকে নবজীবন কলোনি, বাফারশট শিশুতীর্থ সবই এক নিরবচ্ছিন্ন যাত্রার সঙ্কলন। এমনকি শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ (১৯৭৪) শহর থেকে গ্রামে তাঁকে মহাপর্যটকের ভূমিকাতেই দেখায়। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ (১৯৭৩) তো পুরো একটি জনগোষ্ঠীর স্থানান্তর ও জীবনযাত্রা বিষয়ে মন্তব্য করে। সিন্ধু নদ গতিপথ পরিবর্তন করায় প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার পতন হয়, তিতাসের শুকিয়ে যাওয়ায় তিনি উপাখ্যানের পুনরাবৃত্তির সুযোগ পান। শেষ বিচারে তিনি নিশ্চিত ভাবেই এক চলচ্চিত্র-স্রষ্টা, কিন্তু বড় প্রেক্ষাপটে তাঁর ভূমিকা দার্শনিক ও ইতিহাসবিদের। ফেলিনির ‘লা দলচে ভিতা’ ও ঋত্বিকের ‘সুবর্ণরেখা’ (১৯৬২) পাশাপাশি সাজালে স্বচ্ছ হয়ে যায়, সিনেমার দুনিয়ায় তিনি কেন এমন একাকী।
দৃশ্যকলায় আধুনিকতার কথা ভাবতে আমাদের পর পর দু’টি প্রতিরূপায়ণের দ্বারস্থ হতেই হয়। প্রথমটি রেমব্র্যান্টের ‘রাতের পাহারা’ (১৬৪২), দ্বিতীয়টি ভিলাসকেথের ‘লাস মেনিনাস’ (১৬৫৬)। রেমব্রান্টের প্রতিকৃতি রচনা থেকে সরে এসেও এমন অস্বাভাবিকতার সংযোজন ঘটালেন যে, ওই পট হ্যামলেটের মতোই বিষয়-অতিরিক্ত ইতিহাস উন্মোচন করল। চিত্রপটে রক্ষী-দলকে দেখে আমরা হতবুদ্ধি হয়ে যাই যে, অদৃশ্য অপ্রত্যাশিত এক উদ্বেগ ছবির যথার্থ চরিত্র গঠন করেছে। প্রখর মধ্যদিনকে ওলন্দাজ সভ্যতার সুবর্ণদিনে রেমব্রান্ট রূপান্তরিত করেছেন এক অলৌকিক নিশীথিনীতে। কেন ওই পটস্থ বালিকা? কেন এই আপাত বিন্যাসহীন আশঙ্কা? অজস্র প্রশ্নের জবাবই নিরুত্তর থেকে, প্রকৃত দ্রষ্টার মতোই শিল্পী রেমব্রান্ট, স্বধর্মে অবিচল থেকে যথাযথ প্রতিচিত্রণ পরিত্যাগ করেন। এই ‘দেখা’ দ্রষ্টব্যের গোপনীয়তা হরণ করে। চোদ্দো বছর পরে স্পেনে ভিলাসকেথ রাজান্তঃপুরচারিকাদের ছবি আঁকেন, শিল্পের সমস্ত উপাদানের অনুপুঙ্খ নজরদারির সঙ্গে নিজেকেও অবলোকনের বিষয় করে তোলেন। মিশেল ফুকো এই ছবি প্রসঙ্গেই তাঁর ‘এপিস্টেম’ ধারণার প্রয়োগ করেন। তাঁর বক্তব্য, এখানে শিল্প ওই পটে ইতিহাসের চরিত্রকেও প্রতিফলিত করেছে। ‘কোমল গান্ধার’ ও ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’, দুই পর্বের এই আত্মজীবনী যে দ্রষ্টব্যের স্রষ্টাকেও নজরবন্দি করে, তা আধুনিকতার একটি পাঠ-প্রস্তাবনা।
অথচ একই সঙ্গে তিনি আঁকড়ে ধরেন দেশজ সংস্কৃতির বিভঙ্গ। পৌরাণিক উপাখ্যান থেকে রবীন্দ্রগান, লোকগীতি ও শব্দের বিচিত্র ও বহুবর্ণ বিন্যাস তাঁকে দেশজ সংস্কৃতির গহনে টেনে নিয়ে যায়। এক দিকে তিনি ‘বুড়ো বাংলা’ হতে চান সিনেমায়। ‘মন যেন অবন ঠাকুরের সেই সুবচনীর খোঁড়া হাঁসের পিঠে চেপে জয়যাত্রায় বেরোয়’। এক দিকে রবীন্দ্রনাথের ‘শকুন্তলা’ প্রবন্ধ, অন্য দিকে ‘টেমপেস্ট’ তাঁর পিছু ছাড়ে না। রামায়ণ থেকে গণনাট্য সঙ্ঘের প্রভাবে মার্ক্সবাদ, ছাত্রজীবনে পাঁচথুপি বেড়াতে গিয়ে বৌদ্ধ ভগ্নস্তূপে যোনিচক্রস্মৃতি, অন্য দিকে এরিক নিউম্যানের ‘দ্য গ্রেট মাদার: অ্যান অ্যানালিসিস অব দি আর্কিটাইপ’ বইটিকে বুভুক্ষুর মতো আত্মসাৎ করে নেওয়া। ১৯৫৫-য় ঋত্বিকের জীবন দুটি প্রবল অভিজ্ঞতার সংস্পর্শে আসে। প্রথমটি, ‘পথের পাঁচালী’। তিনি সপ্রশংস চিত্তে মেনে নিলেন, ভারতীয় ছবিতে অন্য রকম আখ্যানরীতি স্বীকৃত হল। তবু দ্বিতীয়টি আমার বিবেচনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নিউম্যানের সাহচর্যে তিনি কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং ও প্রত্নপ্রতিমার দিকে আকৃষ্ট হন। আশ্চর্য সমাপতন যে, ইটালিতে ফেলিনি-ও একই সময়ে ইয়ুং পড়া শুরু করেন। এক বার আমাদের যাদবপুরের ছাত্রদের, তিনি আইজ়েনস্টাইনের আরোহণ ও অবরোহণ, সাধারণ ও বিশেষ কী ভাবে বিন্যস্ত সংঘর্ষে বাস্তবতার উঁচু স্তরে চলে যায়, তা বুঝিয়েছিলেন। মিজ়োগুচির ‘উগেৎসু মনোগাতারি’-র (১৯৫৩) বিখ্যাত ট্র্যাকিং শটটি দেখেই আমি বুঝতে পারি, ঋত্বিক শুধু যা চাক্ষুষ করেন তাতে বিশ্বাসী নন। তিনি ক্যামেরায় দূরত্বের হেরফের করেন, তাঁর তাকানোর অবস্থানের তারতম্য আছে। এই দৃষ্টিপাত স্বর্গের নয়, মর্তেরও নয়, প্রায় অলীক ও অন্তরিক্ষচারী।
তাঁর একটি ছবি নিয়ে কারওই আপত্তি নেই। স্বয়ং সত্যজিৎ রায় এ ছবির ‘অ্যানথ্রোপোমরফিজ়ম’-এর প্রশস্তি করেন, এর সম্পাদনাকেও তিনি দৃষ্টান্তস্থল বলেই মনে করতেন। ‘অযান্ত্রিক’ ছবিটির কথা বলছি। কিন্তু আমরা খেয়াল করি না গাড়িটির ফ্রেমিং। তাকে পরীক্ষা করার সময় পরিচালক শুধু জগদ্দল নামক যানটিকেই দেখেন না, পুরোভূমি ও পশ্চাৎভূমি সংযুক্ত করেন। আজকাল কিয়ারোস্তামির ছবিতে স্পেস ব্যবহারের স্বাতন্ত্র্য আমাদের নজরে পড়ে। কিন্তু ঋত্বিককে পঞ্চাশের দশকের শেষে বুঝতেই পারিনি যে, কেন তিনি লং শটে গাড়িটিকে ধরেন এবং বার বার তারই বিপরীত সুরে ক্লোজ়-আপে ওঁরাও যৌবনের মূর্ছনা ধরে ফেলেন! এক বিরাট নিসর্গে ডাকবাংলোতে কিশোর সুলতানের হাতে জগদ্দল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঘুরপাক খেতে থাকলে সদ্য পলাতকা যুবতীটির নিষ্ঠুর হাসি ও বিমলের অসহায়তা যে কী সাঙ্কেতিক! মৃত্যু, সৌন্দর্য ও স্তব্ধতাকে ঋত্বিক এমন পরাযৌক্তিক মাত্রায় বেঁধে দিলেন যে, সে রহস্য অর্থাতীত হয়ে রইল। যেমন ‘নাগরিক’। আপাতভাবে ঋত্বিক নাট্যে দুর্বল হলেও আমরা বিস্মিত হই যে, দুপুরবেলা একটি লোহা পেটাইয়ের শব্দ কেমন করে মৃত্যুর ধাতব পদধ্বনিতে উত্তীর্ণ হয়।
‘অযান্ত্রিক’ গল্পে ওঁরাও উপজাতির কথা নেই। ঋত্বিকের কথকতায় তারা এত জোর পেল কেন? সমসাময়িক উন্নয়নের রাজনীতির দিকে তাকিয়ে অধীত মার্ক্সবাদ-এর প্ররোচনায় তিনি দায় নিয়েছিলেন সম্ভাব্য নতুন ইতিহাসের নুড়িপাথরগুলির পুনর্বিন্যাসে। যা ছিল সামান্য কাহিনি, তা হয়ে উঠল সন্দর্ভ। এই প্রবণতাকে পশ্চিমি আধুনিকতা দিয়ে বিচার করায় অপূর্ণতা থেকে যাবে। ঋত্বিক ওঁরাও উপজাতির জীবনযাত্রা শুধু এ কারণে খেয়াল করেননি, যে কারণে মূঢ় চেতনার বিকল্প হিসেবে গগ্যাঁ তাহিতি নারীর প্রতিকৃতি আঁকেন বা পিকাসো তাঁর পটে নিগ্রো মুখোশ জুড়ে দেন। ঋত্বিক সচেতন ছিলেন যে, তাঁর সমাজে ‘মুক্তধারা’ ও ‘রক্তকরবী’ লেখা হয়েছে, যন্ত্রযুগের অমানবিকতায় রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী কেউই প্রসন্ন নন। সুতরাং উপনিবেশ-উত্তরকালে যন্ত্র যে শুধু দানবী নয়, প্রেমিকাও হতে পারে, সেই প্রকল্পের উদ্বোধন কত দুরূহ! বয়ানটুকুর প্রাথমিক পরীক্ষায় ধরা পড়ে, বাঙালি ঋত্বিক পরিচিত ভূগোল থেকে সরে এসেছেন। গাঙ্গেয় পলিমাটির চেনা শ্যামলিমাকে প্রতিস্থাপিত করেছে রুক্ষ পাথুরে উপত্যকা। বিমল অস্বাভাবিক, কল্পনাপ্রবণ, অশান্ত মানচিত্রের বাইরে। সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আদিবাসী নৃত্যপর্যায় ‘বৈরাখী’, যা ইতিহাসের মাত্রামোচন। উইন্ডহ্যাম লুইস-এর আলোচনায় এলিয়টের কয়েকটি কথা এ প্রসঙ্গে মোটেই উপেক্ষণীয় নয়, “দি আর্টিস্ট, আই বিলিভ, ইজ় মোর প্রিমিটিভ, অ্যাজ় ওয়েল অ্যাজ় মোর সিভিলাইজ়ড, দ্যান হিজ় কনটেম্পোরারিজ়, হিজ় এক্সপিরিয়েন্স ইজ় ডিপার দ্যান সিভিলাইজ়েশন, অ্যান্ড হি ওনলি ইউজ়েস দ্য ফেনোমেনন অব সিভিলাইজ়েশন ইন এক্সপ্রেসিং ইট।”
চিরস্মরণীয়: ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০) ছবির একটি দৃশ্যে অনিল চট্টোপাধ্যায় ও সুপ্রিয়া দেবী।
শিল্পী ঋত্বিক কয়েক সহস্র বছরের স্তব্ধতার অন্তে ভারতবর্ষের ইতিহাসের সংযুক্তির একটি তত্ত্ব উস্কে দিচ্ছিলেন। আজ ‘আদিবাসী’ ও ‘গিরিজন’ নিয়ে সংসদীয় স্বার্থে অনেক কথা হয়, কিন্তু ঋত্বিক পঞ্চাশ দশকের ওঁরাওদের জীবন পড়ার জন্য, এমনকি তাঁদের ব্যবহৃত উপভাষাটিও অনুবাদ করতে চাননি। এ এক ধরনের সম্ভ্রমের অনুভূতি। যদিও ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ (১৯৬৯) ও ‘আগন্তুক’ (১৯৯১) ছবি দু’টির পাশাপাশি ‘অযান্ত্রিক’ দেখি তবেই বুঝব, ‘স্পেকট্যাকুলার’কে দৈনন্দিনতা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা আমাদের স্বভাবের ধর্ম হয়ে ওঠেনি আজও। ওঁরাও নৃত্য ও জগদ্দল— দুই-ই তাঁর কাছে উপলক্ষ, এমনকি রূপক। ইতিহাস, ধ্বনি, নিসর্গ ও কবিতার এই সর্বার্থসাধক অভিযান ভারতীয় চলচ্চিত্রের সম্পদ।
ঋত্বিকের দৃষ্টি যে অস্বাভাবিকতার স্বাভাবিক অনুবাদ, তা ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ দেখলে বিনা আয়াসেই ধরা পড়ে। তাঁর সাবজেক্টিভ ক্যামেরা এক্সট্রিম লো অ্যাঙ্গলে, কখনও হোয়াইট অ্যাঙ্গল লেন্সের সৌজন্যে এই দানবপুরীতে যে আকাশছোঁয়া অহঙ্কার দেখায়, তা কিন্তু বালক কাঞ্চনের দৃষ্টিতে। কাঞ্চন যখন কলকাতার ভূতলবাসীদের দেখা পায়, তখন তার মধ্যে নির্মিত ভয় ততটা নয়, যতটা নিষ্ঠুরতার প্রতি এক ধরনের অসহায় দৃষ্টিভঙ্গি। ক্ষণিকের জন্য হলে চকিত, অথচ স্থির লক্ষ্য। এক বিন্দু এই অমঙ্গল, স্বপ্নকে ইতিহাসের সমায়তন করে তোলে।
জনপরিসরে তাঁর একমাত্র সমাদৃত ছবি ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০)। এ ছবির বিষয়ে দাবি করা হয় যে তা বাস্তবধর্মী, আর গড়পড়তা মার্ক্সবাদী সে-যুগে বাস্তবতা বলতে যা বুঝতেন, তার একটি আদর্শ দৃষ্টান্ত। কিন্তু আমি দেখতে পাই, ঋত্বিক হিন্দু পৌরাণিকতাকে অন্তর্ঘাতের উপকরণ হিসেবে ভেবেছেন। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ যেমন রিফিউজি কলোনির আটপৌরে মেয়ের গল্প বলে, তেমন ভাবেই কালিদাস ‘কুমারসম্ভব’ বিভাজনোত্তর বাংলার ব্যর্থতা বিষয়ে মন্তব্য করে। কী বিচিত্র দৃশ্য পরিকল্পনা! প্রথম শট দেখে বোঝাই যায় না, পরিচালক কী বোঝাতে চাইছেন। ফ্রেমের প্রায় পুরোটাই একটি মহীরুহ। তার আড়াল থেকে যে আসছে, প্রায় অন্তিমে নজরে আসে, সে হয়তো কোনও নারী। দ্বিতীয় মিড-লং শটে আমরা একটি পূর্ণ যুবতীকে দেখতে পাই। এখানেও এই যুবতীটির সঙ্গে যে রেওয়াজ করছে, সেই যুবকটির দূরত্ব ও যুবকটির সঙ্গে চলমান ট্রেনের দূরত্ব সমানুপাতিক নয়। প্রশ্ন থাকে, এই দৃশ্যে জরুরি উপাদান ও গৌণ উপাদানসমূহ স্পষ্ট নয় কেন? তেমনই অন্তিম-পূর্ব, প্রায় লোককথায় পরিণত হওয়া সিকোয়েন্সে নায়িকা নীতাকে একেবারে ফ্রেমের দক্ষিণ কোণে বসিয়ে রাখা হয়। সমস্ত শট জুড়ে থাকে প্রকৃতি, এমনকি ‘দাদা আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম’ সংলাপটির পরে তিনি নীতার থেকে ক্যামেরা সরিয়ে নিয়ে নিরুপম একটি প্যান করেন। ক্যামেরা তীব্র ভাবে খেয়াল করে পাহাড় জঙ্গল ঝর্না উপত্যকা। আকাশ জুড়ে অপ্রত্যাশিত বিদ্যুৎবহ্নি অভিলাপ লিখে গেল। আমরা নীতাকে চিনতে পারলাম না।
বস্তুত ঋত্বিক প্রথম থেকেই নায়িকাকে অযোনিসম্ভূতা আদিমাতা হিসেবে দেখানোর পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। মৃত্যুমুহূর্তে সেই বিদায়কে তিনি চিহ্নিত করেন। দেবীর আগমন ও নিষ্ক্রমণের মধ্যে জুড়ে থাকে তুচ্ছ এক উদ্বাস্ত পল্লির আরও তুচ্ছ এক তরুণীর ব্যর্থ বাসনার চিত্রলেখ। ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ শীর্ষক রবীন্দ্রসঙ্গীত তো পুরোপুরি কুমারসম্ভবের একটি অধ্যায়। সমগ্র জীবননাট্যটিকে নৃশংসতার মঞ্চে রূপান্তরিত করতে তার উৎসাহের অন্ত নেই। গানের মধ্যে শুধু চাবুকের আওয়াজ নয়, শেষ মুহূর্তে আততায়ীর মতো দাদার আবির্ভাব, নার্সের সতর্কবাণী শুনেও বোনের সামনে তার শরীর বিষয়ে একটুও কুশলবার্তা না দিয়ে নিজেদের সুখের ইতিবৃত্ত— ঋত্বিক মেলোড্রামার সাধারণ শর্ত অস্বীকার করেন। হংসধ্বনিতে সাজিয়ে রাখেন দৈনন্দিনতা থেকে মহাকাব্যে উত্তরণের কারুকাজ। এই ছবিতেই আমরা প্রথম অনুমান করলাম, চলচ্চিত্রে শব্দপথ দৃশ্যপথের অনুগামী নয়, তাদের পর্যটন এক সহ-সমীকরণ। সিনেমায় স্তব্ধতা যে একমাত্র কোলাহলের বৃত্ত থেকেই উদ্ধার করা যায়, তা প্রতিটি ফ্রেমে মুদ্রিত থেকে যায় ঋত্বিকের ধ্বনির সুষমা ও সঙ্কটে, দূরত্ব ও নৈকট্যে। ক্যামেরা ও বিষয়ের দূরত্ব তিনি যে ভাবে বাড়িয়ে দেন, শব্দ ও দৃশ্য এত ভিন্নতায় বিচরণ করে যে, এই ছবির পরতে পরতে এক রকম সমালোচনামূলক প্রত্যাঘাত আছে, যা ঐতিহ্যধর্মী ধ্রুপদী আখ্যানের স্বচ্ছতা হরণ করে। এই চিত্রের শেষাংশে টেলিফোটো লেন্সে যা উদ্ধৃত হয়েছে, তা রোজনামচা নয়, ইতিহাসের পুনরুদ্ধার।
‘কোমল গান্ধার’ (১৯৬১) ভাষাগত স্তরে অর্থের নিশ্চলতা ও অবসান নয়, বরং উন্মোচন ও সম্প্রসারণশীলতা। এ দেশে সম্পন্ন প্রথম আদ্যন্ত চলচ্চিত্রায়িত প্রবন্ধ তা, আখ্যানের সীমানা মুক্ত করে দিয়েছে। গল্প অনুসরণ করার অভ্যাস ও সংস্কার এখানে এত বিমূঢ় বোধ করে যে ভৃগু ও অনসূয়া আমাদের কাছে প্রত্যাখানই পেতে থাকে। সংগঠন বা রূপক হিসেবে না ভেবে আমরা তাদের রক্তমাংসময় পেতে চাই; এই চাওয়া থেকে ঋত্বিক একটি আলেয়া আবিষ্কার করেন ও চলে যান অন্য কোনও মনীষার শিখরে। ঋত্বিকের ‘কোমল গান্ধার’ পুরোটাই প্রবন্ধপ্রতিম। বাস্তবধৃত বহু বিষয়সমন্বিত একটি জটিল নকশা প্রস্তুত করাই ছিল অভিপ্রেত। দ্বিধাবিভক্ত অনসূয়া তাঁর কাছে ইতিহাসের প্রস্তাবনা। বাঙালি আত্মপরিচয়ের উপাখ্যানে সে বাংলার মুখ। এই ছবি যেন ‘টিস্যু অব কোটেশনস’। সেই বিখ্যাত বাফার শট, যেখানে অবিস্মরণীয় বিয়োগচিহ্ন— সেই বিযুক্তির মধ্য দিয়েই ঋত্বিক প্রবেশ করেছেন চিন্তার ধর্মে। যখন ছবির শেষে করবন্ধনে স্থাপত্য প্রায় ভৃগু-অনসূয়া, তখন সংস্কৃত মন্ত্রের সঙ্গে মিলে যায় প্রাকৃত উলুধ্বনি। আমাদের সংস্কৃতির খণ্ডায়ন, আমাদের বিরহ ও আত্মচ্যুতি অগ্রসর হয় পূর্ণতার দিকে। ‘আইজ হইব সীতার বিয়া’— কত দিন কত দীর্ঘ যুগ ধরে আমাদের কৃষিকন্যাটি আকুল হয়ে ছিল এই কৌমার্যমোচনের জন্য! লক্ষণীয় এই ছবির মন্তাজ পদ্ধতিও। ঋত্বিক যাকে দ্বান্দ্বিক পন্থা বলতেন, এই ছবির যত্রতত্র তার দাগ লেগে। যেমন, ভার্টিক্যাল মন্তাজ যেখানে চিত্রের সঙ্গে ধারাবাহিক বিন্যাসে না থেকে সহবিন্যাসে আছে।
‘বীভৎস মজা’ কথাটি আজ বাঙালির নৈমিত্তিক শব্দভান্ডারে ঠাঁই পেয়েছে। কিন্তু কলকাতা থেকে ছাতিমপুরের দূরত্ব তাতে তিলমাত্র কমেনি। টেলিফোটো লেন্সে ধরা সীতার সেই মৃত চক্ষুর পর্দার বাইরে এসে আমাদের জড় অস্তিত্বকে সনাক্ত করে যায় অবিরত। ‘সুবর্ণরেখা’ (১৯৬২) হয়তো ভারতচরিতমানস। দেখতেই পাইনি, ছাতিমপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে যখন মরণোন্মুখ হতভাগিনীর মুখে হারিয়ে যাওয়া মায়ের পরিচয়পত্র খুঁজে পাওয়া যায়, তা যেন এই উপমহাদেশের ইতিহাসে চুল্লির প্রহর। এই মা কৌশল্যা কিন্তু ইক্ষ্বাকু বংশীয়া রাজমাতা নন, বাগদি বৌ। স্টেশন চত্বরে যে ছেলেকে আর্তনাদ করতে দেখি, যে অযোধ্যার রাজপুত্র নয়, অন্ত্যজ ও অনার্য। সুবর্ণরেখা নদীকে পাশে রেখে অশৌচের পরিধেয়তে যখন সে কনেবেশী সীতাকে সঙ্গী করে নেয়, তখন বোঝা যায় এক ‘অন্দর’ ইতিহাসের প্ররোচনায় ঋত্বিক নায়কের সিংহাসনে অন্ত্যজকে বরণ করে নিচ্ছেন। তখন বাঙালি মার্ক্সবাদীরা ইতিহাসের এই সাব-অল্টার্ন পাঠে অভ্যস্তই ছিলেন না। প্রজাতন্ত্র নয়, ছবির সূচনাতেই ২৬ জানুয়ারি জালিয়ানওয়ালাবাগ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু ঋত্বিকের প্রত্যাঘাত তো শুধু প্রত্যক্ষ রাজনীতির স্তরে নয়। তাঁর মূল উদ্দেশ্য কার্যকারণ সম্বলিত বাস্তবের বিস্তার নয়, বরং ইতিহাসের ‘অপর’ এক অবলোকন। ঋত্বিকের ইতিহাসবোধ কিন্তু ষাটের দশকের সূচনাতেও ‘এনলাইটনমেন্ট’-এর সরলতা মেনে নেয়নি। চালকলের ভিতরের সেই দৃশ্য, যেখানে গাগারিনের অভিকর্ষ অতিক্রমের ছাপা হেডিং ‘মানুষ চূর্ণিল যবে নিজে মর্ত্যসীমা’ উপহসিত হয় বয়লারের দাউদাউ আগুনে। পরবর্তী ডিজ়ল্ভ সীতার নিম্নবিত্ত কলোনিজীবনে ফিরে এলে মনে হয়, বিজ্ঞানের বিজয়বৈজয়ন্তী কি সত্যি পারে মনের সংস্কার ও অন্ধকারের পাঁচিল পেরোতে? বাস্তুহারা কলোনির নিতান্ত স্থানিক ও কালিক বিপর্যয়কে গান্ধী-প্রয়াণের মতো ইতিহাস পতনের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে ঋত্বিক আসলে অবতরণ করতে চান এক পুরাণকথার পৃথিবীতে, যেখানে বৃদ্ধটি টাইরেসিয়াস-এর মতো বিলাপোক্তি উচ্চারণ করে যায়। পত্রিকার টেলিপ্রিন্টারে ‘হে রাম’ যদি যদুবংশের ধ্বংসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পুনরুজ্জীবন পায় বেশ্যালয়ে, তবে প্রশ্ন জাগবেই, ‘হে রাম’ দ্বিতীয় বার কে বলেছিল? এই খেদ কোনও চরিত্রের মুখনিঃসৃত নয়। নায়িকার আত্মহত্যার পর পরিচালক যে গান্ধীর অন্তিম উচ্চারণকে দূরাগত ও নৈর্ব্যক্তিক ভাবে ব্যবহার করেন, তার কারণ তিনি সীতার অগ্নিপরীক্ষা বিষয়ক কাহিনিটিকে চালনা করেন অন্তর্ঘাতের দিকে। ইতিহাস যাকে ধারণ করেনি, এমন অতীত ও সাম্প্রতিকতাকে তিনি একটি গ্রন্থিতে জুড়ে দেন। সমস্ত আখ্যান সময়ের দুটি স্তরকে কাছে ডাকে। পরিত্যক্ত রানওয়েতে পরিপ্রেক্ষিত পাল্টে দিয়ে তিনি সীতার প্রভাতী সঙ্গীত নথিভুক্ত করেন। ক্যামেরা অদ্ভুত ভাবে সামনের জমি ও পিছনের জমি ছেড়ে রেখে সীতাকে এমন চিত্রপ্রতিমা হিসেবে গঠন করে যে, তরুণীটি চকিতে মীরাবাইয়ে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এক বৃদ্ধের দূরাগত সান্ত্বনাবাক্য মনে হয় আকাশবাণী যে, এই বালিকা বস্তুত সভ্যতার রূপক; জনকনন্দিনী সে, কৃষিকন্যা। রামায়ণ বা মহাভারতের উপাদান ব্যবহার করলেও ‘সুবর্ণরেখা’র গান ও কথা এতই মৌখিক লোক-আখ্যানের ট্যাপেস্ট্রি যে, ঔপনিবেশিকতার আড়ালে হারিয়ে যাওয়া কোনও গহন ধারাকে মুক্ত করা বরং তাঁর অভিপ্রেত। অতিশয়োক্তি ও সমাপতনের আড়ালে সুবর্ণরেখা শিল্প ও ইতিহাসের চুক্তিপত্র।
জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ যেমন এক নিভৃত অপরিচয়ের বাংলা আবিষ্কার করে, ঋত্বিকের ‘তিতাস’ তেমনই। নদীমাতৃক সভ্যতায় তিতাস নিজেই জীবন্ত কিংবদন্তি। তুচ্ছ মালো জীবনে যখন প্রেম আসে, যখন রুদ্রদেব মূর্ছিতা সতীকে ধারণ করে হাঁটতে শুরু করেন ধু-ধু চরে, তখন খাটো ধুতি পরিহিত কিরাতরূপী মালো যুবকের মিলনরজনীতে শ্বাস ঘন থেকে ঘনতর হয়ে আসে সাউন্ডট্র্যাকে। আছড়ে পড়ে ‘লীলাবালি লীলাবালি’ লোকগানটি, তখন আমাদের হাড়ে-মাংসে টের পাই অমার্জিত গ্রামবাংলার সৌরভ। মিজ়োগুচি যতটা জাপানের, ঋত্বিক ততটাই বঙ্গভূমির প্রাথমিক ভাষাপ্রস্তাব।
সিনেমার প্রতি স্তরে সম্পদের দারিদ্র। এই সম্পদ এতই ভয়াবহ যে, বিনিয়োগ ও বিপণন ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত স্রষ্টারই শ্বাসরোধ করে। ঋত্বিক গৃহীত হওয়ার পদ্ধতিটুকু প্রত্যাখ্যান করতে চাইছিলেন টালিগঞ্জের মদন তাঁতি হয়ে। ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’র শেষে তিনি মানিকবাবুর ‘শিল্পী’ গল্পটি বলেই লেন্সে মদ ঢেলে দেন। অথচ ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ মাতালের খোঁয়ারি নয়, সাংস্কৃতিক সমীক্ষা ও স্বীকারোক্তির সন্তান। মেট্রোপলিটন আত্মপ্রতারণা থেকে তিনি দূরে চলে যান। পথে পথে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে অবন ঠাকুরের ‘বুড়ো আংলা’ যেমন ছড়ানো জাজিমের মতো দেশ দেখে, ‘যুক্তি, তক্কো...’ তাঁকে সেই সুযোগ দিয়েছিল। লোকসংস্কৃতি আর নাগরিক সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব, মার্ক্সবাদী রাজনীতির প্রতি তাঁর অন্তিম জিজ্ঞাসা ও দ্বিধা তিনি অকপটে নিবেদন করে গেলেন মধ্যনিশীথের আলোচনাসভায়। নৈশ তর্কসভায় সমগ্র জীবন ও দর্শনের পূর্ণতা ও দীনতা নিয়ে তিনি জীবনকে জুয়াড়ির পালা হিসেবে ভাবছেন, আর একই সঙ্গে হিন্দু পুরাণের যমপুরী থেকে ফিরে আসা নচিকেতার সঙ্গে বাংলার প্রাণপ্রতিমা মিথুনে প্রবেশ করছে। পুনশ্চ তিনি শব্দকে দৃশ্যের আগে স্থাপিত করছেন। কী দুঃসাহস! চিন্তার কী রোমাঞ্চকর অভিযান! যিনি সারা জীবন দেশভাগ নিয়ে হাহাকার করে গেলেন, চূড়ান্ত আত্মসচেতনতায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় সভা-সমিতি এড়িয়ে দূরে থাকলেন, সময়ের কাছে সাক্ষী রইল ‘দুর্বারগতি পদ্মা’ নামক তথ্যচিত্র যেখানে ঋত্বিক স্বকণ্ঠে জীবনানন্দের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতাটির পাঠে।
সারা জীবনের তপস্যায় ঋত্বিক ঘটক ক্রমেই অনুধাবন করেছিলেন, জড় কিন্তু রূপগ্রস্ত বাস্তবের আলেয়া তাঁর নয়। তিনি যে বৌদ্ধশাস্ত্র থেকে শূন্যতা বা ‘এম্পটিনেস’-এর সঙ্গে অকিঞ্চায়তন বা ‘নাথিংনেস’-এর পার্থক্য বুঝতে পেরেছিলেন, তা-ই তাঁকে গৃহের সীমানা পেরিয়ে শেষ ছবিতে নিয়ে যায় পথে পথে, হয়তো বা প্রবাসেও। কী মৃদুস্বরে এক বার তিনি স্বগতোক্তির মতো ল্যান্সডাউন রোডের একটি ঘরে গুনগুন করেছিলেন, ‘মন যে দিল না সাড়া, তাই তুমি গৃহছাড়া/ নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে।’
আসলে তো ঋত্বিককুমার ঘটক উদ্বাস্তু নন। তিনি নির্বাসনকে বেছে নেন। আজ মনে হয়, শতবর্ষ পূর্তির ঈষৎ আগে আমাদেরও তো প্রত্যুত্তর দেওয়ার সময় হল যে, পরবাসী, চলে এসো ঘরে... অনুকূল সমীরণ না-ই বা থাকল!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)