‘প্রত্যয়’-এর আবাসিকেরা ঘুরলেন এক মণ্ডপ থেকে আর এক মণ্ডপ। —নিজস্ব চিত্র।
পুজোর সময়ে ঠাকুর দেখাই দস্তুর। কিন্তু কারও কারও কাছে অন্যের সেই ‘দস্তুর’ই ছকভাঙার গল্প হয়ে যায়। তেমনই এক ছক ভেঙে ঠাকুর দেখার গল্পের সাক্ষী রইল শুক্রবারের কলকাতা। ‘প্রত্যয়’-এর আবাসিকেরা নতুন পোশাক পরে দল বেঁধে ঘুরলেন এক মণ্ডপ থেকে আর এক মণ্ডপে।
‘প্রত্যয়’ হল বন্ডেল রোড এলাকার এক বাড়ি। সেখানেই থাকেন মনোরোগ থেকে সেরে ওঠা বহু আবাসিক। এর আগে বহু বছরই এঁদের সকলের কেটেছে শহরের বিভিন্ন মানসিক হাসপাতালে। পুজোয় ঠাকুর দেখা তো দূর, প্রিয়জনের মুখ দেখার অভ্যাসও চলে গিয়েছিল। গত বছর থেকে সেখানেই শুরু হয়েছে অভিনব এক উদ্যোগ। ষষ্ঠীর দিন মনো-সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়ের সঙ্গে সেই বাড়ির আবাসিকেরা বেরোন ঠাকুর দেখতে। নতুন জামা, পোলাও-মাংস, হইচইয়ে শুরু হয় পুজো।
শুক্রবার সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছিলেন ওঁরা। ‘প্রত্যয়’-এর প্রোজেক্ট ম্যানেজার অভিজিৎ রায় জানান, সকাল থেকেই সে বাড়িতে ছিল উত্তেজনা। বোসপুকুর, তালবাগান, একডালিয়া, সিংহী পার্কের মতো বিভিন্ন মণ্ডপে ঠাকুর দেখতে গিয়ে দারুণ আনন্দ করেছেন সকলেই। তার পর বাড়ি ফিরে হয়েছে উৎসবের ভোজ।
ষষ্ঠীর মেনু ছিল পোলাও, মুরগির মাংস আর চাটনি। পুজোয় প্রতি দিনই বিশেষ বিশেষ কোনও খাবার খাবেন ‘প্রত্যয়’-এর সকলে। সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে বলে জানালেন মনো-সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়। তিনি বলেন, ‘‘সুস্থ মনোরোগীদের সামাজিক পুনর্বাসনের উদ্যোগটার মূল উদ্দেশ্য শ্রমের বাজারে তাঁদের অন্তর্ভুক্তি। হাসপাতাল জীবনের অখণ্ড অবসরের পরে শ্রমের বাজারে প্রবেশ করাটা খানিক কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে সামাজিক পুনর্বাসনের দৃষ্টিভঙ্গিটা যদি তাঁদের তুলোয় মুড়ে না হোক, ভীষণই ঘেরাটোপের সংরক্ষিত জীবনে আগলে ও আটকে রাখা হয়। এই আগলানো আর আটকানোর ফরমানটা যাঁরা দেন, তাঁরা কিন্তু সেগুলি কার্যকরী করার দায়িত্ব নেন না। অন্য কারও উপর সেই দায়িত্ব বর্তায়। পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশ, সমাজ— যে যে ভাবে দেখেন। ফলে, সমাজ এবং রাষ্ট্র পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এই দায়িত্ব পালনের দায় নিয়ে একটা চাপানউতর, দর কষাকষি চলতে থাকে। এই দর কষাকষির বাইরে বেরিয়ে, আর একটা দেখা এ রকম যে, শুধু সুস্থ মনোরোগীরা নন, এমনকি চিকিৎসাধীন মনোরোগীদেরও সমাজে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টাকে শুধু শ্রমক্ষমতার মাপকাঠিতে দেখলে সুস্থ হওয়ার দায় গোটাটাই তাঁদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। তিনি যে সুস্থ ও কর্মক্ষম, তার প্রামাণ্যতার দায়টা তখন ব্যক্তির উপরে চলে আসে। ‘অঞ্জলি’ এই দায় চাপানো যে রাজনীতি, সেটার বিরোধিতা করে। বিনোদনেরও নিজস্ব রাজনীতি আছে। ধর্মীয় আচার মিলে থাকলে, তা তো আরও বেশি। সীমিত ক্ষমতার মধ্যে আমাদের তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ঈদ বা বড়দিন শুধু নয়, শিখ আবাসিক যাতে তাঁর ধর্মাচরণের সুযোগ পান, তাই এক জন শিখ আবাসিকের জন্যও গুরুদ্বারের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা আমরা আমাদের কাজ হিসাবেই দেখি। দুর্গোৎসব বাঙালির অন্যতম বড় উৎসব। বাজারের নিরিখেই তার ব্যাপকতা বাকি উৎসবগুলির থেকে অনেক বেশি। আর আজকের দিনে যখন উৎসবকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধর্মাচরণ দিয়ে মুড়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, উৎসব হিসাবেই তাকে দেখাটা একটা প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক অবস্থান। তাই দু’দিনে মোট দশটা বাসে, দুশোর বেশি চিকিৎসাধীন ও সুস্থ মনোরোগীকে নিয়ে পুজো প্যান্ডেল পরিক্রমা এই মানুষদের সামাজিক পুনর্বাসনের জরুরি শর্ত বলেই আমরা মনে করি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy