কালি-কলম-মন, লেখে তিনজন— এ কথার মর্মার্থ তাঁরাই বোঝেন, যাঁরা কিবোর্ডে নয়, সাদা কাগজের উপরে কালির আঁচড়ে মনের ভাব ব্যক্ত করেন এখনও। শহরে সম্প্রতি আয়োজিত হওয়া পেন মহোৎসবে উপচে পড়া ভিড় বুঝিয়ে দিল, কলমের প্রতি, লেখালিখির প্রতি ভালবাসা এখনও হারিয়ে যায়নি।
কলম ও তার বিবর্তন ধরে রাখে একটা আস্ত সময়কাল। এ দেশে স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে দেশজ উৎপাদনে জোর দিতে শুরু করেন গান্ধীজি। সেই সময়ে অন্ধ্রপ্রদেশের কারিগর কে ভি রত্নমের তৈরি পেন হয়ে ওঠে জাতীয়তাবাদের প্রতীক। রত্নম পেনসের এই কাহিনি শোনা গেল রাহুল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। পেন মহোৎসবে এসেছিলেন এই কলম সংগ্রাহক। হায়দরাবাদের চোরবাজার থেকে বা পারিবারিক সূত্রে পাওয়া বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য পেনে সমৃদ্ধ তাঁর সংগ্রহ। তবে তাঁর নিজের অন্যতম প্রিয় একটি পার্কার ভ্যাকিউম্যাটিক। চল্লিশের দশকে তৈরি সেলুলয়েডের পেন, যার নিবটা তৈরি ১৪ ক্যারটের সোনা দিয়ে।
‘‘আমাদের ছোটবেলায় বন্ধুদের মধ্যে যদি কারও পকেটে উইংসাং কিংবা হিরো পেন থাকত, আমাদের চোখে তার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যেত। কমবয়স থেকে তৈরি হওয়া পেনের প্রতি এই ভালবাসা আরও জোরালো হয়েছে দিনে দিনে,’’ বলছিলেন তিনি। একবার মাত্র দেড়শো টাকা দিয়ে চোরবাজার থেকে একটি সেলর কোম্পানির পেন কিনেছিলেন রাহুল। জাপানি পেন প্রস্তুতকারক ইউকিয়ো নাগাহারা এ দেশে এসে রাহুলের সংগ্রহে সেই পেন দেখে আবিষ্কার করেন, সেটি তাঁর বাবার ডিজ়াইন করা! ‘‘ওঁকে সেই পেনটা দিয়ে দিই। বদলে আমাকে একটা জাপানি সিডার উডের পেন উপহার দিয়েছিলেন নাগাহারা,’’ বললেন রাহুল।
এই সেলর কোম্পানির পত্তনের ইতিহাসেও জড়িয়ে রয়েছে বিশ্বযুদ্ধের গল্প। যুদ্ধধ্বস্ত জাপান যখন দেশজ উৎপাদনে জোর দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে, তখন পেন তৈরি করা শুরু করেছিল সেলর। পেন তৈরির উপকরণও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলেছে। প্লাস্টিক আবিষ্কারের আগের পর্বে পেন তৈরি হত এবোনাইট দিয়ে। ভালক্যানাইজ় রাবার দিয়ে তৈরি হত আদি যুগের ঝর্না কলম। পেনের নিব, তার কালির ব্যারেল কী উপকরণ দিয়ে তৈরি, সেই অনুযায়ী পেনের দাম ওঠানামা করে। পেন মহোৎসবে যেমন ১০০ টাকার ফাউন্টেন পেন থেকে দেড় লক্ষ টাকার পেনও রাখা ছিল। দেড় লক্ষের পেনটি মঁ ব্লাঁ-র, এ দেশে একটিই রয়েছে। ১৮ ক্যারটের হোয়াইট গোল্ড নিব, তাতে খোদাই করা অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সই। পেনের গায়ে খোদাই করা তাঁর হস্তাক্ষরে নানা ফর্মুলা, নোটসের অংশ, যা তুলে আনা হয়েছে বিজ্ঞানীর ডায়েরি থেকে। কাচের বাক্সে রাখা এই পেনটি দেখার জন্য ভিড় উপচে পড়েছিল মেলায়।
বছর চারেক আগে প্রসেনজিৎ গুছাইত ও সুব্রত দাস মিলে কালি-কলম নিয়ে এই আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ‘‘ফাউন্টেন পেন নিয়ে এই প্রজন্মের মধ্যে যাতে আগ্রহ তৈরি হয়, বিলুপ্তির পথে না চলে যায়, সেই চেষ্টাই করছি আমরা,’’ বলছিলেন প্রসেনজিৎ।
২১টি দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ড নিয়ে ছিল এ বারের পেন মহোৎসব। মেলায় কচিকাঁচা থেকে প্রবীণ— সব বয়সের মানুষই ছিলেন। সংগ্রাহকদের পাশাপাশি এসেছিলেন পেন প্রস্তুতকারক শিল্পীরাও। এল সুব্রহ্মণ্যম যেমন এসেছিলেন সুদূর চেন্নাই থেকে। কলকাতায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই মানুষটি নিজে পেন তৈরি করেন, বিক্রিও করেন। পরিষ্কার বাংলায় কথোপকথন চালিয়ে গেলেন ক্রেতাদের সঙ্গে। মেলায় ঢোকার মুখেই দেখা গেল ওয়াজ়িরের ডিভাইন কালেকশন। হিট ইমপ্রিন্ট টেকনোলজিতে কালো পেনের উপরে খোদাই করা দুর্গামূর্তি। জার্মান জোভো নিবের কালি থেকে বেরোচ্ছে তরতরে লেখা। এর কয়েকটি স্টল পরেই সাক্ষাৎ পাওয়া গেল দিলীপ বসাকের। দীর্ঘ সময় ধরে ভিনটেজ পেন সারাইয়ের কাজ করে আসছেন এই কারিগর। দেশ-বিদেশের বিত্তশালী ক্রেতা, সংগ্রাহকেরা পেনের পার্টস খারাপ হলেই সোজা কুরিয়ার করে দেন তাঁর ভবানীপুরের ঠিকানায়। পুরনো পেন সারিয়ে দেওয়ার পেশায় এসে হুমকিও পেতে হয়েছে তাঁকে। দিলীপ বলছিলেন, ‘‘লক্ষাধিক টাকার পেন যদি সারিয়ে দিই, তা হলে নতুন পেন চলবে কী করে? এই নিয়ে নামীদামি পেন কোম্পানির কাছ থেকে থ্রেট কলও পেয়েছি।”
তবে কলমের প্রতি ভালবাসা দমিয়ে রাখতে পারেনি এই কারিগর, সংগ্রাহকদের। রাহুল বলছিলেন এসপ্ল্যানেডের কাছে পেন হসপিটালের কথা, যেখানে খারাপ হয়ে যাওয়া পুরনো পেন এনে বহু বার সারিয়ে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। ইন্টারনেটের আগের যুগে কী ভাবে ডিলারদের ফোন নম্বর জোগাড় করে পেন সংগ্রহ করতেন, সেই গল্পও বলছিলেন।
ভাবপ্রকাশের মাধ্যম থেকে প্রতিবাদের অস্ত্র, পড়ুয়ার প্রয়োজন থেকে সংগ্রাহকের সন্ধান— কলমের প্রতি আকর্ষণ এখনও কমেনি। আইসিসিআর-এর পেন মহোৎসবের চতুর্থ বছর কলমকে ঘিরে এমনই নানা আবেগের সাক্ষী হয়ে রইল।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)