E-Paper

নহি যন্ত্র নহি যন্ত্র

শান্তিনিকেতনে ফিরে এসে নিজের মতো কাজ শুরু করেন শিল্পী। ফেলে দেওয়া কলকবজা, যন্ত্রপাতি দিয়েই তৈরি করতে শুরু করেন স্কাল্পচার।

নবনীতা দত্ত

শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০২৫ ০৭:৩৭
Sculptures with junks

শিল্পকর্ম ও ছবি:শিল্পী তমাল দাস

পুরনো মিটারবক্স, ফেলে রাখা সাইকেলের কলকবজা, লোহার কড়াই... যা কিছু এখন ব্রাত্যর তালিকায়, পড়ে থেকে থেকে যেন এক পাহাড় বর্জ্যের স্তূপ তৈরি করে ফেলে। কিন্তু সেই বর্জ্য ধাতু দিয়েই তৈরি করা যেতে পারে সুন্দর ভাস্কর্য। এতে ক্রমশ জং ধরা কলকবজাও প্রাণ ফিরে পেতে পারে শিল্পীর হাতের জাদুস্পর্শে। এমনই কিছু স্ক্র্যাপ মেটাল দিয়ে নানা অবয়ব, ভাস্কর্য তৈরির কাজ করে চলেছেন শিল্পী তমাল দাস।

জাপানি ভাষা থেকে শিল্পচর্চা

শিল্পসাধনা উদ্দেশ্য হলেও শিল্পপথে আসার শুরুটা অন্য ভাবে। তমালের পড়াশোনা বিশ্বভারতীতে, তবে তা শিল্প নিয়ে নয়। বরং জাপানি ভাষা নিয়ে। তমালের কথায়, “মন পড়ে থাকত কলাভবনে। চোখের সামনে ছিল রামকিঙ্কর বেজের কাজ। আর আমার বাড়ি বিশ্বভারতীর একদম কাছেই। ফলে বেশির ভাগ সময়ই কাটত ক্যাম্পাসে। কলাভবনের দাদা-দিদিদের কাজ দেখতাম মন দিয়ে। এ দিকে যখন জাপানি পড়ছি, তখন ওদের অক্ষরগুলো নিয়ে আরও কাজ শুরু করলাম। ওদের এক একটা অক্ষর লেখা অনেকটা আঁকার মতো। ফলে পুঁথিগত না হলেও, শিল্প শিক্ষা আমার সঙ্গেই ছিল।” এর পরে কাজের সূত্রে বেঙ্গালুরু চলে যান, সেখান থেকে দিল্লিতে কর্পোরেট চাকরির জগতে ঢুকে পড়েন তমাল। কিন্তু সেখানেও তাঁর মন বসছিল না। চাকরি ছেড়ে আবার ফিরে আসেন শান্তিনিকেতনে। শুরু হয় তাঁর নিজের নিরন্তর শিল্পসাধনা।

বর্জ্য ধাতুতেই প্রাণপ্রতিষ্ঠা

শান্তিনিকেতনে ফিরে এসে নিজের মতো কাজ শুরু করেন শিল্পী। ফেলে দেওয়া কলকবজা, যন্ত্রপাতি দিয়েই তৈরি করতে শুরু করেন স্কাল্পচার। তমালের কথায়, “বাড়ির অনেক লোহার জিনিসই পুরনো হলে বিক্রি করে দেয় মানুষ। সেগুলোই স্ক্র্যাপইয়ার্ড থেকে কিলো দরে কিনে এনে কাজে লাগাই। তবে সেই বর্জ্য ধাতুকে কোনও আকারে গড়ে তোলাও খুব সহজ নয়। তার জন্য চাই শৈল্পিক দৃষ্টি। কোন অংশটা কী ভাবে ব্যবহার করা যাবে, সেই বোধ থাকাও দরকার। অনেক সময়ে আবার কোনও মেটাল পিস দেখেই একটা অবয়ব ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তখন তা সম্পূর্ণ করতে বাকি অংশের খোঁজ চলে।”

এখানে যেমন আয়রন আর ব্রাশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে মা আর বাচ্চা কাঁকড়া। লোহার বাটির মতো পাত্রকে শেপ দিয়ে তৈরি হয়েছে কাঁকড়ার বডি আর সাইকেলের ডিস্ক অর্ধেক করে কেটে কাঁকড়ার দাঁড়া তৈরি করা হয়েছে। এর উপরে কিছু পিতলের চুড়ি ওয়েল্ডিং করে মাঝের অংশ গড়ে তোলা হয়েছে। প্রথম পোর্ট্রেটের মাথায় সাইকেলের চাকার অংশ ব্যবহার করা হয়েছে আর চোখের চশমা করা হয়েছে আঙুল দিয়ে কাঁচি ধরার জায়গাটা দিয়ে। দ্বিতীয় পোর্ট্রেটে আবার মুখের অংশ তৈরি হয়েছে একটা লোহার কড়াই ঢালাই করে তার পিছন দিকটা দিয়ে। আর মাথার পিছনে বাইকের ডিস্কব্রেকের হুইল অর্ধেক করে লাগানো হয়েছে। আবার পাখির ঠোঁটের অংশটা প্লায়ার্সের মুখ দিয়ে তৈরি। মাথাটা কলের অংশ দিয়ে বানানো হয়েছে।

শিল্পকর্ম ও ছবি:শিল্পী তমাল দাস

শিল্পকর্ম ও ছবি:শিল্পী তমাল দাস Sculptures with junks

তবে এই স্ক্র্যাপ মেটাল জোগাড় করেই কাজ শুরু করা যায় না। সেটা আগুনে পুড়িয়ে পরিষ্কার করে নিতে হয়। তার পর ওয়েল্ডিং মেশিনে কাজ থাকে। তমাল বললেন, “এই আর্টফর্মের মিডিয়াম খুব সোজা নয়। গাড়ির কলকবজার কাজ যাঁরা করতেন, প্রথম দিকে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁদের কাজ দেখতাম। গ্যারাজে ওঁরা কী ভাবে ওয়েল্ডিং করেন, কী ভাবে কাজটা তাড়াতাড়ি করা যায়, ছোট ছোট অনেক কিছুই ওঁদের কাছ থেকে শিখেছি।”

রিসাইকল-আপসাইকল

ইদানীং বর্জ্য রিসাইকলিংয়ের উপরে জোর দিচ্ছেন পরিবেশবিদরা। এখন বাচ্চাদের খেলনা তৈরির জন্য অনেক বিদেশি সংস্থাই স্ক্র্যাপ মেটাল ব্যবহার করছে কাঁচামাল হিসেবে। বাচ্চাদের খেলনা গাড়ি, রোবট সবই তৈরি হচ্ছে এই বর্জ্য ধাতু থেকে। আবার স্ক্র্যাপ মেটাল স্কাল্পচার এখন অন্দরসজ্জারও অন্যতম অঙ্গ হয়ে উঠেছে। বাইরের দেশেও স্ক্র্যাপ আর্টের ভাল বাজার রয়েছে। এ দেশের বিভিন্ন প্রদর্শনী ও হস্তশিল্প মেলাতেও এই ধরনের শিল্পসামগ্রীর চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে।

তমাল যেমন বললেন, “রাজ্য সরকারের আর্টিজ়ান কার্ড থাকায় আমি হস্তশিল্প মেলায় আমার তৈরি অনেক শিল্পসামগ্রী নিয়ে গিয়েছি। সেখানে আমার ৯০ শতাংশ স্কাল্পচারই বিক্রি হয়ে গিয়েছে। সারা দেশ জুড়ে এর মধ্যে ২৭টি প্রদর্শনীও করেছি। সেখানেও ভাল সাড়া পেয়েছি।”

আসলে বর্জ্য মানেই ফেলনা নয়। যেহেতু এগুলো নানা রকমের ধাতু, তাই এদের শেল্ফ-লাইফ কম নয়। হয়তো সেই জিনিসগুলোর কার্যকারিতা ফুরিয়ে গিয়েছে, কিন্তু চাইলে তার প্রাণশক্তি ফিরিয়ে আনা যায়। আর সেই কাজটাই একজন শিল্পীর।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Creations

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy