Advertisement
E-Paper

আজও রচিত হয় ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’! কারা বানান, কারাই বা শোনেন সেই সব গান?

গত বছর পাঁচেকে সমাজমাধ্যমের রমরমার সঙ্গে সঙ্গে তাল রেখে পল্লবিত হয়েছে ‘নতুন রবীন্দ্রসঙ্গীত’। কী সেই সব গান?

‘নতুন বাজার’ জানা আছে, ‘নতুন বৌ’ জানা আছে, কিন্তু ‘নতুন রবীন্দ্রসঙ্গীত’ ব্যাপারটা কেমন যেন ভৌতিক।

‘নতুন বাজার’ জানা আছে, ‘নতুন বৌ’ জানা আছে, কিন্তু ‘নতুন রবীন্দ্রসঙ্গীত’ ব্যাপারটা কেমন যেন ভৌতিক। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২৫ ০৮:৫১
Share
Save

এই মুহূর্তে বাজারে রবীন্দ্রনাথের ‘হেব্বি ডিম্যান্ড’। পাড়ার ঠেকে ঘনাদাতুল্য গিয়্যানি (পড়ুন ‘জ্ঞানী’) টিল্টুদা বললেন, “দরকার পড়লে প্ল্যানচেট করেও নামিয়ে আনা হচ্ছে।” রবি ঠাকুর নিজে প্ল্যানচেট করতেন জানা আছে, কিন্তু তাঁকেই যদি প্রেতচক্রে আহ্বান করা হতে থাকে, তবে চিন্তার বিষয়। এমনিতেই বাঙালির রবীন্দ্রনাথ বিনে গতি নেই। ঝালে-ঝোলে-অম্বলে-বিবাহে-অন্নপ্রাশনে মায় শ্মশানে পর্যন্ত তিনিই, তার পরেও আবার প্ল্যানচেটের কী দরকার, প্রশ্ন করায় টিল্টুদার দার্শনিক ঔদাসীন্য ভরা উক্তি— “গান। বাংলা বাজারে নতুন রবীন্দ্রসঙ্গীত হেব্বি খাচ্ছে। আর তাই…।” ‘নতুন বাজার’ জানা আছে, ‘নতুন বৌ’ জানা আছে, এমনকি পাড়ায় নতুন ভাড়া আসা পরিবারটির অষ্টাদশী ‘নতুন’ মেয়েটির আড়নয়ানে ঝিলিক হানার ব্যাপারটাও কমবেশি জানা আছে ঠেকের। কিন্তু ‘নতুন রবীন্দ্রসঙ্গীত’ ব্যাপারটা কেমন যেন ভৌতিক বলে মনে হল। বিশদ জানতে চাইলে টিল্টুদা মিচকি হাসলেন, সে হাসির কত শতাংশ মিচকেমির আর কত শতাংশ রহস্যের, বোঝা মুশকিল।

ঠেকের চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে যদি কান পাতা যায় (গহন বনের ধারে নয়, সমাজমাধ্যম বা ইউটিউবে), তা হলে দেখা যাবে, গত বছর পাঁচেকে সমাজমাধ্যমের রমরমার সঙ্গে সঙ্গে তাল রেখে পল্লবিত হয়েছে ‘নতুন রবীন্দ্রসঙ্গীত’। কয়েক বছর আগেও যেখানে র‌্যাপ রবীন্দ্রসঙ্গীত, রক রবীন্দ্রসঙ্গীত বা তারানা সমৃদ্ধ ধুম-তা-না-না রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে বিতর্কের চাপান-উতর চলত, মূলত বিশুদ্ধতাবাদী আর চলতি হাওয়ার পন্থীদের মধ্যে, সেখানে আপাতত রক্ষণশীলেরা হাওয়া। বরং নেটাগরিকদের একাংশ পঁচিশে বৈশাখ বা বাইশে শ্রাবণে পোস্টিয়ে চলেছেন ‘আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ’ (অবশ্যই রিমেক ভার্সনকে মনে রেখে), ‘আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে’, ‘আমি বাংলায় গান গাই’, ‘দেখো আলোয় আলোয় আকাশ’, ‘খোলো দ্বার বঁধুয়া’, ‘কবে তৃষিত এ মরু’ (সাম্প্রতিক সিনেমার দৌলতে)’, ‘ভালবেসে এত জ্বালা’ সেই সঙ্গে কবীর সুমনের বেশ কিছু গান ইত্যাদি ইত্যাদি। তা পোস্টান ক্ষেতি নেই, কিন্তু ওই দু’টি বিশেষ দিনে কেন? হেথায় হোথায় আবার সেগুলিকে সরাসরি ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ বলে দাবি করে বিস্তর গালমন্দ খান পোস্টদাতারা। তাতেও থামার লক্ষণ নেই। পুনঃ পুনঃ কামান গর্জনের মতো আবার ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ বলে সে সব গানের পিছন-সামনে দাগিয়ে দেওয়া চলে। কিন্তু কেন?

রবীন্দ্রসুরের অনুসারী বা রবীন্দ্রবাণীর অনুকরণ হলেই সে গান যে রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়, এটা বোঝার দায়িত্ব শ্রোতার নিজেরই।

রবীন্দ্রসুরের অনুসারী বা রবীন্দ্রবাণীর অনুকরণ হলেই সে গান যে রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়, এটা বোঝার দায়িত্ব শ্রোতার নিজেরই। ছবি: সংগৃহীত।

এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতে বসলে অনেকেই বলবেন, গানের বাণী এবং সুরের চলনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের আদল রয়েছে, তাই এই বুঝভুম্বুল। অথচ ‘আমার ভিতর বাহিরে’ বা ‘আমি বাংলায় গান গাই’-এর ক্ষেত্রে সে কথা কি খাটে? একটু তলিয়ে ভাবতে বসলে মনে হতে পারে, সম্প্রতি বাংলা গানের লিরিকের ছাঁদ থেকে খানিক দূরে অবস্থিত এই সব গান। তার উপর এদের বাণীর মধ্যে রয়েছে এক ধরনের পরিশীলনের ছাপ। এখানেই কি ভুলটা হচ্ছে? রবীন্দ্রসঙ্গীতে দীক্ষিত বা শিক্ষিত শ্রোতারা কখনওই নন, বঙ্গসমাজের খানিক প্রান্তিক অবস্থানের শ্রোতারাই এই কাণ্ডটি করে চলেছেন। শুধু যে সেই সব ‘প্রান্তজন’-ই এই কাণ্ড করছেন তা-ই নয়, ২০২৪-এর রবীন্দ্রজয়ন্তীতে এক অতিপরিচিত অভিনেত্রীও ‘আমার ভিতরে বাহিরে’ লিখে পোস্ট করেছিলেন। তার উপর সেই উদ্ধৃতির মধ্যেও ছিল একাধিক ভুল বানান। বাংলাদেশের প্রয়াত কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহের লেখা গানটি ঠিক কেন রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে পোস্ট হল, তা নিয়ে কম কটাক্ষ উড়ে বেড়ায়নি অভিনেত্রীকে লক্ষ্য করে।

সুতরাং যদি এ কথা ধরে নেওয়া হয় যে, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের এত বছর পরেও বঙ্গভূমিতে ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ রচনা অব্যাহত রয়েছে, তা হলে কি খুব ভুল বলা হবে? কেন রচিত হয় এমন গান? কী থাকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের চলন এবং বয়ানের অনুকরণের পিছনে? প্রশ্ন রাখা হয়েছিল সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্র এবং প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। একটা বিষয়ে দু’জনেই একমত যে, উপরে উল্লিখিত গানগুলির মধ্যে কয়েকটি সিনেমার গানও রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ‘পিরিয়ড পিস’ বা ‘রেট্রো’ নির্মাণের উদ্দেশ্যে এ ধরনের সুর ও বাণীর অবতারণা। কিন্তু ‘রেট্রো’ নির্মাণে রবীন্দ্রনাথই বা কেন? দেবজ্যোতির উত্তর, “রবীন্দ্রনাথের গান মানুষ ভালবাসে। সুরকারেরাও বাসেন। রবীন্দ্রনাথ আমাদের হেরিটেজ লাইব্রেরি। সেখান থেকেই খানিক বই ধার করে উদ্ধৃতি দেওয়ার মতো ঘটনা বলা যেতে পারে এই সব গানের নির্মাণকে।”

বাঙালির সুরসৃজনের প্রান্তিক স্টেশন সেই রবি ঠাকুরই।

বাঙালির সুরসৃজনের প্রান্তিক স্টেশন সেই রবি ঠাকুরই। ছবি: সংগৃহীত।

রেট্রো বা বিগত দিনের পটভূমিকায় সিনেমা বানাতে গেলে কেন সরাসরি রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার না করে, তার ছায়ায় লালিত সুরস্পর্শে বানানো গান প্রয়োগ করা হয়, বোঝা কঠিন। ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ছবির অন্তিম দৃশ্যে হাল্লার রাজার কণ্ঠনিঃসৃত সংলাপ— “রাজকন্যা কি কম পড়িতেছে?” মনে রেখেই যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত কি কম পড়ছে, তা হলে সত্যিই উত্তর মেলা কঠিন। কিন্তু একটু ছানবিন করলেই দেখা যায়, রবীন্দ্রগানের কপিরাইট উঠে যাওয়ার পর বাংলা ছবিতে (হিন্দিতেও, অমিতাভ বচ্চনের কণ্ঠে ‘কহানি’ ছবির ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ স্মর্তব্য) ব্যবহৃত হয়েছে। তার অনেকগুলিরই প্রয়োগ কতখানি ‘রাবীন্দ্রিক’, তা নিয়ে উস্কোখুস্কো বিতর্কও হয়েছে। কিন্তু মোটের উপর সেই প্রয়োগের আস্য একেবারে বিদায় নেয়নি। তার পরেও কেন রবীন্দ্রনাথের গানের কিসিমে নব্য রবীন্দ্রসঙ্গীত রচনার চেষ্টা? দেবজ্যোতির মতে, রবীন্দ্রনাথ একটা ঘরানার মতো। আজ মাইহার বা গ্বালিয়র ঘরানা থেকে খানিক সুর তুলে এনে কেউ যদি কোনও গানে প্রয়োগ করেন, তবে কী বলার আছে? রবীন্দ্রনাথের সুর তেমনই অনেকটা। তাই তাঁর সুরের অনুসরণ চললে, তাতে অন্যায় কোথায়? দেবজ্যোতি আরও মনে করিয়ে দিলেন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই তো বলে গিয়েছেন, তাঁর বিপুল সৃষ্টিকর্মের কোনও কিছু ভবিষ্যতে না থাকলেও বাঙালি তাঁর গান গাইবেই। এই ‘গান গাইবেই’-এর সূত্র ধরে যদি রবীন্দ্রানুসারী সুরসৃষ্টি ঘটতে থাকে, তাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার কিছু নেই।

দেবজ্যোতির ভাবনার সঙ্গে খানিক একমত রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী শ্রাবণী সেনও। শ্রাবণীর কথায়, “যে গানগুলিকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুসারী বা অনুগামী বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে, সেগুলি কিন্তু জনপ্রিয় হচ্ছে। হয়তো শ্রোতারা সেই গানগুলিতে রবীন্দ্রগানের অনুষঙ্গ খুঁজে পাচ্ছেন বলেই তা হিট করছে।” তবে প্রবুদ্ধ কথাপ্রসঙ্গে জানালেন, যাঁরা এই সব গানকে রবীন্দ্রসঙ্গীত বলে ভাবছেন বা ভুল করে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করছেন, তাঁদের ‘অশিক্ষা’ই মূলত দায়ী এর জন্য। প্রবুদ্ধের কথায়, “সুরস্রষ্টার এতে কিছু করার নেই। অনেক সময়েই সিনেমার চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে এমন গান রচনা করতে হয়, যার সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ছোঁয়া আছে। সেটাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত বলে মনে করা নেহাতই অশিক্ষা থেকে জাত।”

মুশকিল হল এখানেই যে, এ হেন ‘অশিক্ষা’র পরিমাণ যে বড় কম নয়, তা সমাজমাধ্যমের পাতা ওল্টালেই মালুম হয়। সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথের কোনও কোনও উদ্ধৃতির আগা-লেজা ছেঁটে তাঁকে ‘সাম্প্রদায়িক’ হিসাবে দেখানোর একটা ঢেউ দেখা গিয়েছে। এর বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন বিবুধ রবীন্দ্রচর্চাকারীরা। চাপান-উতর অব্যাহত। সমাজমাধ্যম কাজিয়ার ক্ষেত্র হতেই পারে, কিন্তু ভুলকে তো কোনও অর্থেই মেনে নেওয়া যায় না। যেমন মেনে নেওয়া যায় না অর্ধসত্যকেও। রবীন্দ্রসুরের অনুসারী বা রবীন্দ্রবাণীর অনুকরণ হলেই সে গান যে রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়, এটা বোঝার দায়িত্ব শ্রোতার নিজেরই। যদি তা না হয়, তবে ‘ভৌতিক’ রবীন্দ্রসঙ্গীত অব্যাহত থাকবে। বাজারের চাহিদায় রচিত হবে কিছু গান, আর কিছু গানকে তার পরিশীলিত শব্দচয়নের জন্য ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ আখ্যায় ভূষিত হয়ে সমাজমাধ্যমের পাতার শোভা বাড়াতে হবে। এ রকম পরিস্থিতিতে পাড়ার ঠেক থেকে ভেসে আসা টিল্টুদার হাসির রেশটুকু মনে রেখেই বলা যায়, এই সব পোস্ট দেখে অর্ধেক মিচকেমি আর বাকিটা রহস্যমাখা চোখে তাকিয়ে মোবাইল স্ক্রল করে বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া আর পথ থাকে না।

Rabindrasangeet Rabindra nath Tagore Bengali Culture music

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}