পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে পর্যুদস্ত হয়েছেন নবাব সিরাজউদদৌলা। বাংলার ভাগ্য পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে শহর কলকাতা জুড়ে ব্রিটিশদের উৎসব শুরু হয়েছে। উত্তর কলকাতায় সেই উদ্যাপনের অংশ হিসেবে রাজা নবকৃষ্ণ দেব ঠিক করলেন বাড়িতে দুর্গাপুজো করবেন। সেই মতো তৈরি হল ঠাকুরদালান। প্রজাদের প্রস্তুতি তুঙ্গে। ১৭৫৭ সালে শুরু হল পুজো। পারিবারিক ইতিহাস বলে, প্রথম বছর পুজোয় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ। সময়ের সঙ্গে শহরের বাবু সম্প্রদায় এবং ইংরেজ রাজপুরুষদের আনোগানাও বাড়ির পুজোয় বাড়তে থাকে। এই পুজো থেকেই পরিবারে দ্বিতীয় একটি পুজোর সূত্রপাত ঘটে। সেই ইতিহাস আকর্ষণীয়।
আরও পড়ুন:
৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত নবকৃষ্ণ ছিলেন নিঃসন্তান। তাই তিনি নিজের ভাইয়ের ছেলে গোপীমোহন দেবকে দত্তক নিলেন। তাঁকেই রাজা তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দান করলেন। কিন্তু তার পর নবকৃষ্ণের নিজের ছেলে রাজকৃষ্ণ দেবের জন্ম হয়। রাজকৃষ্ণকে রাজা অবশিষ্ট জমিদারি দান করলেন এবং রাস্তার বিপরীতে আরও একটি প্রাসাদ নির্মাণ করালেন। সেই বাড়িতে ১৭৮৯ সাল থেকে দুর্গাপুজো শুরু হয়। নবকৃষ্ণের বাড়ির পুজো কালক্রমে ‘বড় তরফের’ এবং রাজকৃষ্ণের বাড়ির পুজো ‘ছোট তরফের’ বলে এলাকায় জনপ্রিয় হয়।
পুজোর দিনে শোভাবাজার রাজবাড়ি প্রাঙ্গণ। ছবি: সংগৃহীত।
শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিমা দু'টি একচালার। ডাকের সাজে সুসজ্জিতা। এক সময়ে জার্মানি থেকে রুপোর সাজ ঠাকুরের জন্য আনানো হত। এখন আর তা হয় না। তবে ডাকে সাজ আসত বলেই তা থেকে ‘ডাকের সাজ’ শব্দবন্ধের সূত্রপাত। এখনও সেই রীতি মেনে দেবী ও দুই কন্যার সাজে থাকে রুপোলি রাংতার প্রাধান্য। গণেশ ও কার্তিকের পরনে যোদ্ধার বেশ। এই পরিবারে দেবীর বোধন হয় কৃষ্ণা নবমীতে। বড় তরফের ঠাকুরের সিংহের মুখ ঘোটক আকৃতির। পরিবারের পুরুষ এবং মহিলারা পুজোর উদ্যোগে শামিল হলেও মূল আচার বা রীতিতে অংশ নেন না।
দেব পরিবার বৈষ্ণব। তাই দুর্গাপুজোর সময়ে কুলবিগ্রহ গোপীনাথ দোতলার ঘরে উঠে যান। পুজোর সময়ে অন্নভোগের চল নেই। বাড়িতে পুজোর দিনে ভিয়েন বসে। সেখানে ঠাকুরের জন্য তৈরি হয় বিভিন্ন রকমের ভাজা এবং শুকনো খাবার। তার মধ্যে সিঙাড়া, কচুরি, গজা, নিমকি, জিলিপি, পান্তুয়া অন্যতম। উল্লেখ্য, ভোগ হিসেবে এই খাবার দর্শনার্থীরাও কিনতে পারেন।
শোভাবাজার রাজবাড়িতে চলছে সন্ধিপুজো। ছবি: সংগৃহীত।
ইতিহাস বলে, ১৯৪৭ সাল থেকে যষ্ঠীর সকালে পারিবারিক উদ্যোগে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’র আদলে নিজস্ব চিত্রনাট্যে ‘দেবীবন্দনা’ সম্প্রচারিত হত, যা মাইকে এলাকার বাসিন্দারা শুনতেন। একটানা ২১ বছর চলেছিল সেই রীতি। পরিবারের তরফে কৃষ্ণ শর্বরী দাশগুপ্ত বললেন, ‘‘কয়েক বছর আগেও এই অনুষ্ঠানটি আবার শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু কোনও কারণে তা আর বাস্তবায়িত হয়নি।’’
বড় তরফের পুজোয় পশুবলির রীতি ছিল। কিন্তু শোনা যায়, সেই প্রথা বন্ধ করেছিলেন গোপীমোহনের পুত্র রাধাকান্ত। বলির আগে ভীত ছাগশিশু রাধাকান্তের পায়ের নীচে আশ্রয় নিল। তিনি জানালেন, বাড়িতে আশ্রিতকে তিনি হত্যা করতে পারবেন না। সেই সময়ে শাস্ত্রকার এবং পণ্ডিতেরা বিষয়টির প্রবল বিরোধিতা করলেও রাজার সিদ্ধান্তের কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। ছোট তরফে সাম্প্রতিক অতীতেও পশুবলি প্রথার চল ছিল। অবশেষে ২০২০ সাল থেকে তা বন্ধ হয়েছে।
পারিবারিক রীতি অনুসারে দুই নৌকায় দেবীর বিসর্জন হয়। ছবি: সংগৃহীত।
এক সময়ে শোভাবাজার রাজবাড়িতে সন্ধিপুজোর সূচনালগ্নে কামান দাগা হত। কৃষ্ণ শর্বরীর মতে, তখন শহরে পুজোর সংখ্যা কম ছিল। শোভাবাজারের তোপধ্বনিতে অন্যান্য পুজোয় পুরোহিতেরা সন্ধিপুজো শুরু করতেন। পুজো উপলক্ষে দুর্গামণ্ডপের বিপরীতে বাইজি নাচের রীতিও জনপ্রিয় ছিল। কালক্রমে তার পরিবর্তে দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য নাটক এবং যাত্রাপালা শুরু হয়। কালের নিয়মে এখন সে-সবও বন্ধ হয়েছে।
অতীতে শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোয় দশমীর দিন নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর চল ছিল। কিন্তু এখন তার পরিবর্তে মাটির তৈরি পাখি ব্যবহার করা হয়। লরি নয়, বেহারাদের কাঁধে প্রতিমা গঙ্গা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। দুই নৌকার মাঝে কাঠামোর বাঁশ কাটার পর জলে দেবীর বিসর্জন হয়। কালের নিয়মে বহু রীতি অবলুপ্ত হয়েছে। বদলেছে পুজোর আচার। তবে শোভাবাজার রাজবাড়ির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ধুলো জমেনি।