Advertisement
১১ নভেম্বর ২০২৪
Children Care

পরিবেশের সঙ্গে পাল্টাচ্ছে শিশুর ব্যবহারও

কেন ছোটদের মধ্যে বাড়ছে হিংসা, প্রতিশোধস্পৃহা?

— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:১২
Share: Save:

ছোটবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে ‘আড়ি আড়ি, ভাব ভাব’-এর পর্ব কে না পেরিয়ে এসেছে? এই ঝগড়া, তো দু’দিন পরেই ফের গলা জড়িয়ে খেলতে যাওয়া, টিফিন ভাগ করে খাওয়া— এই আলোছায়া মাখা দিনগুলোই তো ছোটবেলার সম্পদ। কিন্তু সেই নিষ্পাপ বন্ধুবেলা কি এখনও তেমনই অক্ষত আছে? না কি সময়ের সঙ্গে, পারিপার্শ্বিকতার চাপে, প্রতিনিয়ত হিংসার সামনে দাঁড়িয়ে সেই অমলিন পর্বটির গায়েও লেগেছে দাগছোপ? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। কারণ বাস্তব বলছে, শিশুদের ভিতর এখন হিংসার প্রকাশ, প্রতিশোধস্পৃহা যে ভাবে বেড়েছে, তেমনটা আগে বড় একটা দেখা যায়নি। অস্বাভাবিকও নয়, এখনকার প্রজন্ম অনেক বেশি জটিল পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে। টিভির পর্দায়, ভিডিয়ো গেমের জগতে, বাস্তব জীবনে তারা অনেক বেশি ‘ভায়োলেন্স’-এর সম্মুখীন। এরা এক সময় প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠবে। তখনকার পরিস্থিতি সামলাতে আমরা আদৌ তৈরি তো?

স্কুলের অন্দরে

যোধপুর পার্ক বয়েজ় স্কুলের প্রধান শিক্ষক অমিত সেন মজুমদার তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে বলছিলেন, উঁচু ক্লাসের পড়ুয়াদের মধ্যে হিংসাত্মক আচরণ প্রায়ই প্রকাশ পায়। এমনও দেখা গিয়েছে— স্কুলে ছেলেরা নিজেদের মধ্যে মারপিট করতে গিয়ে বেঞ্চ ভেঙে ফেলেছে, এক ছাত্র তার সহপাঠীকে ব্ল্যাকবোর্ডের উপর এমন ভাবে আছড়ে ফেলেছে যে ব্ল্যাকবোর্ড ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। এর জন্য তাঁদের স্কুলেই পড়ুয়াদের মেডিটেশনের ব্যবস্থা করা হয়, কখনও সংশ্লিষ্ট ছাত্রের অভিভাবককে ডেকে কাউন্সেলিং করা হয়। স্কুলে তাঁরা জেন্ডার ইকোয়ালিটি নিয়ে ওয়ার্কশপের আয়োজন করেন। ক্লাসে কোনও দুর্বল, নরম প্রকৃতির ছাত্রকে অন্যরা উত্যক্ত করলে, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শিক্ষক জানালেন, স্কুলের উঁচু ক্লাসের দেওয়ালগুলির রং তাঁরা সচেতন ভাবে গোলাপি করেছেন, যাতে গোলাপি মেয়েদের রং— এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে ছাত্ররা বেরিয়ে আসতে পারে। পড়ুয়াদের মধ্যে হিংসাত্মক মনোভাব বৃদ্ধির কারণ হিসেবে মোবাইলের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারকে দায়ী করছেন অমিত সেন মজুমদার। তাঁর পরামর্শ, শুধুমাত্র পড়ার প্রয়োজনটুকু বাদ দিয়ে ছোটদের হাতে মোবাইল দেওয়া যাবে না। জরুরি অভিভাবকের কড়া নজরদারি। সন্তানকে পড়াতে বসে তাঁরাও মোবাইল দেখবেন না। একই ভাবে শিক্ষক ক্লাসরুমে মোবাইল ব্যবহার করবেন না।

বাড়ির পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ

শিশুর মানসিক গঠনের প্রথম ধাপ তৈরি হয় বাড়ি থেকেই। তাই সতর্ক থাকতে হবে অভিভাবককেও। মডার্ন হাই স্কুলের ডিরেক্টর দেবী কর বলছিলেন, ‘‘বুলি করার রেওয়াজ আগেও ছিল। এ ক্ষেত্রে আমরা একদম ছোট বয়স থেকে ছড়ার মাধ্যমে শেখাই কোনটা বলা বা করা উচিত, কোনটা নয়। আমাদের স্কুলে ‘বুলিইং পলিসি’ আছে। অনেক সময়ে দেখা যায়, যে পড়ুয়া বারবার বুলি করছে, সে নিজেও হয়তো বাড়িতে বা অন্য কোথাও এর শিকার হচ্ছে।’’ মনে রাখতে হবে, ছোটরা যা দেখে-শোনে, সেটাই অনুকরণ করে। যদি সে অনবরত ভায়োলেন্স দেখে, সেটার প্রভাব তার মধ্যেও পড়বে। সংবাদমাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন হিংসাত্মক, ঘৃণ্য ঘটনার কথা উঠে আসে। সেগুলো অনেক সময়েই শিশুমনের উপযোগী হয় না। তাই এই ধরনের খবর তাদের সরাসরি পড়তে বা দেখতে দেওয়া উচিত নয়, পরামর্শ দেবী করের। তাঁর কথায়, ‘‘বিষয়গুলো ওদের মতো করে বুঝিয়ে দিতে হবে। ইংরেজিতে ছোটদের উপযোগী কিছু খবরের কাগজ আছে, সেগুলো পড়তে উৎসাহ দিতে হবে। ছোটদের শাসনের ক্ষেত্রে মা-বাবাকে একটা ভারসাম্য রাখতে হবে। কম শাসনও যেমন ভাল নয়, বেশি শাসনও উচিত নয়।’’

— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

কেন এই আচরণ

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবীর মুখোপাধ্যায় শিশুদের এই আচরণের পিছনে দু’ধরনের কারণকে দায়ী করেছেন— জিনগত এবং পরিবেশগত। কিছু শিশু জন্ম থেকেই একগুঁয়ে, জেদি হয়। হয়তো শিশুটি তার পরিবারের কারও কাছ থেকে জন্মসূত্রে এই আচরণ পেয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় জন্মের পর তার চার পাশের প্রভাব। ‘‘সে যদি সুন্দর ভারসাম্যযুক্ত একটি পরিবারের সকলের মধ্যে বেড়ে ওঠে, তা হলে পরবর্তী কালে তার সেই ‘অপোজ়িশনাল ডিফায়েন্স ডিজ়র্ডার’ অনেকাংশে পরিবর্তিত হতে পারে। তবে অনেক সময়ে মানসিক রোগের কারণেও উগ্রতা বৃদ্ধি পায়। সে ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে,’’ বললেন ডা. মুখোপাধ্যায়।

অন্য দিকে, বর্তমান সমাজে হিংসা, উগ্রতা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। মানুষের ধৈর্য, সময় কমেছে। অনেক পরিবারেই মা-বাবা দু’জনেই কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে, সন্তানকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারেন না। অবসর সময়টুকুতেও তাঁরা মোবাইলে মগ্ন থাকেন। পরিবারের সকলে মিলে একসঙ্গে সময় কাটানোর চল প্রায় উঠেই গিয়েছে। এর প্রভাব শিশুটির উপর পড়ে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পড়াশোনা নিয়ে শিশুটিকে অত্যধিক চাপ দেওয়া। তবে শুধু অভিভাবক নয়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজও এর জন্য দায়ী। এখানে এখনও ‘অল্টারনেটিভ ওয়েজ় অব লার্নিং’ স্বীকৃত নয়। ফলে সমাজের চোখে পরীক্ষার পড়াটাই সব। এর জন্য শিশুকে তার ভাললাগার অন্য বিষয় যেমন, খেলা, নাচ, গান, আঁকা... বিসর্জন দিতে হয়। স্বাভাবিক ভাবেই শিশু বা টিনএজাররা এই চাপ নিতে পারে না। অনেকেই শারীরিক, মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়। ভিতরে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়, সমাজের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্ম নেয়। কেউ আত্মহননের চেষ্টা করতে চায়, কারও চরিত্রে উগ্রতা, প্রতিহিংসার বৈশিষ্ট্যগুলি প্রকাশ পায়।

চাই একটু সহানুভূতি

পড়াশোনায় এই অত্যধিক চাপের প্রসঙ্গ তুলেছেন সাইকোথেরাপিস্ট জলি লাহাও। তাঁর মতে, পড়াশোনায় শীর্ষে পৌঁছতেই হবে, এই চাপটা প্রাথমিক ভাবে বাবা-মায়ের কাছ থেকে আসে। ছোট্ট শিশুর উপরেও এখন স্কুলগুলি অভিযোগের পাহাড় চাপায়। ফলে তার জীবন থেকে অবসর শব্দটাই বাদ পড়ে যায়। অবিরাম প্রতিযোগিতার কারণে তাদের সুস্থ মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, রাগ বাড়তে থাকে। সে যদি বাড়িতে মানসিক, শারীরিক ভাবে অত্যাচারিত হয়, তা হলে সেই ব্যবহারই অন্য শিশুকে ফিরিয়ে দেয়। অথচ সামান্য একটু সাহায্য, সাহচর্য, সহানুভূতি পেলে এই শিশুর আচরণ সম্পূর্ণ বদলে যেতে পারে। অভিভাবককে সন্তানের কথা শোনার অভ্যেসও করতে হবে।

একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, ছোটরা নিজেদের কোনও আবেগই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। হাসি, কান্নার মতো রাগ-হিংসাও স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। শিশুকে শাসন করার আগে তার রাগ-হিংসার উৎসের সন্ধান করতে হবে। তার পর তাকে বোঝাতে হবে।বাইরের পরিবর্তিত পরিবেশের প্রভাব সব ছেলেমেয়ের মধ্যে একই ভাবে পড়ে না। কে কেমন ভাবে সেই পরিবেশকে গ্রহণ করছে, তার উপরেও নির্ভর করে একটি শিশু কেমন ভাবে ‘বড়’ হয়ে উঠবে। তাই তো আমরা এক দিকে যেমন ‘হুমকি-প্রথা’ দেখি, তেমনই অন্য দিকে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, মুক্ত কণ্ঠে অন্যায়ের বিচার চাওয়ার সংখ্যাটিও কম নয়।

মডেল: অনুমেঘা কাহালি, তৃণা বৈদ্য, অর্নেষ চক্রবর্তী;

ছবি: চিরঞ্জীব বণিক, অমিত দাস;

মেকআপ: প্রিয়া গুপ্তা

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE