নিজেদের সমস্যার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার পথ এ বার নিজেরাই খুঁজে নিতে চাইল এসএসকেএম। হাজারো অনুরোধ-উপরোধেও অন্য হাসপাতাল থেকে ছোটখাটো কারণে এসএসকেএমে রেফার করার প্রবণতা কমছে না। ফলে শয্যা ভরে গিয়ে ট্রলি, ট্রলি ভরে গিয়ে মেঝে সবর্ত্রই রোগীর ভিড়। যার জেরে রাজ্যের একমাত্র সরকারি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে চিকিৎসা এবং পঠনপাঠন কার্যত শিকেয় উঠেছে। এই রকম পরিস্থিতিতে ‘অযৌক্তিক রেফার’ রুখতে ‘স্পেশ্যাল ফাইল’ চালু করলেন এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ।
মুখের কথায় নয়, প্রমাণ সমেত হাতেনাতে ধরে স্বাস্থ্য ভবনে পেশ করে এর বিহিত চাইবেন এসএসকেএম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবায় এমন ঘটনা নজিরবিহীন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষকর্তারা।
এসএসকেএমের ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসারদের তো বটেই, পাশাপাশি অন্যান্য বিভাগের চিকিৎসকদেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে ‘অযৌক্তিক’ কারণে অন্য হাসপাতাল থেকে রেফার করা হলে তাঁরা সেই কাগজ ফোটোকপি করে রেখে দেন। প্রতি মাসে এমন রেফারের তালিকা খুঁটিয়ে দেখে কোন হাসপাতাল থেকে কত জনকে রেফার করা হয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ হিসেব স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষকর্তাদের কাছে তুলে ধরা হবে।
এসএসকেএমের অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র বলেন, “এই চরম পন্থা নেওয়া ছাড়া আমাদের কোনও উপায় ছিল না। সহকারী সুপার অনির্বাণ ঘোষালের উপরে এই ফাইল তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন আমাদের চিকিৎসকেরা আক্ষেপ করেন, ছোটখাটো সমস্যার ক্ষেত্রেও জেলা হাসপাতাল, এমনকী অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজও এসএসকেএমে রেফার করছে। নামেই এটা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল। অথচ তুচ্ছ কারণেও এখানে ভিড় বাড়ছে।”
কিন্তু কোন রেফার অযৌক্তিক, আর কোনটা নয় তা বিচার করা হবে কী ভাবে?
প্রদীপবাবু বলেন, “যে সব রোগে রেফার করা হচ্ছে, তার চিকিৎসার পরিকাঠামো ওই হাসপাতালে আছে কি না সেটাই মাপকাঠি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যয় নিউরো সার্জারি, আগুনে পোড়া রোগী, লিভারের অসুখের রোগীদেরই বেশি সংখ্যায় রেফার করা হয়। বহু মেডিক্যাল কলেজেই এই সব চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো রয়েছে। এ ছাড়াও, বহু সময়ে তো জ্বর, পেট খারাপের রোগীকেও রেফার করে দেওয়া হয়। সেটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।”
দিন কয়েক আগেই বসিরহাটের বাসিন্দা মোস্তাক গাজি নামে এক তরুণকে নিয়ে মাঝরাতে এসএসকেএমে ছুটে এসেছিল তাঁর পরিবার। এক পথ-দুর্ঘটনায় আহত মোস্তাককে জেলা হাসপাতাল থেকে পাঠানো হয়েছিল নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে। সেখানে সমস্ত পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও রেফার করা হয় এসএসকেএমে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট কড়া অবস্থান নেন। তাঁরা ফের মোস্তাককে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজেই পাঠান। সেখানে সুপারের হস্তক্ষেপে তাঁকে ভর্তি নেওয়া হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, পিংপং বলের মতো এখানে ওখানে পাঠানোর এমন প্রবণতায় আদতে তো হয়রানি বাড়ছে রোগীদেরই। তাঁরা কেন এর শিকার হবেন?
স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, “ফাইলের প্রয়োজনীয়তাটা এখানেই। কারণ প্রতিদিন এমন অজস্র ঘটনা ঘটছে। আমরা কৈফিয়ত তলব করলে বেমালুম অস্বীকার করছেন অনেকেই। এ বার তাই হাতে প্রমাণ রাখার ব্যবস্থা হয়েছে।” তবে সে ক্ষেত্রে সমস্যা যে নেই, তা নয়। প্রদীপবাবু বলেন, “সব রেফার তো কাগজে-কলমে হয় না। মৌখিকও হয়। সে ক্ষেত্রে তো কোনও প্রমাণ থাকে না।”
সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবায় তিনটি স্তর। প্রাইমারি, সেকেন্ডারি এবং টার্শিয়ারি। গুরুত্ব বুঝে রোগীকে এক ধাপ থেকে অন্য ধাপে পাঠাতে হয়। একে বলে ‘রেফারাল সিস্টেম’। কিন্তু বাস্তবে এই ‘গুরুত্ব বোঝা’র ব্যাপারটি পুরোপুরি আপেক্ষিক। ফলে সাধারণ জ্বর, পেট খারাপ বা ছোটখাটো অস্ত্রোপচারের জন্যও রোগীদের কলকাতায় পাঠানো হয়। জেলা স্তরে পরিকাঠামো থেকেও তা কোনও কাজে আসে না।
কিছু দিন আগেই রাজ্যের রেফারাল ব্যবস্থাকে চাঙ্গা করতে একটি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। চালু হয়েছিল রেফারাল রেজিস্ট্রি অর্থাৎ কোনও হাসপাতাল থেকে রোগীকে অন্যত্র রেফার করা হলে কেন রেফার করা হচ্ছে, তার কারণ লেখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই সেই ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ে। ফলে ফের লাগামছাড়া হয়ে ওঠে রেফারাল ব্যবস্থা। এ বার এসএসকেএমের এই উদাহরণ কতটা কাজে লাগে সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy