কখনও তাপমাত্রা নামছে। কখনও আবার মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে আকাশ। অস্বস্তি বাড়ছে রাতে। আবহাওয়ার এই চড়াই-উতরাইয়ে ওদের পোয়াবারো। ওদের মানে ডেঙ্গি ভাইরাস, প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম, ভাইভাক্সের। গোত্র-পরিচয়ে ওরা জীবাণু। কেউ ভাইরাস, কেউ বা প্যারাসাইট। ওদের দৌরাত্ম্যে শীতেও ম্যালেরিয়া আর ডেঙ্গি রোগীর কমতি নেই রাজ্যে। শীত সবে এসেছে বলে বুধবার জানায় হাওয়া অফিস। তার প্রতাপের ওঠানামার উপরে ওই সব রোগের দাপটের হ্রাস-বৃদ্ধি অনেকটাই নির্ভর করবে বলে বিশেষজ্ঞ-চিকিত্সকদের অভিমত।
সাধারণত বর্ষার পরে পরেই ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গির মতো মশকবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ে। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে, সব মরসুমেই এই ধরনের রোগের আক্রমণ ঘটছে। এটার কারণ কী? পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, আবহাওয়ার মতি স্থির থাকছে না বলেই এই সব রোগ এখন বাংলা ও বাঙালির সারা বছরের সঙ্গী। পুজোর আগে উত্তরবঙ্গে এমন একটি জীবাণু দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল, যার দৌরাত্ম্যে মানুষের শরীরে এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ দেখা দেয়। জীবাণু শনাক্ত না-হওয়ায় বহু মানুষের মৃত্যু হয় উত্তরবঙ্গে। দিল্লি থেকে আসা বিশেষজ্ঞেরা জানিয়ে দেন, মশাবাহিত কোনও ভাইরাসই কাণ্ডটা ঘটিয়েছে। একই সঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলায় হানা দিয়েছিল জাপানি এনসেফ্যালাইটিস।
পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, অস্থির আবহাওয়ায় রোগ-জীবাণুদের বংশবৃদ্ধি হচ্ছে, বাড়ছে তাদের বাহক-বংশও। ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া আর এনসেফ্যালাইটিস, এই তিন রোগেরই বাহক মশা। তিন ধরনের মশা। আর ওই তিন ধরনের মশাই ডিম পাড়ে পরিষ্কার জলে। কেউ ডিম পাড়ে ফুলদানি, এয়ারকুলারের মতো সরঞ্জামে, যেখানে পরিষ্কার জল বেশ কিছু দিন ধরা থাকে। কেউ ডিম পাড়ে ডাবের খোলা, পরিত্যক্ত বাসন, চানঘরে জমানো জলে। ধানখেতের জমা জলেও ডিম পাড়ে কিছু মশা।
শীতকালে তো যে-কোনও পতঙ্গই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। কিন্তু শীতের শুরু এবং শেষের সময়টায় ঘরের মধ্যে মশাদের এত সক্রিয়তা কেন?
পতঙ্গবিদদের কেউ কেউ বলছেন, ওই তিন ধরনের মশার চরিত্রে একটা মিল আছে। বাইরের তাপমাত্রা কিছুটা কমলেই মশারা ঢুকে পড়ে ঘরের মধ্যে। লুকিয়ে থাকে ঘরের বিভিন্ন কোনায়। একটু উষ্ণতার খোঁজে। তাই বছরের এই সময়টায় বাড়ির ভিতরে মশকবাহিত যে-কোনও সংক্রমণ দ্রুত ছড়াতে পারে। শুধু ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া বা এনসেফ্যালাইটিস নয়, মশা এখনও শনাক্ত না-হওয়া অনেক রোগের জীবাণুও বহন করে বলে আশঙ্কা করছেন পতঙ্গবিদেরা।
মশকবাহিত বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণে রাজ্য সরকার কতটা তত্পর?
রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা জানান, যথেষ্ট সংখ্যক পতঙ্গবিদ না-থাকায় স্বাস্থ্য দফতর, পুরসভা বা পঞ্চায়েত সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনও পরিকল্পনাই তৈরি করতে পারছে না। পতঙ্গবিদদের প্রয়োজন কতটা, সেটাই বোঝানো যাচ্ছে না স্বাস্থ্য দফতরের পরিচালকদের।
পরজীবী বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এনসেফ্যালাইটিসের প্রতিষেধক টিকা থাকলেও ডেঙ্গি বা ম্যালেরিয়ার কোনও প্রতিষেধক নেই। আবার ম্যালেরিয়ার নির্দিষ্ট ওষুধ থাকলেও ডেঙ্গি বা এনসেফ্যালাইটিসের তা নেই। অর্থাত্ ডেঙ্গির ক্ষেত্রে প্রতিষেধক বা ওষুধ কোনওটাই নেই। তাই ডেঙ্গি প্রতিরোধে মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির উপরেই জোর দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
বাজারে যে-সব কীটনাশক তেল রয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশের বিরুদ্ধেই ইতিমধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলে ফেলেছে মশারা। তাই বিশেষজ্ঞেরা মানুষকে নিজের নিজের সুরক্ষা-বলয় গড়ে তোলার পরামর্শ দিচ্ছেন। মশারি টাঙিয়ে শোয়াটা সেই সব সুরক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম। তা ছাড়া রয়েছে মশা তাড়ানোর নানান উপকরণ। কিন্তু মশারা যে তাদের বিরুদ্ধেও এক সময় প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলবে না, তা কে বলতে পারে! তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মশা তাড়ানোর নানা সামগ্রীরও রাসায়নিক গঠন বদলে ফেলতে হবে। এমনটাই নিদান পরজীবী বিশেষজ্ঞদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy