Advertisement
E-Paper

কর্কট-বীজ মুখশুদ্ধির পানেও, মত ডাক্তারদের

গালের ছোট ফোড়াটা প্রথম চোখে পড়েছিল ছেলের। তিনিই জোর করে মাকে ডাক্তারখানায় নিয়ে যান। খারাপ কিছু দেখতে পাননি পাড়ার ডাক্তার। ‘সাধারণ একটা ফোড়ার’ জন্য মলম দিয়ে ছেড়ে দেন। কিন্তু কমা তো দূরে থাক, ক্রমেই বাড়তে থাকে তা। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে যন্ত্রণা। পরে অন্য এক চিকিৎসকের পরামর্শ নিতেই, তিনি আর ফেলে রাখেননি।

সায়ন্তনী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৪

গালের ছোট ফোড়াটা প্রথম চোখে পড়েছিল ছেলের। তিনিই জোর করে মাকে ডাক্তারখানায় নিয়ে যান। খারাপ কিছু দেখতে পাননি পাড়ার ডাক্তার। ‘সাধারণ একটা ফোড়ার’ জন্য মলম দিয়ে ছেড়ে দেন। কিন্তু কমা তো দূরে থাক, ক্রমেই বাড়তে থাকে তা। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে যন্ত্রণা।

পরে অন্য এক চিকিৎসকের পরামর্শ নিতেই, তিনি আর ফেলে রাখেননি। নিদান দেন, “বায়োপসি করাতে হবে।” তাঁর সন্দেহই ঠিক প্রমাণ হয়েছিল। ক্যানসার। স্টেজ ৪।

সংসার-সন্তান নিয়ে সদাব্যস্ত পঞ্চাশের কোঠার মীরা বাগচীর নেশা বলতে ছিল পান। কোনও কোনও দিন খান চারেক বা তারও বেশি সুপুরি দিয়ে জর্দা-পান খেয়ে ফেলতেন। ডাক্তারদের অভিমত, দিনের পর দিন এই পানের নেশাই চুপিসারে ডেকে এনেছে কর্কট রোগ। ঘুণাক্ষরেও টের পাননি মীরাদেবী। ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, মুখের ক্যানসার নিয়ে এ রকম অসংখ্য রোগী ভিড় করছেন হাসপাতালে।

দুপুরের খাওয়াপর্ব মেটার পর বাড়ির গিন্নিদের পানের বাটা সাজিয়ে বসার রেওয়াজ খাস কলকাতায় আজকাল আর নেই বললেই চলে। শহরের অলিতে গলিতে বেশ কিছু পানের দোকান অবশ্য রয়েছে। কিন্তু মফস্সল কিংবা গ্রামগঞ্জে দিদিমা-ঠাকুমা-মধ্যবয়সি মহিলাদের মধ্যে এখনও রয়েছে সেই চিরাচরিত রীতি। ডাক্তাররা জানাচ্ছেন, ক্যানসার-বিরোধী প্রচারে বরাবরই সাধারণ মানুষকে সতর্ক করে আসা হয়েছে পানমশলার প্রতিটি উপকরণই ডেকে আনতে পারে মারণ রোগ। কিন্তু মফস্সল, পাড়াগাঁয়ে সেই বার্তা পৌঁছেছে কমই।

তবে এটাও ঠিক, তামাক-গুটখা-খৈনি নিয়ে যতটা প্রচার হয়েছে, পান নিয়ে তেমন কিছু হয়নি। সংবাদপত্রেও লেখালেখি হয়েছে খুব কম। ক্যানসার-চিকিৎসকরাই জানাচ্ছেন সেই কথা। বিয়েবাড়ির শেষপাতে থাকা নির্ভেজাল পান-কে তাই কখনওই কেউ সন্দেহের চোখে দেখেননি। তা ছাড়া, গুটখা-খৈনি বিক্রি রাজ্যে নিষিদ্ধ হয়ে গেলেও, পান-পানমশলা বেচাকেনায় আইনি বিরোধিতা নেই। বরং ভারতীয় সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে রয়েছে ‘পান খায়ে সাঁইয়া হামারো’, ‘খাইকে পান বানারসওয়ালা’-র মতো হিট গানও।

পশ্চিমের দেশগুলোতে মানুষের পান খাওয়ার নেশা নেই। তাই এ বিষয়ে গবেষণার সংখ্যাও বেশ কম। কিন্তু এর মধ্যেই দেশে-বিদেশে যে ক’টি গবেষণা হয়েছে, তাতে বহু ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে পান-সুপুরি-জর্দা ক্যানসারের কারণ। ২০০৯ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার’ (আইএআরসি) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র হয়ে ১০টি দেশের ৩০ জন বিজ্ঞানী রিপোর্ট পেশ করে জানান, জর্দা-সুপুরি দেওয়া পান শুধু দাঁতের গঠন নষ্ট করে না, ক্যানসারেরও কারণ। ‘ল্যানসেট অঙ্কোলজি’ নামে বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়।

কী ভাবে রোগের সূত্রপাত?

ক্যানসার শল্যচিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলছেন, যাঁরাই পানের নেশা করেন, সাধারণত মুখের কোনও এক পাশে পান গুঁজে রাখেন। দীর্ঘদিন ধরে এ ভাবে চলতে চলতে এক সময় মুখের ভিতর, গালের যে পাশে তিনি পান রেখে দেন, সেখানে সাদা-কালো দাগ হতে থাকে। সাদা দাগগুলোকে বলে লিউকোপ্লেকিয়া। আর কালো দাগগুলো মেলানোপ্লেকিয়া। এগুলোই ক্যানসারের সুনির্দিষ্ট পূর্বলক্ষণ।

এর পরেই ধীরে ধীরে ঘা হতে শুরু করে মুখে। মুখের ভিতরের গোলাপি অংশ ক্রমশ শক্ত হয়ে যায়। একে বলে সাবমিউকোসাল ফাইব্রোসিস। দুর্গন্ধ বেরোতে থাকে। সেই সঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণা। ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “ঘা হয়ে গিয়ে মুখের হাঁ ক্রমশ ছোট হয়ে যায়। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি ঠিক মতো মুখ খুলতে পারেন না। খাবার জমতে জমতে ঘা আরওই বাড়তে থাকে।” ক্রমে মুখের বাইরেও ঘা হয়ে যায়। তার পর ক্যানসার নামতে থাকে গলায়। ক্রমশ ছড়াতে থাকে শ্বাসনালী, ফুসফুস, শরীরে অন্য অংশে।

চিকিৎসকদের বক্তব্য, রোগ মুখেই সীমাবদ্ধ থাকলে বিপদ তুলনামূলক কম। মৃত্যুভয় সে অর্থে থাকে না। তবে অঙ্গহানি ঘটে। ডাক্তাররা অস্ত্রোপচার করে মুখের আক্রান্ত অংশ বাদ দিয়ে দেন। দেহের অন্য অংশ থেকে মাংস নিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয় মুখে। পুনর্গঠিত চেহারা অবশ্য একেবারে আগের মতো হয় না। চেহারার বিকৃতি ছাড়াও চলে যেতে পারে গলার স্বর।

এই অবস্থায় পান খাওয়ার নেশা যাঁদের রয়েছে, কী করা উচিত তাঁদের? চিকিৎসকমহলের জবাব “নেশা ছাড়ুন।” তাঁরা জানাচ্ছেন, নিজেরাই মুখের ভিতরটা পরীক্ষা করে দেখুন, সাদা-কালো দাগ রয়েছে কি না। মুখ ঠিক মতো হা করতে পারছেন কি না, সেটাও দেখার। বিপদ আন্দাজ করলেই, ফেলে না রেখে বিশেষজ্ঞ-পরামর্শ নিতে বলছেন ডাক্তাররা।

কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই লোকে বলেন, ‘পান পাতার তো গুণও রয়েছে’! তবে কেউ যদি শুধু পান পাতা খান? ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল জিনোমিকস’-এর অধিকর্তা পার্থপ্রতিম মজুমদারের দাবি, “শুধু পান পাতা কেউ খেতেই পারেন। তার থেকে ক্যানসার হয় বলে জানা নেই। তবে জর্দা তামাকজাত। তাতে মারাত্মক ক্ষতি।” বাস্তবিক। এ যাবৎ বিষয়টি নিয়ে যা গবেষণা হয়েছে, তার সবেতেই পান-সুপুরি-জর্দা এক সঙ্গে খেলে ক্যানসার হতে পারে, সেই আশঙ্কার কথা রয়েছে। কিন্তু কেউ যদি শুধু পাতা খান, তারও কি ক্যানসার হবে? উল্লেখ নেই অতীত গবেষণায়।

তবে গৌতমবাবু বলছেন, পুরো বিষয়টাই এড়িয়ে যাওয়া ভাল। তা ছাড়া, শুধু পান পাতা খাওয়ার নেশা কে-ই বা করেন! সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় যেমন জানাচ্ছেন, পান চিবোলেই, একটা গাল ক্ষয়ে যাওয়া অনুভূতি হয়। এর অর্থ, গালের ভিতরের পর্দা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চিকিৎসক মহলের বক্তব্য, সচেতনতা তৈরি না হলে মানুষকে এ সব বোঝানো অসম্ভব। “দরকার হলে জিভের স্বাদ বদলাতে সাময়িক ভাবে মুখে জোয়ান, মৌরী রাখুন। কিন্তু যে ভাবে হোক, নেশা ত্যাগ করুন।” বলছেন ডাক্তাররা। যাঁরা মাঝেমধ্যে পান খেয়ে থাকেন, তাঁদের জন্যও ডাক্তারদের সাবধানবাণী কখনওই মাসে একটা-দু’টোর বেশি নয়।

তাই ফিল্মে যতই বলা হোক না কেন, ‘অকল’ থাকলে ‘পান বানারসওয়ালা’ এড়ানোই ভাল।

sayantani bhattacharyay betel leaf cancer
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy