Advertisement
E-Paper

চিকিত্‌সক নেই, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভরসা বলতে ফার্মাসিস্টই

সোমবার বেলা সওয়া ১টা। বাগদা ব্লকের নাটাবেড়িয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে কোনও চিকিত্‌সকের দেখা মিলল না। রোগী দেখার ঘরে তালা ঝুলছে। রোগীর আনাগোনাও তেমন চোখে পড়ল না। হাতেগোনা এক-দু’জন যাঁরা চিকিত্‌সার জন্য এলেন, তাঁদের ওষুধপত্র দিলেন একমাত্র ফার্মাসিস্ট প্রদ্যুত সামন্ত।

সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:৫৬
রোগী দেখছেন ফার্মাসিস্ট।

রোগী দেখছেন ফার্মাসিস্ট।

সোমবার বেলা সওয়া ১টা। বাগদা ব্লকের নাটাবেড়িয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে কোনও চিকিত্‌সকের দেখা মিলল না। রোগী দেখার ঘরে তালা ঝুলছে। রোগীর আনাগোনাও তেমন চোখে পড়ল না। হাতেগোনা এক-দু’জন যাঁরা চিকিত্‌সার জন্য এলেন, তাঁদের ওষুধপত্র দিলেন একমাত্র ফার্মাসিস্ট প্রদ্যুত সামন্ত। স্থানীয় থোয়ারা গ্রাম থেকে চোখের সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন প্রৌঢ় কালীপদ মণ্ডল। প্রদ্যুতবাবু তাঁকে জানিয়ে দিলেন, এখানে কোনও চিকিত্‌সক নেই। ফলে তাঁর চিকিত্‌সা এখানে সম্ভব নয়। হতাশ হয়ে বাড়ি ফেরার পথে বৃদ্ধ বমি বন্ধ হওয়ার গোটা কয়েক ট্যাবলেট নিয়ে গেলেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্র সূত্রে জানা গিয়েছে, অতীতে এক জন টেকনিশিয়ান ছিলেন। তিনি চোখের চিকিত্‌সা করতেন। কিন্তু বহু দিন হল অবসর নিয়েছেন। তারপর থেকে আর চোখের চিকিত্‌সা এখানে হয় না।

শুধু চোখ নয়, জ্বর-সর্দি-কাশি, পেটের অসুখের মতো প্রাথমিক কিছু রোগের ওষুধ ছাড়া এখান থেকে বর্তমানে কোনও পরিষেবাই পাওয়া যায় না বলে বাসিন্দারা জানিয়েছেন। রাজ্যের বেহাল স্বাস্থ্যব্যবস্থার উদাহরণ নাটাবেড়িয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। স্বাস্থ্য দফতর ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র সূত্রে জানানো হয়েছে, এখন হাসপাতালে কোনও চিকিত্‌সক বা মেডিক্যাল অফিসার নেই। নেই কোনও নার্স ও সাফাইকর্মী। থাকার মধ্যে রয়েছেন একজন ফার্মাসিস্ট, দু’জন জিডিএ বা জেনারেল ডিউটি অ্যাটেন্ডেন্ট। রোগী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে স্থানীয় ভাবে এক ব্যক্তিকে রাখা হয়েছে, তিনি ঘরদোর ঝাঁট দেন। সমিতির পক্ষ থেকে এক মহিলাকে রাখা হয়েছে, যিনি জিডিএদের সাহায্য করেন। কিন্তু কয়েক মাস হয়ে গেল তারা কোনও বেতন পাচ্ছেন না।

কয়েক মাস আগেও এখানে দু’জন চিকিত্‌সক বা এমও ছিলেন। কিন্তু তাঁরা অন্যত্র বদলি হয়ে গিয়েছেন। গত জুন মাস থেকে এখানে কোনও চিকিত্‌সক না থাকায় সবেধন নীলমনির মতো গোটা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিত্‌সা পরিষেবা দেওয়ায় ভার একা সামলাতে হচ্ছে প্রদ্যুত্‌বাবুকে।

বন্ধ পড়ে চিকিত্‌সকের ঘর।

সোমবার দুপুরে গিয়েও দেখা গেল, তিনিই রোগীদের ওষুধ দিচ্ছেন। এলাকার গরিব মানুষের আপদ-বিপদে প্রদ্যুত্‌বাবুই ভরসা। তিনি বলেন, “রোজ সাড়ে ৯টার মধ্যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চলে আসি। দুপুর ২টো পর্যন্ত থাকি।” স্থানীয় বাসিন্দা বৃদ্ধা পাড়ু শীলের গলায় ঘা হয়েছে। এ দিন তিনি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ওষুধ নিয়ে ফিরে যাওয়ার সময়ে বললেন, “স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে ফার্মাসিস্টকে সমস্যার কথা বলতেই উনি ওষুধ দিয়ে দিলেন। এখানে ডাক্তার তো নেই।” স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মধ্যে দিয়ে মাঠে ছাগল চড়াতে নিয়ে যাচ্ছিলেন সুধীর সর্দার। বললেন, “বিকেলের পরে জ্বরজারিতে আমাদের ভরসা বলতে হাতুড়ে বা বিভিন্ন ওষুধের দোকানদারেরা। বড় বিপদ হলে বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে যেতে হয়। সাধারণ যানবাহনে যেতে খরচ হয় ৫০ টাকা। দ্রুত নিয়ে যেতে হলে গাড়ি ভাড়া পড়ে যায় প্রায় ৫০০ টাকা। আমাদের মতো গরিব মানুষের পক্ষে ওই খরচ বহন করা সম্ভব হয় না।”

স্থানীয় গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি প্রায় সাত বিঘে জমির নিয়ে তৈরি হয়েছিল বছর পঞ্চাশ আগে। সুদূর অতীতে এখানে রোগী ভর্তির ব্যবস্থা ছিল। দশটি শয্যা ছিল। সর্ব ক্ষণের জন্য চিকিত্‌সক ও নার্স থাকতেন। তাঁদের জন্য ভবন তৈরি করা হয়েছিল। বহু দিন হল সে সব লাটে উঠেছে। বাম আমলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভোল বদল হয়নি। গ্রামবাসীরা আশা করেছিলেন, তৃণমূল সরকার কিছু করবে। তার উপর এখানকার বিধায়ক উপেন বিশ্বাস আবার রাজ্যের মন্ত্রী। কিন্তু সাড়ে তিন বছর সময় পেরিয়ে গিয়েছে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অবস্থার পরিবর্তন তো দূরের কথা, দিনে দিনে তা বেহাল হচ্ছে বলে অভিযোগ। আগে তা-ও চিকিত্‌সক থাকতেন। এখন নেই। ক্ষোভ বাড়ছে মানুষের।

স্থানীয় বাসিন্দা তথা ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তী বলেন, “আমার বোন, বছর আটত্রিশের সুপর্ণা ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই জন্মেছিল। বহু বছর হল সে সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রাত হলেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মধ্যে দুষ্কৃতীদের আনাগোনা বাড়ে। মদ ও জুয়ার আসর বসে। গ্রামীণ এলাকা, সাপে কাটা বা কুকুরে কামড়ানোর ভ্যাকসিন পাওয়া যায় না। প্রসূতিদের খুবই দুর্ভোগ হয়।” অন্য হাসপাতালে যাওয়ার পথে রাস্তায় প্রসবের ঘটনাও ঘটেছে বলে জানালেন তিনি।

চিকিত্‌সকদের আবাসনের জীর্ণ দশা।

দেখা গেল, সামনের দিকে পাঁচিল দেওয়া হলেও পিছনের দিকটা সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। বাসিন্দারা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পানীয় জলের কল থেকে খাবার জল নিয়ে যাচ্ছেন। কয়েকটি পানীয় জলের কলের অবশ্য মাথা নেই। কেউ খুলে নিয়ে গিয়েছে। চিকিত্‌সক ও নার্সদের থাকার জন্য অতীতে পাঁচটি ভবন তৈরি করা হয়েছিল। দীর্ঘ দিন অব্যবহারের ফলে সেগুলির অবস্থা ভয়াবহ। দরজা-জানালার কাচ ভাঙা। দেওয়ালে শ্যাওলা জমেছে। গ্রিলে জং পড়েছে। ভিতরটা নোংরা-আবর্জনায় ভরা। বিষাক্ত সাপেদের নিরাপদ আস্তানা হয়ে উঠেছে। এখান থেকে কাছের বনগাঁ মহকুমা হাসপাতাল ও বাগদা ব্লক গ্রামীণ হাসপাতালের দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটারের বেশি। মালিপোতা, থোয়ারা, নাটাবেড়িয়া, বাজিতপুর, মামুদপুর, গঙ্গানন্দপুর, অম্বরপুর, গাতপুকুর-সহ নদিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকেও এখানে মানুষ চিকিত্‌সা করাতে আসেন। প্রদ্যুত্‌বাবু বলেন, “দৈনিক গড়ে দেড়শো-দুশো রোগী বর্হিবিভাগে দেখাতে আসেন।”

কী বলছেন স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা? বাগদা ব্লক মেডিক্যাল অফিসার রাজর্ষি সেনগুপ্ত বলেন, “ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিত্‌সক চেয়ে জেলার মুখ্যস্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছে আবেদন করা হয়েছে। উনি জানিয়েছেন, চিকিত্‌সক না পাওয়া যাচ্ছে না।” মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রলয়কুমার আচার্য বলেন, “বাগদা ব্লক থেকেই চিকিত্‌সক রোটেশেন ভিত্তিতে ওই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠানো হয় রোগী দেখার জন্য। স্থায়ী চিকিত্‌সকের বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ করা হচ্ছে।” প্রলয়বাবু অবশ্য চিকিত্‌সক পাঠানোর বিষয়টি মানতে চাননি। এলাকার মানুষ জানিয়েছেন, জুন মাসের পর থেকে কোনও চিকিত্‌সকের দেখা পাওয়া যায়নি। অতীতে বাগদার বিএমওএইচরা এখানে এসে রোগী দেখতেন। সে সবও এখন ব‌ন্ধ। বেলা ২টো নাগাদ ফিরে আসছি, দেখা গেল ফার্মাসিস্ট ও একজন জিডিএ স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বরে শীতের রোদ্দুর গায়ে মাখছেন। এক বাসিন্দা জানালেন, কিছু ক্ষণের মধ্যেই ওঁরা বাড়ি ফিরবেন।

ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

simanta moitra bagda primary health center
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy