জোঁকের মুখে যেমন নুন, ভাইরাসের যম জোরালো উত্তাপ। কিন্তু এ বার আবহাওয়ার খামখেয়ালে সেই তাপমাত্রাই বাড়ছে না। আবহাওয়া দোসর-সুগ্রীবের ভূমিকা নেওয়ায় বাগ মানছে না সোয়াইন ফ্লু-র ভাইরাস এইচ১এন১।
মঙ্গলবারেও কলকাতায় ওই রোগে দু’জন মারা গিয়েছেন। নতুন করে এইচ১এন১ ভাইরাস মিলেছে ১৯ জনের রক্তে। সব মিলিয়ে রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ২৪৫। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহেও তাপমাত্রা বাড়ার লক্ষণ নেই। তাই ভাইরাসের বাড়বাড়ন্তও কমছে না। তার উপরে যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু উপসর্গ। এত দিন ছিল জ্বর। গা-হাত-পায়ে ব্যথা। কাশি আর শ্বাসকষ্ট। এখন ওই সব উপসর্গের সঙ্গেই গোটা শরীরে র্যাশ বেরোচ্ছে। রক্ত বেরোচ্ছে নাক-মুখ থেকে। কমার বদলে নতুন উপসর্গ নিয়ে সোয়াইন ফ্লু জাঁকিয়ে বসছে রাজ্য জুড়ে।
সোয়াইন ফ্লু-র নতুন উপসর্গ আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পরজীবী বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী। তিনি জানান, জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে নাক-মুখ থেকে রক্ত বেরোচ্ছে অনেকের। কাশির সঙ্গে রক্ত পড়ছে, এমন তিন জন রোগীকে কয়েক দিনের মধ্যেই পেয়েছেন তিনি। “এ ছাড়া অনেকের শরীরে র্যাশও বেরোচ্ছে। এত বছর ধরে ইনফ্লুয়েঞ্জা দেখছি, এমনটা পাইনি। জিনের পরিবর্তনটাই ক্ষতিকর। চেনা শত্রুর সঙ্গে লড়াই করা সহজ। অচেনা শত্রুর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন,” বেশ উদ্বিগ্ন শোনাল পরজীবী বিশেষজ্ঞকে।
নতুন নতুন উপসর্গের মূলেও সেই ভাইরাসের রমরমা। তারা দৌরাত্ম্য বাড়ানোর রসদ পাচ্ছে আবহাওয়া থেকেই। ভাইরাসের সঙ্গে কী ভাবে সহযোগিতা করছে আবহাওয়া?
পশ্চিমী ঝঞ্ঝার জন্য জম্মু-কাশ্মীর ও উত্তরাখণ্ড ও হিমাচলপ্রদেশে প্রচণ্ড তুষারপাত হচ্ছে। সেই জন্য উত্তর ভারতের বিভিন্ন এলাকায় কনকনে ঠান্ডা রয়েছে। সেখান থেকে উত্তুরে হাওয়া নেমে আসছে নীচের দিকে। ফলে এখানে দিন ও রাতের তাপমাত্রা বাড়তে পারছে না। ঘূর্ণাবর্তের দরুন পরিমণ্ডলে ঢুকে পড়া মেঘ যোগ দিয়েছে এর সঙ্গেই। সব মিলিয়ে ফাল্গুনের শেষ সপ্তাহে অস্বস্তিকর আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে। আর এমন আবহাওয়া যত দিন থাকবে, তত দিন চলবে ব্যাক্টেরিয়া বা জীবাণু, ভাইরাস ও পরজীবীদের দাপট। আবহাওয়া দফতর জানাচ্ছে, আগামী সপ্তাহ থেকে উত্তুরে হাওয়ার প্রকোপ কমবে। ঘূর্ণাবর্তও দুর্বল হবে। ফিরে আসবে এই সময়ের স্বাভাবিক আবহাওয়া।
কিন্তু এই সময়ের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হওয়ার পরে জীবাণু-দমন তো আরও অন্তত কয়েকটা দিনের ব্যাপার। তার আগে সোয়াইন ফ্লু-র দাপট মোকাবিলার কোনও উপায়ই কি নেই চিকিৎসাবিজ্ঞানে?
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ওই রোগ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পরিবর্তিত চরিত্রের ভাইরাসের বলে বলীয়ান হয়ে। আবহাওয়া তাতে ইন্ধন জোগাচ্ছে। আবহাওয়া স্বাভাবিক হয়ে গেলে পিছু হটবে ভাইরাসও। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ভাইরাসের জেনেটিক গঠন পরিবর্তিত হলে রোগের সঙ্গে লড়াইয়ের ক্ষমতা প্রথম দিকে কম থাকে। ২০০৯-এর পরে এ বার সোয়াইন ফ্লু যে-ভাবে ফিরে এসেছে, তাতে জিনের গঠন পাল্টে গিয়েছে। তাই প্রথম দিকে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। অচিরেই এই পরিবর্তিত ভাইরাসের প্রতিরোধ ক্ষমতাও দেহে তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা, আশ্বস্ত করছেন তাঁরা।
“সোয়াইন ফ্লু নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ, এর মারণ-ক্ষমতা বেশি নয়। তবে অন্তঃসত্ত্বা, বৃদ্ধ বা শিশুদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি তুলনামূলক ভাবে বেশি। যাঁরা দীর্ঘদিন স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ খাচ্ছেন, তাঁদের এই ফ্লু হলে বাড়তি সতর্কতা চাই,” বলছেন ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ অরিন্দম কর। তাঁর বক্তব্য, শুধু জ্বর, গা-হাত পায়ে ব্যথা এবং ডায়েরিয়ার উপসর্গ নিয়ে যে-সোয়াইন ফ্লু হচ্ছে, তার চেয়ে শ্বাসকষ্টের উপসর্গ নিয়ে আঘাত হানা সোয়াইন ফ্লু অনেক গুরুতর। তাই ওই ফ্লুয়ের ক্ষেত্রে শুরুতেই হাসপাতালে ভর্তি করানোটা জরুরি।
সোয়াইন ফ্লু-র মারণ হানা অব্যাহত আছে। ওই রোগে আক্রান্ত হয়ে এ দিন বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে ভর্তি দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের এক জন কলকাতার এবং অন্য জন হাওড়ার বাসিন্দা। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ওই দুই রোগীই বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সেখানে খরচ চালাতে না-পেরে তাঁদের আইডি-তে ভর্তি করা হয়। নেহা ঢালি নামে এক মহিলাকে একাধিক সরকারি হাসপাতাল ভর্তি না-করে ফিরিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে জানান, এই ব্যাপারে দু’টি হাসপাতালকে শো-কজ করা হচ্ছে। রোগী ফেরানোর জন্য আগে যে-চারটি বেসরকারি হাসপাতালকে শো-কজ করা হয়েছিল, তাদের কেউই সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেনি। ফের তাদের জবাবদিহি চাওয়া হয়েছে বলে জানান স্বাস্থ্যসচিব।
চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ মনে করছেন, সোয়াইন ফ্লু-র বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতে ওষুধের সরবরাহ ঠিকঠাক রাখা দরকার। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী রিপোর্ট পজিটিভ হলে তবেই ওষুধ চালু করা হবে, এই সিদ্ধান্ত ঠিক নয় বলেও সমালোচনা করেছেন অনেকে। তাঁদের মতে, হাসপাতাল ভর্তি হয়ে নমুনা সংগ্রহের পরে তা পরীক্ষা করে রিপোর্ট আসতে আসতে ৭২ ঘণ্টা কেটে যায়। তার পরে ওষুধ চালু করলে কোনও কোনও ক্ষেত্রে সেটা বিপজ্জনক হতে পারে। ওই চিকিৎসকদের দাবি, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে সোয়াইন ফ্লু ক্লিনিক চালু করে সেখানে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মোতায়েন করা হোক। তাতে চিকিৎসার গতি অনেক বাড়বে।
রাজ্যে সোয়াইন ফ্লু পরীক্ষার পরিকাঠামো এখনও সীমিত। তাই শুধু হাসপাতালে ভর্তি হলে তবেই নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। চিকিৎসকদের মতে, সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে অনেক রোগীই চার পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং অন্যদের মধ্যে অসুখ ছড়াচ্ছেন। এই প্রবণতা মারাত্মক। পরিবারে এক জন আক্রান্ত হলে অন্যদেরও জ্বর-সর্দি-কাশি শুরু হয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা করলে হয়তো তাঁদের রিপোর্টও পজিটিভ হবে। কিন্তু প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে তাঁরা হয়তো হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন না। সামগ্রিক ভাবে এর পরিণাম মারাত্মক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy