চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবে ধুঁকছে জেলার স্বাস্থ্য পরিষেবা। বহু ক্ষেত্রে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু রাখতে গিয়ে কোপ পড়ছে অধীনস্থ প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলির উপর। ওই সব প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলি থেকে চিকিৎসক-সহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের তুলে কার্যত জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এর ফলে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে চিকিৎসা তো মিলছেই না উল্টে ব্লক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতেও প্রাপ্য পরিষেবা পাছেন না রোগীরা। অথচ স্বাস্থ্য দফতরের কোনও হেলদোল নেই বলে অভিযোগ।
জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক কার্তিকচন্দ্র মণ্ডল বলেন, “চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী শূন্য পদের তালিকা স্বাস্থ্য দফতরের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে পনেরো জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া গিয়েছে। তার মধ্যে ৬ জন মহকুমা এবং জেলা হাসপাতালে যোগ দিয়েছেন। বাকিরাও একই স্তরে যোগ দেবেন। মাস খানেকের মধ্যেই আরও কয়েকজন চিকিৎসক মিলবে। তাঁদের ব্লক এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে পাঠানো হবে। স্বাস্থ্য কর্মী পেলে শূন্য পদ পূরণের ব্যবস্থা করা হবে।”
তফসিলি, সংখ্যালঘু এবং আদিবাসী অধ্যুষিত অন্যতম এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ময়ূরেশ্বর ২ ব্লক। অধিকাংশেরই আয়ত্তের বাইরে টাকা খরচ করে পরিষেবা নেওয়া কিংবা দূরের স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসার নাগাল পাওয়ার সাধ্য নেই। তাই তাঁদের নির্ভর করতে হয় নিকটবর্তী ব্লক কিংবা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির ওপর। কিন্তু বর্তমানে তাদের সেই নির্ভরতা কার্যত হতাশায় পরিণত হয়েছে। হাতুড়ে কিংবা বিনা চিকিৎসায় দিনের পর দিন তাঁদের কাটাতে হচ্ছে বলে অভিযোগ।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ময়ূরেশ্বর ২ ব্লকের ষাটপলসা ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অধীনে রয়েছে তিনটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র তো বটেই। তিনটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি রয়েছে। ওই ঘাটতি মেটাতে অধীনস্থ প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলি থেকে চিকিৎসক ও কর্মীদের তুলে আনা হয়েছে। নওয়াপাড়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য বরাদ্দ ৩ জন চিকিৎসক। কিন্তু বর্তমান সেখানে একজন নেই। চিকিৎসক দেবব্রত দাসকে মাস খানেক আগে পাঠানো হয়েছে প্রশিক্ষণ নিতে। বাকি দু’জন চিকিৎসক করুণাময় মণ্ডল এবং লিপিকা মণ্ডলকে তুলে নেওয়া হয়েছে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। শুধু চিকিৎসকই নয়। ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নার্স রেখা সিংহকে তুলে নেওয়া হয়েছে ঢেকা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।
ঢেকা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অবস্থাও চরম বেহাল। ২০১৩ সালের মে মাস থেকে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনও চিকিৎসক নেই। একমাত্র চিকিৎসক উচ্চশিক্ষার্থে ছুটি নিয়ে চলে যাওয়ার পর তাঁর জায়গায় কাউকে নিয়োগ করা হয়নি। এমনকী কয়েক মাস সপ্তাহে তিন দিন করে ফার্মাসিস্ট শঙ্কর সোরেনকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। মাঝে মাস খানেক সপ্তাহে ২-৩ দিন ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে একজন চিকিৎসককে পাঠানো হলেও বর্তমান তাও বন্ধ। এর ফলে একজন জিডিএ, একজন নার্স, একজন সাফাই কর্মী ও একজন ফার্মাসিস্ট দিয়ে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র চলছে। অথচ ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির ওপরই এলাকার ২৫-৩০টি গ্রাম-সহ মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ নির্ভরশীল। ডাঙাপাড়ার সৌরভ ধীবর, নবগ্রামের বংশীবদন মণ্ডলদের ক্ষোভ, “স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকেও না থাকার মতো অবস্থা। দীর্ঘ দিন চিকিৎসক না থাকায় আমাদের হাতুড়ে চিকিৎসকদের উপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে। নয়তো বিনা চিকিৎসায় মরতে হচ্ছে।” ক্ষোভের কথা স্বীকার করে ফার্মাসিস্ট শঙ্করবাবু বলেন, “আমরা শুধু মাত্র জ্বরজ্বালার ওষুধটুকু দিতে পারি। কিন্তু জ্বর জ্বালার ওষুধেই তো মানুষের সমস্যা মেটে না। তাই চিকিৎসক থাকাকালীন যেখানে ১৫০-১৬০ জন রোগী বহিবির্ভাগে আসতেন তা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৫০-৬০ জন। প্রাপ্য স্বাস্থ্য পরিষেবা না পাওয়ায় রোগীর পরিজনদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয় আমাদের।”
একই অবস্থা হটিনগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও। সেখানে বরাদ্দ ২ জন চিকিৎসকের মধ্যে একটি পদ দীর্ঘ দিন শূন্য। এক মাত্র ফার্মাসিস্টকেও সপ্তাহে তিন দিন তুলে নেওয়া হয় ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সব থেকে দুরবস্থা ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের। ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য বরাদ্দ রয়েছে বিএমওএইচ-সহ ৬ জন চিকিৎসক। কিন্তু ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নিজস্ব কোনও চিকিৎসকই নেই। নওয়াপাড়া থেকে তুলে আনা ২ জন চিকিৎসকই সম্বল। কারণ, গত সেপ্টেম্বর মাসে বিএমওএইচ রামকৃষ্ণ কর্মকারকে প্রশিক্ষণ নিতে পাঠানো হয়েছে। তাঁর জায়গায় এবং দীর্ঘদিন আগে একে একে ফাঁকা হয়ে যাওয়া শূন্য পদগুলিতে কোন চিকিৎসক নিয়োগ করা হয়নি। শুধু চিকিৎসকই নয়। অভাব রয়েছে নার্স, ফার্মাসিস্ট এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরও। ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১২ জন নার্স। কিন্তু রয়েছেন মাত্র তিন জন। তার মধ্যে আবার তিন জন রয়েছেন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। ২ জন ফার্মাসিস্টের পদও দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। ভারপ্রাপ্ত বিএমওএইচ করুণাময় মণ্ডল বলেন, “বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে পালা ক্রমে ফার্মাসিস্ট তুলে এনে কোনও ক্রমে বহিবির্ভাগটুকু চালানো হচ্ছে। আর একটি বিভাগে জোড়াতালি দিয়ে আমাদেরই চালাতে হচ্ছে।”
একই সমস্যা নানুরেরও। ওই ব্লকের বনগ্রাম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য বরাদ্দ চিকিৎসক-সহ ৬ জন স্বাস্থ্যকর্মী। কিন্তু বছর দু’য়েক ধরে এক জন নার্স এবং চিকিৎসক দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে কাজ চলছিল। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর মাসে আচমকা চিকিৎসক আমতাজ আলিকে তুলে নেওয়া হয় ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ঘাটতি মেটাতে। ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা তাই চিকিৎসক ফেরানোর দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তালা ঝুলিয়ে দেন। শেষমেশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের তালা খোলাতে সপ্তাহে তিন দিন ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে এক জন করে চিকিৎসককে পালা ক্রমে পাঠাতে বাধ্য হয় স্বাস্থ্য দফতর। স্থানীয় বাসিন্দা রথিন মণ্ডল, শ্যামল মণ্ডল বলেন, “গ্রামের মানুষ অধিকাংশই দুঃস্থ। তাই সপ্তাহে তিন দিনের ওই পরিষেবার জন্যই তাদের রোগ চেপে বসে থাকতে হয়। স্বাস্থ্য দফতরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও স্থায়ী চিকিৎসক মেলেনি।”
স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীর সমস্যা দীর্ঘ দিনের। আমরা দ্রুততার সঙ্গে তার সমাধানের চেষ্টা করছি। চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। ইতিমধ্যে গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবা সচল রাখতে পঞ্চায়েতের সাব সেন্টারগুলিতে এক জন করে আয়ুসের(আয়ুর্বেদ ও হোমিওপ্যাথ) চিকিৎসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”