Advertisement
E-Paper

ভূতের ভয়ে কাঁটা মিস্ত্রিরা, টলমল হাসপাতালের ভবিষ্যৎ

রাত বাড়লেই যদি ভূতে এসে ধরে? কিংবা ঘাড়টাই দেয় মটকে? হাসপাতালের লাশকাটা ঘর যে ভূতেদের আস্তানা, ওঁরা বিলক্ষণ জানেন। মাঝেসাঝে সে ঘরের পাশ দিয়ে যেতে হলে সারা রাস্তা রাম-নাম জপেন। সেই ঘরই কি না উঠে আসবে নাকের ডগায়? যেখানে কাজ করছেন, তার পাশে! সাগর দত্ত মেডিক্যালে আটতলা নতুন ভবন তৈরি করতে আসা মিস্ত্রিরা তাই সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কাজ করতে এসে বেঘোরে প্রাণটা দিতে মোটেই রাজি নন তাঁরা।

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৪ ০১:৪৫
অঙ্কন: সুমিত্র বসাক।

অঙ্কন: সুমিত্র বসাক।

রাত বাড়লেই যদি ভূতে এসে ধরে? কিংবা ঘাড়টাই দেয় মটকে?

হাসপাতালের লাশকাটা ঘর যে ভূতেদের আস্তানা, ওঁরা বিলক্ষণ জানেন। মাঝেসাঝে সে ঘরের পাশ দিয়ে যেতে হলে সারা রাস্তা রাম-নাম জপেন। সেই ঘরই কি না উঠে আসবে নাকের ডগায়? যেখানে কাজ করছেন, তার পাশে!

সাগর দত্ত মেডিক্যালে আটতলা নতুন ভবন তৈরি করতে আসা মিস্ত্রিরা তাই সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কাজ করতে এসে বেঘোরে প্রাণটা দিতে মোটেই রাজি নন তাঁরা। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাই লাশকাটা ঘর সরিয়ে আনা যাবে না নতুন বাড়িতে।

হাসপাতালের কর্তারা নাজেহাল। এমনিতেই তাঁদের শিয়রে শমন। যে কোনও দিন হাজির হবেন এমসিআই-র পরিদর্শকেরা। তার উপরে আবার মিস্ত্রিরা বেঁকে বসাতে এমসিআইয়ের নির্দেশই যে কার্যকর করা যাচ্ছে না! যে নির্দেশে বলা রয়েছে, মেডিক্যাল পড়ুয়াদের শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষ থাকতে হবে অ্যাকাডেমিক বিল্ডিংয়ে। অর্থাৎ নতুন তৈরি আটতলা বাড়িতেই সরাতে হবে সেই ঘর। ভূতেদের কল্যাণে সেই নির্দেশ মানাতেই এখন পথের কাঁটা মিস্ত্রিরা।

এমসিআইয়ের ছাড়পত্র পেতেই তড়িঘড়ি পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে এই মেডিক্যাল কলেজে। আটতলা নতুন অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং তৈরি তারই অঙ্গ। চারটি তলা নির্মাণের কাজ শেষ। পঠনপাঠনের ঘর থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা ঘরে এখন মৃতদেহ কাটাছেঁড়ার কাজ করেন পড়ুয়ারা। এমসিআইয়ের নির্দেশ মানতে হলে সেই ঘর নতুন ভবনে সরাতেই হবে। নভেম্বরের গোড়ার দিকে ফের পরিদর্শনে আসবে এমসিআই। তাই তড়িঘড়ি নতুন বাড়িতে সেই ঘর তৈরির পাশাপাশি শেষ হয়েছে বৈদ্যুতিক সংযোগ তৈরির কাজও। কিন্তু তাতে কী! বেঁকে বসেছেন মিস্ত্রিরা!

তাঁদের সাফ কথা, অনেক রাত পর্যন্ত তাঁদের কাজ করতে হয়। বহু কর্মী রাতে থেকেও যান। নিজের ঘরে ‘মড়া কাটা’ হলে রাতে নির্ঘাত ভূত বেরোবে! রাতে বাড়িময় ঘুরে বেড়াবে, এমনকী কারও ঘাড় মটকালেও আশ্চর্যের কিছু নেই। মিস্ত্রিদের এক গোঁ, যত দিন না তাঁদের কাজ শেষ হচ্ছে, তত দিন ওই বাড়িতে মৃতদেহ আনা বা রাখা চলবে না। যদি আনা হয়, তাঁরা কাজ বন্ধ করে দেবেন।

অতএব কর্তৃপক্ষ মহা ফাঁপরে! কারণ তাঁদের অবস্থা শাঁখের করাতের মতো। বাকি চারতলার কাজ যত দ্রুত শেষ করতে হবে। মিস্ত্রিরা বেঁকে বসলে সর্বনাশ! এমসিআই পরিদশর্কেরাও এসে যদি দেখেন শব-ব্যবচ্ছেদ কক্ষ অ্যাকাডেমিক বিল্ডিংয়ে সরানো হয়নি, তাঁরাও বেঁকে বসবেন!

মাস কয়েক আগে পরিদর্শনে এসে পরিকাঠামোর বেশ কিছু খামতি দেখে রাজের কয়েকটি মেডিক্যাল আসন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এমসিআই। মুচলেকা দিয়ে কোনও মতে ছাড় পাওয়া গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু এ বার পরিদর্শনে এসে এমসিআই পরিদর্শকরা যদি দেখেন নির্দেশ মানা হয়নি, তা হলে সমূহ বিপদ। পরিস্থিতি সামলাতে নিজেদের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক করছেন কলেজের কর্তারা।

কিন্তু অনুরোধ-উপরোধ-হুমকি কোনও কিছুতেই মিস্ত্রিদের রাজি করানো যাচ্ছে না।

তবে কি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষকেই ভূত তাড়ানোর ওঝা সাজতে হবে? অধ্যক্ষ দেবাশিস ভট্টাচার্য হাসতে হাসতেই বলছেন, “কী আর করব? ভাবছি ফর্মালিনের জার কিংবা আরও সব যন্ত্র দেখিয়ে বলব, ‘এই সব যন্ত্র থাকলে ভূতেরা সেই বাড়ির ছায়াও মাড়ায় না, অতএব কারও কোনও ভয় নেই।’ এতে কাজের কাজ কতটা কী হবে জানি না। কিন্তু আমাদের চেষ্টা তো চালিয়ে যেতে হবে।”

রেডিওলজি বিভাগের চিকিৎসক রেজাউল করিম বললেন, “ভূতের ভয়ে মেডিক্যাল কলেজের কাজ আটকে থাকছে, এমন কথা কেউ কস্মিনকালেও কেউ শোনেননি। এখানে তো সেটাই হচ্ছে। ঝাঁ-চকচকে বাড়ি তৈরি। কিন্তু কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। এমসিআই-এর পরিদর্শকেরা এলে কী কৈফিয়ত দেওয়া হবে জানি না।”

আদতে ভয়টা ঠিক কীসের? বাড়ির পাঁচতলায় সিমেন্ট মাখতে মাখতে এক মিস্ত্রি বললেন, “কে, কোথায় কী ভাবে মারা গিয়েছে, কেউ জানে না। সেই সব বডিগুলো এখানে এনে কাটা হবে। তার পর ডাক্তাররা তো সব সন্ধে হতে না হতেই বাড়ি চলে যাবেন। আমাদের কী হবে? আমরা যারা রাতে থাকি, তাদের তো বেঘোরে প্রাণটা যাবে!” আর এক জনের কথায়, “এখন যেখানে মড়া কাটা হয়, এক রাতে তার পাশ দিয়ে যেতে হয়েছিল। সারাটা রাস্তা রাম-রাম বলতে বলতে গেছি। এ বার যদি বাড়িতেই মড়া কাটা হয়, তা হলে নির্ঘাত পালাব। প্রাণ আগে না কাজ আগে!”

গোটা বিষয়টা জেনে স্বাস্থ্য ভবনের কর্তাদের মাথায় হাত। তাঁদের বক্তব্য, ঠিকাদার নির্দিষ্ট সময়ে কাজ না করলে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা যায়। কিন্তু ভূতের সঙ্গে লড়া হবে কী করে! এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “আমাদের ভাগ্যটাই খারাপ। এমসিআই-এর গেরো আর কাটছে না কিছুতেই! মানুষ কাজ না করলে তার সঙ্গে লড়াই চলে, ভূতেদের সঙ্গে লড়ব কী করে?”

আপাতত তাই ভূত বসেছে শিয়রে। বাকিটা ভবিষ্যৎ বলবে।

soma mukhopadhyay sagar dutta medical fear ghost
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy