ছবি: পিটিআই।
হাতে হাতে মোমবাতি। রাজপথে ধর্না। নির্যাতিতা-নিহতের বিচার আর দোষীদের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ। আট বছরের ব্যবধানে দিল্লিতে ফিরে এল যেন নির্ভয়া আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব।
গোটা দেশ হাথরসের ঘটনায় উত্তাল হলেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজও নীরব এ বিষয়ে। সকাল থেকে মোহনদাস গাঁধী ও লালবাহাদুর শাস্ত্রীর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এবং সন্ধেয় বিজ্ঞানীদের এক ভার্চুয়াল সম্মেলনে দীর্ঘ বক্তৃতা করলেও, হাথরাস নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি সারা দিনে। যা নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী নেতারা। সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরির কথায়, “প্রধানমন্ত্রী নীরব কেন? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই বা কোথায়। দেশে সব চেয়ে বড় রাজ্যটি জুড়েই কেন ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে?”
এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি আজ রাষ্ট্রপুঞ্জের নারী উন্নয়ন সংক্রান্ত আলোচনায় মহিলাদের ক্ষমতায়নে সরকারের ‘অবদান’ নিয়ে সরব হলেন। কংগ্রেস বলল, উত্তরপ্রদেশে মহিলাদের উপর হামলার ঘটনায় নীরব স্মৃতি নির্বিকার ভাবে ভারতে মহিলাদের ক্ষমতায়নের কথা বিশ্বকে বলে বেড়াচ্ছেন! এটা দ্বিচারিতা।
আজ যন্তর মন্তরের সকালটা যদি হয় সুশান্ত সিংহ রাজপুতের, তা হলে বিকেলের পর থেকে অবশ্যই হাথরসের সেই নির্যাতিতা ও নিহত দলিত-কন্যার। বিহার-ভোটের কথা মাথায় রেখে সুশান্তের মৃত্যুর বিচার চেয়ে সকাল থেকে ধর্নায় বসেছিল কয়েকটি সংগঠন। বেলা যত গড়িয়েছে, ততই হাথরস-কাণ্ডে বিচার চাওয়া মানুষের ভিড়ে তারা প্রথমে কোণঠাসা ও পরে কার্যত হারিয়ে যায়।
আরও পড়ুন: দাহের ৪৮ ঘণ্টা পরেও নিভে যাওয়া চিতায় পড়ে রয়েছে নির্যাতিতার অস্থি
বিকেলে হাথরসের ঘটনার প্রতিবাদে ইন্ডিয়া গেটের সামনে জমায়েতের ডাক দিয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশের দলিত সংগঠন ভীম সেনার প্রধান চন্দ্রশেখর আজ়াদ। দিল্লির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দলিত ইউনিয়ন ছাড়াও জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা জড়ো হন ইন্ডিয়া গেট চত্বরে। হাতে পোস্টার। অনেকেই প্রতিবাদ জানাতে কালো পোশাক পরে এসেছিলেন। পিছিয়ে ছিলেন না সাধারণ মানুষ। দুপুরের রোদ পড়তেই তাঁরাও এসে উপস্থিত হতে শুরু করেন ইন্ডিয়া গেট চত্বরে। গত রাত থেকে ১৪৪ ধারা জারি করে রাখা সত্ত্বেও পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে আন্দোলনকারীদের তিন কিলোমিটার দূরে যন্তর মন্তরে গিয়ে প্রতিবাদ জানাতে বলে পুলিশ।
যন্তর মন্তরে বিক্ষোভ পৌঁছলে দিল্লির বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ আসতে শুরু করেন। প্রমাদ গোনে পুলিশ। জনতাকে আটকাতে বন্ধ করে দেওয়া হয় যন্তর মন্তরের কাছাকাছি সব মেট্রো স্টেশন। ঘুরিয়ে দেওয়া হয় গাড়ি। হাথরসের ঘটনা চাপা দিতে আজ দিনভর যোগী আদিত্যনাথের সরকার যত তৎপরতা দেখিয়েছে, ততই প্রতিবাদ জানাতে সাধারণ মানুষ পায়ে পায়ে পৌঁছে গিয়েছেন ধর্নাস্থলে। যন্তরমন্তরে সন্ধ্যা নামতেই হাতে হাতে জ্বলে উঠেছে মোমবাতি। বিক্ষোভ শামিল ছিলেন সিপিএমের ইয়েচুরি, সিপিআইয়ের ডি রাজা। সন্ধে সাতটার পরে যন্তরমন্তরে পৌঁছে বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল। বলেন, “আমি হাতজোড় করে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের কাছে অনুরোধ করছি, দোষীদের যেন দ্রুত ফাঁসি দেওয়া হয়।” যোগীর ইস্তফা ও মোদীর মুখ খোলার দাবি জানান ভীম আর্মির প্রধান চন্দ্রশেখর। যন্তর মন্তরে হাজির অভিনেত্রী স্বরা ভাস্কর বলেন, “বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষজনের এই জমায়েত থেকে স্পষ্ট, মানুষ কতটা ক্রুদ্ধ। দেশে ধর্ষণের মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষত উত্তরপ্রদেশ থেকে এ ধরনের খবর আসছে। এই ধর্ষণের মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করার সময় এসেছে।... আমাদের জিততেই হবে।”
আরও পড়ুন: পুলিশি ধাক্কা তৃণমূলকেও, এসপি-সহ সাসপেন্ড ৫
লাজপত নগর থেকে এসেছিলেন অম্বেডকর কলেজের পিএইচডি-র ছাত্রী প্রিয়া গর্গ। বললেন, “নির্ভয়ার মৃত্যুর পরে আইন বদলেছে। কিন্তু তা মানসিকতা বদলাতে পারেনি।”
গত তিন বছরের যোগী-শাসনে ধারাবাহিক ভাবে উত্তরপ্রদেশে মহিলাদের উপরে অত্যাচারের ঘটনা প্রকাশ্যে আসছে। তাতে হাথরসের সংযোজন রীতিমতো অস্বস্তিতে ফেলেছে বিজেপি নেতৃত্বকে। চাপের মুখে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেছেন, “হাথরসের ঘটনায় দোষীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করা হয়েছে। পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছে প্রশাসন। যা যা করার, সব করা সত্ত্বেও কংগ্রেস পরিকল্পিত ভাবে বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি করছে।”
বিরোধীদের প্রশ্ন, যোগী সরকার সব দিক থেকেও ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও কেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহের জুটি মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে আদিত্যনাথকে সরাতে পারছে না? মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অসংবেদনশীলতার অভিযোগ তুলে সরব হয়েছে কংগ্রেস। বিরোধীদের আজ মুখ খোলার সুযোগ করে দেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি। রাষ্ট্রপুঞ্জের নারী বিষয়ক সম্মেলনে তাঁর বক্তব্য নিয়ে পাল্টা আক্রমণে নামেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। দলের মুখপাত্র সুপ্রিয়া শ্রীনেত বলেন, “অবিশ্বাস্য দ্বিচারিতা স্মৃতি ইরানিজি! উত্তরপ্রদেশে নারী নির্যাতন হলে আপনি চুপ থাকেন। আর এই মঞ্চে নির্বিকার ভাবে মহিলাদের ক্ষমতায়নের কথা বলছেন! সাংসদ বা নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে আপনি শেষ বার কবে নির্যাতিতারদের হয়ে সরব হয়েছেন?” বিরোধীদের অভিযোগ, এই স্মৃতিই কংগ্রেসশাসিত দিল্লিতে নির্ভয়ার উপরে নির্যাতন হয়েছিল বলে পথে নেমেছিলেন। এখন বিজেপিশাসিত রাজ্যে এই ঘটনা ঘটছে বলেই পরিকল্পিত ভাবে নীরব উত্তরপ্রদেশের সাংসদ। অবশ্য স্মৃতি নয় খোদ প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী— নীরব সকলেই। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ নিজে দলিত সমাজের প্রতিনিধি। তিনিও কেন এক দলিত-কন্যার এমন মৃত্যু দেখে নীরব— তা নিয়েও আজ প্রশ্ন তুলেছে যন্তর মন্তরের ভিড়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy