Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
M. M. Kalburgi

আজ প্রতিবাদ না করলে শেষের সে দিনে কাউকে পাশে পাবেন তো!

দাদরির আখলাক থেকে শুরু করে সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে গোরক্ষার নামে একাধিক মুসলমানকে পিটিয়ে খুন করা হয়।

গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।

উজ্জ্বলকুমার চৌধুরী এবং সুনয়ন ভট্টাচার্য্য
শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৮ ১৪:৩৯
Share: Save:

জার্মান লুথেরান যাজক মার্টিন ন্যিমোলার “প্রথমে তারা এসেছিল” নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে। আমাদের এই লেখা ন্যিমোলারের স্মৃতিতে উৎসর্গীকৃত।

প্রথমে তারা মুসলমানদের ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে এগিয়ে এসেছিল, মাংস ভক্ষণ করার অভিযোগে। তারা বিস্মৃত হয়েছিল যে এই মুসলমানেরাই তৈরি করেছে তাজমহল, নির্মাণ করেছে বহু অনিন্দ্যসুন্দর কেল্লা, উপহার দিয়েছে একাধিক রাগ সঙ্গীত, নৃত্যশৈলী ও সুস্বাদু খাবার এবং জন্ম দিয়েছে খসরু, আশফাকুল্লাহ এবং কালামের মতো মনীষীদের। দাদরির আখলাক থেকে শুরু করে সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে গোরক্ষার নামে একাধিক মুসলমানকে পিটিয়ে খুন করা হয়।

তা সত্ত্বেও আমি নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলাম কারণ আমি মুসলমান ছিলাম না।

তারপরে তারা যুক্তিবাদী লেখকদের ধ্বংস করার জন্য এগিয়ে এসেছিল বেশি কথা বলার অভিযোগে। তারা ভুলে গিয়েছিল যে এই লেখকরাই ক্রমবর্ধমান ভারতীয় সমাজের সমষ্টিগত বিবেক রক্ষক, যে সমাজ যুগ যুগ ধরে লালিত কুসংস্কার, সামন্ততন্ত্র এবং রাজকীয় আধিপত্যবাদের মায়াজাল ছিন্ন করে প্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কালবুর্গি, পানসারে এবং গৌরী লঙ্কেশকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

কিন্তু আমি নীরব ছিলাম কারণ আমি লেখক ছিলাম না।

তারপর তারা দলিতদের শেষ করে দিতে তৈরি হয়। কারণ দলিতরা ‘নিচু জাতের এবং তাই তাঁদের নিজেদের গণ্ডি অতিক্রম করার কোনও অধিকার নেই’। তারা এবার ভুলে গিয়েছিল দলিতদের সমাজের প্রতি অবদান, তারা ভুলে গিয়েছিল যে দলিতরা না থাকলে নালা পরিষ্কার করার কেউ থাকবে না, মৃতদেহ দাহ করার কেউ থাকবে না এবং কাপড় কাচবারও কেউ থাকবে না। উনা, শাহজাহানপুর, ভীমা করেগাঁওয়ের মতো জায়গায় বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো উপরের কথাগুলো প্রমাণ করে। যদিও দলিতদের বিরুদ্ধে আক্রমণ আগেও হয়েছে, সংখ্যার হিসেবে এখন তা ক্রমবর্ধমান।

আমি কিন্তু এ বারও চুপ ছিলাম, কারণ আমি দলিত ছিলাম না।

তারপরে তারা ভবঘুরে, বাস্তুহীন এবং মানসিক রোগীদের বিরুদ্ধে এগিয়ে গিয়েছিল কারণ এই হতভাগ্যের দল ‘আমাদের দেশকে নোংরা করে’। তারা এ বার বিস্মৃত হয়েছিল যে এই অসহায় মানুষগুলো এই সমাজেরই বঞ্চনার শিকার। সম্প্রতি অনেকগুলো ঘটনা সামনে এসেছে যেখানে দেখা গিয়েছে, সমাজের সবচাইতে দুর্বল অংশের লোকেরাই গণপিটুনির শিকার হচ্ছে। দেখা গিয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছেলেধরা সন্দেহে এই মানুষগুলোকে হত্যা করা হচ্ছে। যদিও পরে প্রমাণিত হয়েছে এরা কেউই ছেলেধরা নয়, পুরোটাই হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ছড়ানো গুজব।

এ বারও আমি চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কারণ আমি এই হতভাগ্যদের দলের কেউ না।

তারপর তাঁরা আদিবাসীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল কারণ আদিবাসীরা জমি, জঙ্গল ও জল দখল করে রেখেছে এবং এই জমি, জঙ্গল ও জলের ওপরে তাঁদের বন্ধুদের অপরিসীম লোভ। এবার তারা ভুলে গিয়েছিল, এই আদিবাসীরা প্রকৃতির সত্যিকারের রক্ষক। ধরিত্রী মাতা ফলে ফুলে সুজলা ও সুফলা এই আদিবাসীদেরই অবদানে। উদ্ভিদজগৎ, প্রাণীজগৎ, প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং জলের একনিষ্ঠ রক্ষক এই আদিবাসীরা। কিন্তু এই আদিবাসীদের অধিকার খর্ব করে বারে বারে তাঁদের জল, জঙ্গল এবং জমি জলের দরে পুঁজিবাদীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ছত্তীসগঢ়, তেলঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ – সর্বত্রই আদিবাসীদের উৎখাত করা হয়েছে নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দিয়ে। ফলে গত সাত দশক ধরে ভারতের শহরাঞ্চলে কয়েক কোটি জমিহীন শ্রমিকের সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি এই ভবঘুরে শ্রেণির জনসংখ্যা আরও স্ফীত হয়েছে। যদিও এই আদিবাসীদের জঙ্গলে কিছু গৌণ অধিকার দেওয়া হয়েছে, প্রায়শই তা বিভিন্ন কারণে নাকচ করে দেওয়া হয়।

এ বারও আমি চুপ ছিলাম কারণ আমি আদিবাসী নই।

আরও পড়ুন: গো-রক্ষার নামে হিংসা ৪১৫০% বাড়ল এই জমানায়!

তারপর তারা আধুনিক মহিলাদের বিরুদ্ধে এগিয়ে এল। কারণ, তাঁরা রান্নাঘরের চার দেয়ালের মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নন, তাঁরা শাড়ি পরেন না, তাঁরা অন্ধকার নামার আগেই বাড়িতে ফিরে আসেন না, তাঁরা ছেলে বন্ধুদের সাথে নতুন বছর এবং সপ্তাহান্তিক সময় উদযাপন করেন রেস্তরাঁতে, জনসমাগমস্থলে এবং পাবে। এ বারে তারা বিস্মৃত হয়েছিল, এই আধুনিক মহিলারাই ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ কর্মচারী, বিমানচালিকা, সম্পাদিকা, খেলোয়াড় এবং মহাকাশ বিজ্ঞানী। আমরা দেখতে পাই কী ভাবে রাম সেনার গুন্ডাবাহিনী মহিলাদের ওপরে বর্বর আক্রমণ করে, রাতের অন্ধকারে কী ভাবে মানসিক বিকারগ্রস্থ ট্যাক্সিচালকেরা মহিলাদের ধর্ষণ করে, নতুন বছরের প্রাক্কালে মেয়েদের ওপরে কী ভাবে বর্বরোচিত আক্রমণ হয়।

এ বারও আমি চুপ ছিলাম কারণ আমি মহিলা নই।

তার পরে তারা খ্রিস্টানদের শেষ করতে এগিয়ে এল, কারণ তাঁরা খ্রিস্টকে ভজনা করে এবং রোমের সামনে মাথা নত করে। এ বারে তারা ভুলে গিয়েছিল খ্রিস্টানদের ভারতীয় স্বাস্থ্য-সেবায় এবং শিক্ষাপ্রসারে যুগান্তকারী অবদান এবং তাঁদের সামাজিক অবদানের কথা। একজন যাজক এবং তাঁর ছেলেকে নৃশংসভাবে জিপের ভেতরে পুড়িয়ে মারা হয়। মাদার টেরেসা-প্রতিষ্ঠিত মিশনারিজ অব চ্যারিটির বিরুদ্ধে শিশুপাচারের মিথ্যা প্রচার করা হয়। পরে প্রমাণিত হয়েছিল, এই অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা। দেশের দুর্গম অঞ্চলসমূহে স্কুলে এবং হাসপাতালে কর্মরতা নানদের ধর্ষণ করা হয়।

এ বারও আমি চুপ ছিলাম কারণ আমি খ্রিস্টান নই।

আরও পড়ুন: নিকা হালালায় নারাজ, মারার হুমকি ফরজ়ানাকে

শেষে তারা আমার প্রতি ধাবিত হল এবং আমার জন্য এ বার কেউ দাঁড়াল না কারণ আমি কারও জন্য দাঁড়াই নি।

মুখ খুলুন এবং প্রতিবাদ করুন, সব শেষ হয়ে যাওয়ার আগে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE