Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
China

বিশ্বে ৪১ শতাংশ হ্যাকিং চিন থেকে! চিনা অ্যাপ মানেই কেন সন্দেহজনক

চিন কিন্তু ভারতকে ঘিরছে। নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় কিন্তু আজ চিনের আধিপত্য আমাদের থেকে অনেক বেশি।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

সুপর্ণ পাঠক
শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০২০ ২০:৩৭
Share: Save:

গোলাং। করোনার মতোই হঠাৎ এর নাম ভাসতে শুরু করেছে। করোনা যেমন তার প্রাথমিক ছোবলে শুধুই আমাদের কাছে কৌতুহলের বিষয় ছিল, আপাতত ইনিও তাই। বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যমেই এর কোনও উল্লেখ নেই। কিন্তু গবেষকরা এনাকে নিয়ে চিন্তিত। কারণ, ইনি একটি ম্যালওয়্যার। করোনা যেমন আপনার অজান্তে নাক বা মুখের ফুটো দিয়ে ঢুকে পড়ে, তেমনই গোলাং নাকি উইনডোজ বা লিনাক্স কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেমে বাসা বাঁধতে চাইছে। না আপনার চিন্তা নেই এখনও, যদি না আপনি ক্রিপটো কারেন্সি মোনেরোতে বিনিয়োগ করতে চান। আপাতত তিনি তাঁদেরই বেছে নিয়েছেন যাঁরা মোনেরোতে মনোযোগী। এবং করোনার মতো এনারও উৎস সেই চিন

এবিসি নিউজের একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে— বিশ্বে ২০১২ সাল থেকে এযাবৎ যত হ্যাকিং হয়েছে, তার প্রায় ৪১ শতাংশই হয়েছে চিন থেকে। এবং এর একটা বড় অংশই হয়েছে অন্য দেশের আর্থিক বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে।

আমাদের স্মৃতি তত সবল নয়। তাই আমরা ভুলে গিয়েছি কুদরেমুখ পরমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের গোপন তথ্য কাড়তে হ্যাকিং হয়েছিল, এবং তখনই বিশ্বজুড়ে ভারতের হ্যাকিং-এর বিরুদ্ধে লড়াই করার সামর্থ নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল। বিশেষ করে ঠিক একই সময় সিঙ্গাপুরের একটি সমীক্ষা সংস্থা যখন বলে যে ভারতের কয়েক লক্ষ ব্যাঙ্কের গ্রাহকের তথ্য কিন্তু আর গোপন নেই। এর পরপরই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আর্থিক সংস্থাগুলিকে তথ্য গোপন রাখতে কম্পিউটার ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে তোলার পরামর্শ দেয়। এবং এই তথ্য চুরির পিছনেও চিনের হাত থাকার অভিযোগ উঠেছিল।

এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে— চিন তাদের আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী অবস্থান থেকে বিশ্ববাজারে আধিপত্য কায়েম করতে যা যা করা দরকার, তা সুযোগ পেলেই করে ফেলবে। আজকের দুনিয়ায় পেশীর বলের থেকেও অনেক বেশি শক্তিশালী আর্থিক বল, আর তা ব্যবহার করতে দু’বারও ভাবে না চিন। আর তা করে সেই সামন্ততান্ত্রিক পথেই। রাস্তাটা সোজা। উন্নয়নের গাজর দেখিয়ে ঋণগ্রস্ত করে তার পর নিজের আধিপত্য বিস্তার করা।

২০১৯ সালে ঠিক এই রাস্তাতেই শ্রীলঙ্কাকে তাঁবে আনে চিন। কলম্বোর অনতিদুরে সমুদ্রের উপর ২৬৯ হেক্টরের একটি দ্বীপ। এই দ্বীপটি তৈরি করতে চিন ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল শ্রীলঙ্কাকে। আর তার বিনিময়ে ৯৯ বছরের লিজে এই বন্দর দ্বীপটি একচ্ছত্র ব্যবহার করার অধিকার নিয়েছে চিন। আমরা জানি শ্রীলঙ্কা ভারতের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। অথচ শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের ১৪ শতাংশই চিনের কাছ থেকে পাওয়া। আর সেখানে ভারতের কাছ থেকে পাওয়া অংশ মাত্র ২ শতাংশ।

আরও পড়ুন: অফলাইন হয়ে গেল টিকটক, ‘নিষিদ্ধ’ বার্তা দিয়ে সুরক্ষার আশ্বাস কর্তৃপক্ষের

চিন কিন্তু ভারতকে ঘিরছে। নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় কিন্তু আজ চিনের আধিপত্য আমাদের থেকে অনেক বেশি। এতটাই যে, পোর্ট সিটি কলম্বো প্রকল্পটি এসইজ়েড প্রকল্প হিসাবে তৈরি হয়েছে এবং তার জন্য যে আইন করা হচ্ছে তা নাকি অনেকটাই হংকং-এর ধাঁচেই। এতটাই যে ওই দ্বীপের উপর চিনের আধিপত্য কার্যত প্রশ্নাতীত হবে।

এর সঙ্গে আজ আমাদের ৫৯টি চৈনিক অ্যাপের ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞার সম্পর্ক কী? এই প্রসঙ্গে আসার আগে আরও একটি বিষয় আমরা মনে করে নিই। বিশ্ব নিয়ে চিনের সাম্রাজ্যবাদী অবস্থান কিন্তু খুব স্পষ্ট। এশিয়ায় তারা দ্বিতীয় কোনও শক্তিকে উঠতে দেবে না। আর বিশ্বে তারা কষ্ট করে হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া তৃতীয় কোনও শক্তিকে মানবে না। ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে তাই চিনের সঙ্গে গত দুই দশক ধরে একটা দূরত্ব রেখেই সহাবস্থান নীতি মেনে চলা হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে অবশ্য এই নীতির সীমারেখা ভেঙেই চিনের সঙ্গে গলায় গলায় ভাব করার একটা চেষ্টা করা হয়েছিল চিনের সাম্রাজ্যবাদী অবস্থান ভুলে, শুধু বিনিয়োগ টানার লোভেই।

উল্টোদিকে কিন্তু চিন তাদের দেশে ভারতের বিনিয়োগকে কোনও দিনই পাত্তা দিতে চায়নি। ইনফোসিসের মতো তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থারা বহু চেষ্টা করেও অফিস খুলতে পারলেও, বাজার ধরার দৌড়ে প্রতি পায়েই চৈনিক দেওয়ালে মাথা কুটে মরেছে বলে অভিযোগ।

আরও পড়ুন: সাংবাদিক সেজে ঘুরছে চিনা স্পাই! কড়া নজরদারিতে রয়েছি আমরাও

বিশ্বে বহু সংস্থা আছে যাদের কাজই হল হ্যাকাররা কী জাতীয় আঘাতের পরিকল্পনা করছে তার হদিস রাখা। ২০১৭ সাল থেকেই কিন্তু এই জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থারা ভারতকে সতর্ক করতে শুরু করেছিল। অভিযোগ ছিল, চিন ভারতের অর্থনীতিকে দুর্বল করতে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্থার তথ্য চুরি করতে চলেছে। ২০১৩ সালে আরপিজি লাইফসায়েন্সের আড়াই কোটি টাকা ইয়েস ব্যাঙ্ক থেকে মেরে দিয়েছিল। তাই নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে নানান চাপানউতোর চললেও, এর মধ্যেও চিনের হাত দেখেছিল অনেকেই। এর ফলে যেটা হয়েছিল তা হল, ইয়েস ব্যাঙ্কের উপর আপনার আমার আস্থা নড়ে গিয়েছিল। আর চিন কিন্তু সেটাই চায়।

ফিরি চিনের অ্যাপ প্রসঙ্গে। এই অ্যাপগুলি, ব্যবহারকারীর ফোনের অধিকার চায়। আপনার অ্যাড্রেস বুক, ক্যামেরা-সহ আরও নানান তথ্য। আপনি কোথায় আছেন তাও ওরা জানতে চায় লোকেশন সার্চের মাধ্যমে। এ বার আপনি কার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, কী ভাবে করছেন তাও জানার চেষ্টা করতে পারে এই অ্যাপগুলি। এই সব তথ্যকে এক জায়গায় করে তার অনৈতিক ব্যবহার করা সম্ভব যদি দেশের আইন অতটা কড়া না হয়, অথবা সরকারই নিজে তা করতে উৎসাহ দেয়। আর সেই তথ্যকে একজোট করেই কিন্তু কোনও দেশের অর্থনীতিকে আঘাত করা সম্ভব। অভিযোগ ভারতের ক্ষেত্রে চিন ঠিক তাই করতে চাইছে।

ভারত সরকারের দাবি— এই বহুল প্রচলিত ৫৯টি অ্যাপের মাধ্যমেই চিন ভারতীয় নাগরিকদের সম্পর্কে আপাত নিরীহ কিন্তু একজোটে মারাত্মক তথ্য নিরন্তর সংগ্রহ করে চলেছে। যা সময় সুযোগ মতো ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহারও করে চলেছে। যাতে অর্থনীতির ভিত নড়ে যায়।

অভিযোগ, চিন যুদ্ধটা চালাচ্ছে শুধু সীমান্ত দখলের নয়। চিন চাইছে ভারতের শক্তি খর্ব করতে। এক দিকে প্রতিবেশী দেশগুলিকে নিজেদের তাঁবেতে রেখে ভারতকে সীমান্তবন্দি করে রাখা। চার সীমান্তেই অশান্তি থাকলে ভারতের উন্নয়ন থেকে খরচ ঘুরবে দেশরক্ষার খাতে। তাতে ভারতের বৃদ্ধির হার খোঁড়া হবে। পাশাপাশি, ক্রমাগত গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ক্ষেত্রে হ্যাকিং হলে ভারতের আর্থিক নিরাপত্তারও দফারফা হবে।

একটা তথ্য এই প্রসঙ্গে একটু দেখে নেওয়া জরুরি। ২০১৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ভারতে চিনা বিনিয়োগ বেড়েছে সাত গুণ। মাথায় রাখতে হবে চিনা বেসরকারি বিনিয়োগ কিন্তু আমাদের দেশের মতো নয়। প্রতিটি বিনিয়োগের সঙ্গে চিন সরকারের সংযোগ কিন্তু কার্যত আমাদের দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থার থেকেও বেশি। আর আমরা কিন্তু জেনেশুনেই চিনা বিনিয়োগ অকাতরে টেনে এনেছি। আমাদের গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর প্রেক্ষিতে কী করা যেত বা যেত না, সেটা অন্য প্রশ্ন। আমরা চিনের আগ্রাসী মনোভাব জেনেও কিন্তু এগিয়ে গিয়েছি সাবধান না হয়েই। যা করোনাকালে মাস্ক ব্যবহার না করারই সমতুল্য। আজ কিন্তু আমাদের অর্থনীতির প্রেক্ষিতে চিনের গুরুত্ব অপরিসীম। সে ওষুধের ব্যবসাতেই হোক, বা রসায়নে। গাড়ির যন্ত্রাংশে বা খেলনায়।

অভিযোগ সত্যি হলে চিন যেমন চিনে নিয়েছে আমাদের দেশের সীমান্তকে, তেমনি হ্যাকিংয়ের এই রণনীতিতে কিন্তু চিন আমার আপনার ব্যবহারিক সীমাকেও বুঝে গিয়েছে একই ভাবে। আমরা জানতাম। কিন্তু আগেই কেন কিছু করিনি? তার মূলে কি নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে মূল্য না দেওয়ার অভ্যাস? এর ফলে কিন্তু গোটা দেশই আজ বিপদের মুখে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE