Advertisement
E-Paper

বিশ্বাসহীনতার গল্প শোনায় ‘চায়ে পে চর্চা’র গ্রাম ডাভড়ি

বিস্ময়ের কারণও আছে অবশ্য। নাগপুর থেকে পান্ধারকৌড়া (এই মরাঠি শব্দের বাংলা অর্থ সাদা তুলো) হয়ে জঙ্গল আর রুখু পথ উজিয়ে এ গ্রামে আসতে গেলে পেরোতে হয় প্রায় ২৩০ কিলোমিটার।

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৯ ১২:১০
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

এই দুপুরের ঠা ঠা রোদেও যে গ্রামের পানের দোকান ঘিরে ছেলে-বুড়োর দল আড্ডা দিচ্ছে, সত্যি বলতে কি, এমন দৃশ্য দেখব বলে ভাবিনি! বিদর্ভের প্রত্যন্ত গ্রামের পথে এই চৈত্রই যদি এমন প্রবল তাপ ছড়ায়, তা হলে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে কী হবে ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলাম।

রোদের হলকা শুকিয়ে দিচ্ছে একেবারে। খাঁ খাঁ পথ ধুলো ওড়াচ্ছে হাওয়ায়। মাঠে এখন ফসল নেই। সেই শুকনো মাঠ ফুটিফাটা হয়ে জন্ম দিয়েছে অসামান্য আল্পনার। শিরিষ গাছের ডাল হাওয়ায় দোলে।

নানা কথা ভাবতে ভাবতে এগনোর পথেই আমন্ত্রণ আসে। ‘‘ভিতরে চলে আসুন। কোথায় যাবেন?’’ ভিতর বলতে পানের দোকানের পাশে এক চিলতে ঘেরা জায়গা, মাথার উপরে ছাউনি, নীচে লোহার বেঞ্চ পাতা। সেই বেঞ্চে চায়ের আড্ডায় দুই প্রৌঢ়। জানাই, তাঁদেরই গ্রাম দেখতে এসেছি। অবাক হন তাঁরা। প্রশ্ন ছুড়ে দেন, আসছেন কোথা থেকে? নাগপুর থেকে শুনে রীতিমতো বিস্মিত তাঁরা।

বিস্ময়ের কারণও আছে অবশ্য। নাগপুর থেকে পান্ধারকৌড়া (এই মরাঠি শব্দের বাংলা অর্থ সাদা তুলো) হয়ে জঙ্গল আর রুখু পথ উজিয়ে এ গ্রামে আসতে গেলে পেরোতে হয় প্রায় ২৩০ কিলোমিটার।

আচমকাই বসে থাকা দুই প্রৌঢ়ের এক জন কোউরজি ভারত চহ্বাণ বলে ওঠেন, ‘‘চায়ে পে চর্চা’? বুঝতে পেরেছি।’’

ঠিকই ধরেছেন মানসিংহ! এই সেই ডাভড়ি গ্রাম। এখানেই ২০১৪-র ২০ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী-পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী ‘চায়ে পে চর্চা’ করে যান। মোদী তখন ‘চায়ে পে চর্চা’র প্রচারে ঝড় তুলেছেন। তাঁর প্রচারের অঙ্গ হিসাবেই বেছে নেওয়া হয়েছিল যবতমাল জেলার আরনি তহশিলের অন্তর্গত এই ডাভড়ি গ্রামকে।

স্থানীয় মানুষজন জানাচ্ছেন, গ্রামের মাঠের সেই ‘চর্চা’য় মোদী বলেছিলেন, কাউকে পিছিয়ে রাখব না। সকলকে নিয়ে একসঙ্গে এগনো হবে। কৃষিপণ্যের সহায়ক মূল্য দ্বিগুণ করা হবে। উন্নয়ন হবে।

কী রকম উন্নতি হল তার পর?

‘‘উন্নতি? কোথায়? কিচ্ছু হয়নি। গত পাঁচ বছরে কিচ্ছু হয়নি।’’ক্ষোভ উগরে দেন লক্ষ্মণ রাঠৌর, ‘‘আমরা বৃষ্টির ভরসায় চাষ করি। সেচের ব্যবস্থা নেই।’’

ডাভড়ি গ্রামে প্রবেশের মুখে তোরণ। —নিজস্ব চিত্র

ভোট আসছে। এই ডাভড়ি গ্রামের অবস্থান যবতমাল জেলায় হলেও এটি মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। এখানকার বিদায়ী সাংসদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হংসরাজ আহির। বিজেপির এই হেভিওয়েট প্রার্থী ২০১৪-য় চতুর্থবারের জন্য লোকসভায় মনোনীত হন। তাঁর বিরুদ্ধে কংগ্রেস এই কেন্দ্রে একেবারে শেষ মুহূর্তে দাঁড় করিয়েছে সুরেশ ধানোরকরকে। সুরেশ এর আগে শিবসেনার বিধায়ক ছিলেন। কয়েক দিন আগে তিনি শিবসেনা ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দেন।

এই মাঠেই বসেছিল ‘চায়ে পে চর্চা’র আসর। —নিজস্ব চিত্র

আরও পডু়ন: তামিল ভোট মাথায় থাক! ‘বেঙ্গলে’ ক’টা পাবে তৃণমূল?

আরও পডু়ন: জোটে ‘না’ করেছেন কংগ্রেস সভাপতিই, এ বার সরাসরি রাহুলকেই কাঠগড়ায় তুললেন কেজরীবাল

এর আগে এই কেন্দ্রের প্রার্থী হিসাবে কংগ্রেস বিনায়ক বাঙ্গাড়ের নাম ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সেই নাম নিয়ে কংগ্রেসের অন্দরে বিস্তর জলঘোলা হয়। মহারাষ্ট্র প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অশোক চহ্বাণ তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। কংগ্রেসের এক কর্মীর সঙ্গে টেলিফোনে তাঁর কথোপকথন ফাঁস হয়ে যায় বলে অভিযোগ। ভাইরাল হওয়া সেই অডিয়ো টেপে তিনি এমনকি, তাঁর পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। এর কয়েক দিনের মধ্যে কংগ্রেস চন্দ্রপুর কেন্দ্রে প্রার্থী বদলের ঘোষণা করে।

এটা তো গেল রাজনীতির সমীকরণ। কিন্তু এই সমীকরণে ডাভড়ির কি সত্যিই কিছু যায় আসে?

‘‘কিছুই আসে যায় না। ‘চায়ে পে চর্চা’র পরে মোদী প্রধানমন্ত্রী হন। মোদী প্রচুর আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের আশা ছিল, আমরা ভাল থাকব, চাকরি পাব। সুখে থাকব। কিন্তু তার বদলে কী হল?’’ প্রশ্নটা ছুড়়ে দিলেন যিনি, তিনি এ বারের প্রথম ভোটার। নাম বিপুল মানকর। বারো ক্লাসের পর আর পড়াশোনা হয়নি। পারিবারিক রোজগার তুলো চাষ থেকে। কিন্তু তিনি চান চাকরি পেতে, যা এই সরকারের কাছ থেকে পাবেন বলে বিশ্বাসও করেন না।

যেমন, বিপুলের বন্ধু দীনেশ গঙ্গাধর শাঠেও মনে করেন, মোদীর বিস্তর আশ্বাসের পরেও কোনও উন্নতি হয়নি গ্রামের। ‘‘চায়ে পে চর্চা’য় মোদী বলেছিলেন, অনেক কিছু করে দেবেন। হংসরাজজিও অনেক আশ্বাস দেন। কিন্তু কিছু হয়নি। গ্রামের ছেলেরা বেকার। পাঁচ বছর ধরে অনেক ভরসা করেছিলাম। কিন্তু এ রকম চললে বিজেপির হাতে কিছু থাকবে না।’’

মনে রাখতে হবে, দীনেশও এ বার প্রথম ভোট দেবেন। একেবারে নতুন নির্বাচক। কিন্তু যাঁরা পুরনো মানুষ? যাঁরা বহু নির্বাচন দেখেছেন, মোদীর ‘চায়ে পে চর্চা’র কথা স্পষ্ট মনে আছে যাঁদের, তাঁরা কী বলছেন?

মোদীজির ‘চায়ে পে চর্চা’য় গিয়েছিলেন? আপনার বাড়ির পাশেই তো হয়েছিল?

বাড়ির সামনে রাস্তার ধারে বসেছিলেন কোউরু মানসিংহ চহ্বাণ। সোজা হয়ে বসেন তিনি, ‘‘চায়ে পে চর্চা’! কিন্তু সে আর যেতে পারলাম কোথায়!’’ এ বার অবাক হওয়ার পালা আগন্তুকের। তার মানে? মানসিংহ বলতে থাকেন, ‘‘আরে, আমাদের লাইনের সব বাড়ির বাইরের দরজায় বাঁশ বেঁধে দিয়ে পুলিশ-সিআরপি সবাইকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। কাউকেই বেরোতে দেয়নি। আমার বাড়ির ছাদেও তো বন্দুক নিয়ে ওরা ছিল। বলেছিল, সভা শেষ করে মোদী চলে যাওয়ার পরে বেরোতে পারব! না হলে মোদীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।’’

ডাভড়ি গ্রামে নিজের বাড়ির সামনে বসে মানসিংহ চহ্বাণ। —নিজস্ব চিত্র

তা হলে গেলেন কারা! গ্রামের জমে থাকা ভিড় জানায়, প্রচুর বাইরের লোক এসেছিল। ওরাই মাঠ ভরিয়ে দেয়। গ্রামের অল্প মানুষই সুযোগ পেয়েছিলেন মোদীর ‘চায়ে পে চর্চা’য় যাওয়ার!

যেমন গিয়েছিলেন ভারত চহ্বাণ। কিন্তু মোদীর সঙ্গে কথা বলা তো দূরস্থান, তাঁকে দেখতে হয়েছিল অনেক দূর থেকে!

চাষবাসের অবস্থা কেমন? মানসিংহ জানান, আরনি মসোলা জঙ্গল এলাকায় তাঁর কৃষিজমি। কিন্তু সেখানে বন্যজন্তুর ভয়। বন দফতর বা সরকার কিছু করে না। তার উপরে অনাবৃষ্টি। তুলো, সয়াবিন, ছোলার চাষ মার খায় বিদর্ভের অন্যান্য এলাকার মতো এই এলাকাতেও।

বিদর্ভ কিছুতেই অন্য কিছু শোনায় না কেন!

২০১৪-র ২০ মার্চই কিন্তু ‘চায়ে পে চর্চা’ শেষ হয়ে যায়নি। বরং শুরু হয়েছিল সে দিন থেকে! এখন গ্রামের আমআদমিই ‘চায়ে পে চর্চা’ করেন। কিন্তু তার বিষয়বস্তু পাল্টে গিয়েছে!

সেই ‘চর্চা’য় এখন বিশ্বাসহীনতা আর প্রতারণার অভিযোগের চর্চা হয় বেশি!

Lok Sabha Election 2019 Maharashtra Vidarbha Narendra Modi Chaye pe Charcha
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy