জলির কীর্তিতে হতভম্ব পুলিশও। ফাইল চিত্র
পরিবারের সকলের সঙ্গে ডিনারে বসে মটন স্যুপ খাচ্ছিলেন বৃদ্ধা আন্নামা থমাস। স্যুপ শেষ হওয়ার আগেই দম আটকে মারা গেলেন তিনি। দু’বছরের মেয়ে অ্যালপাইনের মৃত্যুটা আরও মর্মান্তিক। খাবার টেবিলেই জলের গ্লাসে চুমুক দিয়েই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায় শিশুটি। কেরলের গৃহবধূ জলির কীর্তির সন্ধানে নেমে এমন মোট ৬টি অস্বাভাবিক মৃত্যু নজরে এসেছে কেরল পুলিশের। এতগুলি খুন, কিন্তু হত্যাকারী ভাবলেশহীন দেখে প্রাথমিক ভাবে পুলিশ অনুমান করেছিল, জলি মনোরোগী। তবে তদন্ত যত এগোচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে পুলিশের অনুমান, নিছক মনোরোগই নয়, ১৭ বছর ধরে লাগাতার খুনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। থমাস পরিবারের সম্পত্তি দখল করতেই একের পর এক খুন করেছে জলি।
কেরল পুলিশের তদন্তকারী অফিসার কে জি সিমন বলছেন, ‘‘জলিকে শুধুই মনোরোগী বললেই হবে না। প্রাক্তন শ্বশুর শ্বাশুড়ি টম টমাস ও আন্নাম্মা টমাস খুনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। পরিবারের সর্বময় কর্তা ও কর্ত্রীকে সরিয়ে দিলে চালকের আসনে বসা যাবে এমনটাই ভেবেছিল জলি। তাঁর মূল লোভ ছিল থমাস পরিবারের সম্পত্তিতে।’’ শুধু কেরল পুলিশই নয়, এই একই কথা বলেছেন জলির দেওর রোজোও। তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন, আন্নাম্মা ও টমের বাড়ির দলিলও নকল করেছিল জলি। অর্থাৎ প্রথম থেকেই টমাস পরিবারের সম্পত্তির মালিকানা পাওয়াই ছিল জলির মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্যপূরণে যাদের বাধা মনে হয়েছে, তাদেরই একে একে সরিয়েছে জলি। কী ভাবে?
টার্গেটকে পৃথিবীকে সরাতে জলির অস্ত্র ছিল সায়ানাইড। পুলিশের দাবি, জলি প্রথম খুন করেছিল ১৭ বছর আগে। ২০০২ সালে খাবার টেবিলে বসে মটন স্যুপ খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যু হয় আন্নামা থমাসের। ওই স্যুপেই সায়ানাইড মিশিয়েছিল জলি। এর ছ’বছর পরে আন্নাম্মার স্বামী টম মারা যান। পুলিশ সূত্রে খবর, জেরায় জলি জানিয়েছে, টমকেও খাবারে সায়ানাই়়ড মিশিয়ে খুন করেছিল সে। ২০১১ সালে জলির প্রাক্তন স্বামী রয়কে বাথরুমে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ময়নাতদন্তে তাঁর পাকস্থলীতে সায়ানাইড পেয়েছিল পুলিশ। কিন্তু কোনও অতিরিক্ত তথ্য না পেয়ে তদন্ত মাঝপথেই বন্ধ করতে বাধ্য হয় পুলিশ। সকলে সিদ্ধান্তে আসেন, আর্থিক সমস্যার জেরে আত্মহত্যা করেছেন রয়। এই ধারাবাহিক মৃত্যুতে সন্দেহ হয়েছিল আন্নাম্মার ভাই ম্যাথু মানজাদিলির। তিনি তদন্তের জন্য পুলিশকে চাপও দেন। বিপদ এড়াতে তাকেও একই ভাবে সরায় জলি। পুলিশের দাবি,ম্যাথুর কফিতে একই কায়দায় বিষ মেশানো হয়েছিল।
আরও পড়ুন: আরও খুনের পরিকল্পনা ছিল জলির! কেরল সিরিয়াল কিলার রহস্যে নয়া মোড়
আরও পড়ুন: মা সিরিয়াল কিলার? বিশ্বাস হচ্ছে না ছেলের, জলি সাইকোপ্যাথ বলেই সন্দেহ পুলিশের
সম্পত্তির দখল পেতে কোনও মতেই পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না। কারণ লক্ষ্য একটাই, বাড়ির দখল নেওয়া। তাই এই খুনগুলি চলাকালে জলি ভেবেচিন্তেই সম্পর্কে জড়িয়েছিল রয়ের খুড়তুতো ভাই সাজুর সঙ্গে। ততদিনে সাজুও নি:সঙ্গ। জলিই সরিয়েছে সাজুর প্রাক্তন স্ত্রী ও মেয়েকে। জল খেতে গিয়ে হেঁচকি উঠে মারা যায় দু’ বছরের অ্যালপাইন।
পুলিশের দাবি, জলির শেষ লক্ষ্য ছিল ননদ ও প্রাক্তন স্বামীর পরিবারের অন্য দুই দুই শিশু। জলি ভেবেছিল এরা সরে গেলেই আর কোনও বাধা থাকবে না থমাস পরিবারের সম্পত্তি দখলে। তবে ননদকে খুনের চেষ্টা ব্যর্থ হতেই সতর্ক হয়ে যায় সে।
বুধবার রয় থমাসের এক কাকিমা এলসাম্মা সংবাদমাধ্যমে জানান ২০০২ সালে তাঁর ছেলে বাইক অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। রয়ের এক তুতো ভাইও গলায় দড়ি দেন। তিনি দাবি করেন, আরও দুটি খুনের পিছনেও জলির হাত রয়েছে।
আরও পড়ুন:যাদবপুরের গবেষক ছাত্রের ঝুলন্ত দেহ মেসে
পুলিশ জানাচ্ছে, এতবড় হত্যাকাণ্ড জলি একা ঘটায়নি। তাঁকে প্রথম থেকে সাহায্য করত তাঁর এক আত্মীয় এমএস ম্যাথু। ম্যাথুই ছিল সায়ানাইডের জোগানদার। সায়ানাইড আসত প্রজিকুমার নামক এক স্বর্ণকারের কাছ থেকে। পুলিশ তাঁদের দু’জনকেও গ্রেফতার করেছে।
এই সিরিয়াল কিলিংয়ের রহস্য ভেদ করতে ইতিমধ্যেই বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করেছে কেরল পুলিশ। ইতিমধ্যে খুনের দায় স্বীকারও করেছে জলি। এ যাবৎ তদন্তের অগ্রগতি ইতিবাচক। তবে জলির অপরাধের কূল কিনারা পেতে যে কালঘাম ছুটছে গোটা কেরল পুলিশের, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy