Advertisement
E-Paper

পানীয় জলে বিষ মেশায় এই দুই ব্যাকটেরিয়া, হদিশ মিলল এই প্রথম

এই ব্যাকটেরিয়ারা বেঁচে থাকে অত্যন্ত বিষাক্ত ধাতু ম্যাঙ্গানিজ খেয়ে। যে বিষাক্ত ম্যাঙ্গানিজকে খাওয়ার জল থেকে সরানোটা এখনও পর্যন্ত বেশ দুঃসাধ্যই।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২০ ০৮:০৬
সেই ম্যাঙ্গানিজ খেকো ব্যাক্টিরিয়া। প্রতীকী ছবি।

সেই ম্যাঙ্গানিজ খেকো ব্যাক্টিরিয়া। প্রতীকী ছবি।

খাওয়ার জলকে কি এ বার আরও বেশি করে বিষমুক্ত করা যাবে? পানীয় জলকে দূষিত করার অন্যতম দুই ‘কারিগরে’র এই প্রথম হদিশ মেলায় সেই সম্ভাবনাই জোরালো হয়ে উঠল। শত্রু চিহ্নিত হওয়ায় পানীয় জলকে হয়তো এ বার আরও নিখুঁত ভাবে পরিস্রুত করা সম্ভব হবে।

এই কারিগররা হল নতুন দু’টি প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া। যারা বেঁচে থাকে পানীয় জলে মিশে থাকা অত্যন্ত বিষাক্ত ধাতু ম্যাঙ্গানিজ খেয়ে। যে বিষাক্ত ম্যাঙ্গানিজকে খাওয়ার জল থেকে সরানোটা এখনও পর্যন্ত বেশ দুঃসাধ্যই। আর খাওয়াদাওয়ার পর তারা আরও বিষাক্ত পদার্থ মেশায় পানীয় জলে। তাদের বংশবৃদ্ধি করতে।

ম্যাঙ্গনিজ খেয়ে বেঁচে থাকা নতুন এই দু’টি প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার আবিষ্কারের গবেষণাপত্রটি বেরিয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার’-এ। ১৬ জুলাই সংখ্যায়। এই প্রথম কোনও ব্যাকটেরিয়ার হদিশ মিলল যারা বেঁচে থাকে, বেড়ে ওঠে অত্যন্ত বিষাক্ত ধাতু ম্যাঙ্গানিজ খেয়ে। গবেষকদলের অন্যতম সদস্য এক বঙ্গসন্তান। ‘ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (ক্যালটেক)’-র পোস্ট ডক্টরাল গবেষক অগ্নিভ মিত্র।

সদ্য আবিষ্কৃত এই দুই প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার নাম দেওয়া হয়েছে, ‘ক্যান্ডিডেটাস ম্যাঙ্গানাইট্রোফাস নোডুলিফরম্যান্স’ এবং ‘রামলিব্যাকটার লিথোট্রফিকাস’।

কী ভাবে খোঁজ মিলল এই দুই ব্যাকটেরিয়ার?

অন্যতম প্রধান গবেষক ‘ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (ক্যালটেক)’ অধ্যাপক জারেড লেডবেটার ওয়াশিংটন থেকে পাঠানো ই-মেলে ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে বলেছেন, ‘‘গবেষণাগারের কাচের জারটা যদি ট্যাপ ওয়াটারে ধুয়ে পরিষ্কার করার কথা না ভাবতাম, তা হলে হয়তো এদের কথা জানতেই পারতাম না কোনও দিন!’’

সেই চমক দেওয়া ঘটনা...

নতুন দুই প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কারের যে কাহিনী শুনিয়েছেন জারেড, তার নির্যাসটুকু তুলে ধরছি।

অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখা এই সেই দুই ম্যাঙ্গানিজ-খেকো সদ্য আবিষ্কৃত ব্যাকটেরিয়া। ছবি- গবেষকদের সৌজন্যে।

লেডবেটার তাঁর গবেষণাগারে কাজ করছিলেন একটি গোলাপি রঙের যৌগিক পদার্থ নিয়ে। তার নাম ম্যাঙ্গানিজ কার্বনেট। সেটি রাখা ছিল একটি কাচের জারে। কিছুতেই জারটিকে পরিষ্কার করতে পারছিলেন না জারেড। ভাবলেন জলে ধুয়ে নেবেন জারটা। তাতেই গোলাপি রঙের ম্যাঙ্গানিজ কার্বনেট দ্রবীভূত হয়ে গিয়ে কাচের জারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। সেই ভেবেই ট্যাপ ওয়াটার দিয়ে কাচের জারটি ভরিয়ে রেখে শহর থেকে একটি দূরে পড়াতে চলে গিয়েছিলেন জারেড। গবেষণাগারে ফিরে আসেন আড়াই মাস পর। অবাক হয়ে দেখেন কাচের জারটা একেবারে কালো হয়ে গিয়েছে। আর তাতে জমাট বেঁধে রয়েছে শক্ত একটা পদার্থ। ওই পদার্থটি আসলে ম্যাঙ্গানিজ অক্সাইড। খাওয়ার জল থেকে ভূগর্ভ, পৃথিবীর সর্বত্রই পাওয়া যায় এই ম্যাঙ্গানিজ অক্সাইড।

কেন কাচের জারটা কালো হয়ে গেল?

জারেড জানিয়েছেন, আমরা আঁচ করলাম, ট্যাপ ওয়াটারের জলে থাকা ব্যাকটেরিয়াই কাচের জারে থাকা ম্যাঙ্গানিজ কার্বনেট থেকে ইলেকট্রন বের করে নিয়ে ওই কালো রঙের ম্যাঙ্গানিজ অক্সাইড তৈরি করেছে। না হলে আর কোনও ভাবে তো কালো রঙের ম্যাঙ্গানিজ অক্সাইড তৈরি হতে পারে না কাচের জারে। জলে ম্যাঙ্গানিজ থাকে, এটা কারও অজানা নয়।

আরও পড়ুন- বিষে বিষে বিষক্ষয়! ভয়ঙ্কর মানসিক রোগ সারানোর পথ দ‌েখালেন তিন বাঙালি

আরও পড়ুন- ভয়ঙ্কর স্মৃতি মুছে ফেলার পথ দেখালেন শান্তিনিকেতনের সোনা

গবেষকদলের অন্যতম সদস্য ক্যালটেক-এর পোস্ট ডক্টরাল গবেষক অগ্নিভ মিত্র জানাচ্ছেন, বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার জন্য কিছু কিছু ব্যাকটেরিয়া যে ম্যাঙ্গানিজ খায়, এমন একটা সন্দেহ অনেক দিন ধরেই ছিল বিজ্ঞানীদের। এক শতাব্দীরও আগে দেখা গিয়েছিল, নাইট্রোজেন, সালফার ও লোহা থেকে ইলেকট্রন বের করে নিতে পারে ব্যাকটেরিয়া। সেটা যে তাদের জীবনধারনের জন্যই, সেই ধারণাও ছিল বিজ্ঞানীদের। কিন্তু একই ভাবে যে ব্যাকটেরিয়া ম্যাঙ্গানিজেরও ইলেকট্রন বের করে নিতে পারে, তার হাতেকলমে কোনও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না। মানুষ যে ভাবে তার খাবারদাবারে থাকা কার্বহাইড্রেট থেকে ইলেকট্রন বের করে নেয় তার শরীরের জ্বালানির জন্য, ঠিক তেমন ভাবেই যে ব্যাকটেরিয়াও ম্যাঙ্গানিজ থেকে ইলেকট্রন বের করে নেয় তার বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার জন্য এর সরাসরি কোনও প্রমাণ মিলছিল না।

৭০টি প্রজাতির মধ্যে দু’টিই ছিল অভিনব

অগ্নিভ বলছেন, ‘‘আমরা ওই কাচের জারটি থেকে ৭০টি প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া পেয়েছিলাম। সেগুলি খুব সম্ভবত ট্যাপ ওয়াটার থেকেই এসেছিল কাচের জারে। তার মধ্যেই আমরা ওই এক জোড়া ব্যাকটেরিয়ার হদিশ পাই, যারা এক সঙ্গে থাকলেই কোনও পদার্থে থাকা ম্যাঙ্গানিজ ধাতু খেয়ে নিয়ে নিজেদের দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটায়। আর সেটা করতে গিয়ে আরও বিষাক্ত ম্যাঙ্গানিজ অক্সাইড তৈরি করে। আমরা দেখেছি, ওই ব্যাকটেরিয়ারা কাচের জারের গোলাপি রঙের ম্যাঙ্গানিজ কার্বনেট থেকে ম্যাঙ্গানিজ খেয়ে নিয়ে কালো রঙের ম্যাঙ্গানিজ অক্সাইড তৈরি করেছিল। এও দেখেছি, ওই ব্যাকটেরিয়াদের সংখ্যা যত বাড়ে ততই বাড়ে ম্যাঙ্গানিজ অক্সাইডের পরিমাণ। যার জন্য পরে কাচের জারের রংটা পুরো কালো হয়ে গিয়েছিল। এটা থেকেই বুঝলাম, ওই ব্যাকটেরিয়ারা ম্যাঙ্গানিজ খেয়েই বাঁচছে, সংখ্যায় দ্রুত বাড়ছে।’’

অগ্নিভ জানাচ্ছেন, এই ম্যাঙ্গানিজ অক্সাইড অত্যন্ত বিষাক্ত। যা প্রচুর পরিমাণে থাকে খাওয়ার জলে। কাদের জন্য খাওয়ার জলে ম্যাঙ্গানিজ অক্সাইড এসে মেশে, এ বার সেটা জানা গেল। ফলে, খাওয়ার জলকে বিষমুক্ত করার কাজটা এ বার সহজ হয়ে যাবে বলেই মনে হচ্ছে।

অগ্নিভ অবশ্য এও বলেছেন, ‘‘ওই দুই প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া এক সঙ্গে থাকলেই এটা হয়, নাকি তারা আলাদা আলাদা ভাবেও এই কাজটাই করতে পারে, সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।’’

একা হোক বা জোড়া, শত্রুদের চিনে ফেলার পর যে এ বার পানীয় জলকে পরিস্রুত করার কাজটা সহজতর হয়ে গেল, এ ব্যাপারে দ্বিমত নন বিশেষজ্ঞরা।

ফলে, নতুন দু’টি প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কারের সঙ্গে পানীয় জলকে আরও পরিস্রুত করার রাস্তাটাও খুলে গেল।

ছবি: ‘ক্যালটেক’-এর সৌজন্যে।

Ramlibacter lithotrophicus Candidatus Manganitrophus noduliformans manganese-fueled bacteria
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy