রবীন্দ্রনাথের গানে শরৎ-বসন্ত কিংবা রোদ-বৃষ্টি জাতীয় অন্বেষণ এবং তা নিয়ে গ্রন্থনা-সহযোগে আলেখ্য বিরচনা বাঙালি কম দেখেনি। একার্থে, সেটিই সহজতর কাঠিন্য, কঠিনতর সারল্য। রবীন্দ্রগান নিয়ে ধারাবাহিক কাজ করে আসা সংস্থা ‘রবি পরম্পরা’ চেনা সেই পথে না হেঁটে এ বার অন্য ভাবনার মুখোমুখি করল শ্রোতাদের, মুগ্ধ করেও তুলল। সম্প্রতি কলকাতার ত্রিগুণা সেন অনুষ্ঠানগৃহের সেই সান্ধ্য আয়োজনের শীর্ষনাম রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি-পর্বের গান থেকে সঙ্কলিত— ‘কোথা যে উধাও’। এ আয়োজনও আলেখ্যধর্মী এবং উপস্থাপিত গানগুলি রবীন্দ্রনাথেরই। তবু গড়-আয়োজন হয়ে না-ওঠার ব্যতিক্রমী সাহস-শক্তিই স্পষ্ট হয়ে উঠল অনুষ্ঠানের শুরু থেকে। শেষ অবধি ভাবনার সেই পরম্পরা নিরবচ্ছিন্ন ছিল।
‘পথ’ বিষয়ে ভাবনা আয়োজনের ভরকেন্দ্র। অবশ্য শুধু পথ নয়, সরণও। তবে সরণ বিষয়ে পদার্থবিদ্যার সংজ্ঞাতত্ত্বে আবদ্ধ রইল না ভাবনা-অভিমুখ। যুক্ত হল আরও স্তর-আস্তর, যাদের মধ্যে মুখ্য মানুষ ও মানুষি চিন্তা, জীবন-সম্পাদন আর তার অকুণ্ঠ-অগণন যোজন-অভিযোজনের বহুবর্ণ অনুভূতিমালা। এই প্রয়াস দু’টি দিক থেকে চমকিত করল। এক, গ্রন্থনার বয়ান ও সেখানে ব্যবহৃত কবিতা, গদ্যের ব্যবহার। দুই, গানের নির্বাচন।
গ্রন্থনায় রবীন্দ্রনাথের রচনার পাশাপাশি আরও কয়েক জনের আখর-অনুষঙ্গের ব্যবহার ছিল। জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’, লীলা মজুমদারের ‘পাকদণ্ডী’, রবীন্দ্রনাথের ‘অতিথি’, রবীন্দ্রনাথের ‘হঠাৎ দেখা’, ‘একটা আষাঢ়ে গল্প, রবীন্দ্রনাথের চিঠি, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’— রচনা বা লেখকের নামোল্লেখ না করে একের পর এক ঢেউয়ের মতো এল তাদের সরাসরি বয়ান বা ভাবার্থের পাঠ-সম্পাদনা এবং তারা হয়ে উঠল আয়োজনের নানাবর্ণ উপচার, যারা পৌঁছল অভীষ্ট জোয়ারস্রোতে। সেই স্রোতে ভাসানো হল রবীন্দ্রনাথের অনতিক্রম্য গানের ভেলা, সুরের সাম্পান। কাজটি ব্যতিক্রমীই।
পরিবেশিত গানগুলি স্তবকে বাঁধা হয়েছিল। সূচনাকথার পরে প্রথম স্তবকে চারটি গান, যার শেষ ‘অচেনাকে ভয় কী আমার ওরে’ দিয়ে। প্রারম্ভিক পাঠে অচেনাকে ভয় না করে জয় করার মানুষি প্রয়াসের কথাই বলা হয়েছিল। গ্রন্থনার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে এ ভাবেই এল পরের স্তবকগুলি। ‘পাকদণ্ডী’র অংশ পেরিয়ে পরের স্তবকে দু’টি গান ‘এই যে কালো মাটির বাসা’ ও ‘আমি চঞ্চল হে’। ‘অতিথি’র তারাপদ মিশে গেল পরের স্তবকের ‘দূরদেশি সেই রাখাল ছেলে’ আর ‘পথিক হে’ গানে। পরের স্তবকে ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতা মুখোমুখি হল ‘বাহির পথে বিবাগী হিয়া’, ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’, ‘হাটের ধূলা সয় না যে’ গানের। একই ভাবে কবির লেখা চিঠি মিলিত হল ‘পান্থ, এখনও কেন অলসিত অঙ্গ’, ‘ক্ষণে ক্ষণে মনে মনে’র মূর্ছনায়। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ মিশে গেল ‘ডুবি অমৃতপাথারে’, ‘কত অজানারে জানাইলে তুমি’ গানে। শেষ স্তবকে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ’ আর ‘আমরা নূতন যৌবনেরই দূত’ এল ‘একটা আষাঢ়ে গল্প’ থেকে পাঠ করা আবহের পথ ধরে।
গান-অংশের শিল্পী চার জন— সুলগ্না পাল, শাঁওলি দাশগুপ্ত, মধুবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়। বেশ কিছু গানের পরিবেশনা মুগ্ধতার রেশ রেখে যায়। কিছু গানের কিছু অংশে একাধিক কণ্ঠের বা সম্মেলক পরিবেশনার ভাবনাটিও নজর কাড়ে। নির্মেদ কণ্ঠ চার শিল্পীরই। আলাদা ভাবে নজর কাড়ে কয়েকটি গানের পরিবেশনা, সঙ্গত-ভাবনা। যেমন, পূজা-পর্বের ভৈরবী ‘পথিক হে’ গানের আগে দ্রুতগতি শ্রীখোলের পথ প্রস্তুত করে দেওয়া। প্রেম-পর্বের বৃন্দাবনী সারং ‘বাহির পথে বিবাগী হিয়া’র পরিবেশনায় পঙ্কজকুমার মল্লিকের কিংবদন্তি গায়কিকে মনে করিয়ে দেওয়া, ‘আয় রে ফিরে আয়’ অংশে সম্মেলক কণ্ঠের ব্যবহার এবং ভারী মুখের তবলায় ঝম্পকের ঝড়, কি-বোর্ডে সরোদের আবহ। বিচিত্র-পর্বের বাউলাঙ্গ ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’ গানে খোলা হাতের উদ্দাম খোল। পূজা-পর্বের যোগিয়া-ললিত ‘পান্থ এখনও কেন’ গানে সুরফাঁক তালে পাখোয়াজের তুমুল-ধীর-মাপা সঙ্গত এবং অনুপম পরিবেশনা। এ গানের পরিবেশনায় সযত্নলালিত পরম্পরা স্পষ্ট হয় সুচিত্রা মিত্রের অনন্য গায়কির। একই ভাবে গায়কি ও সঙ্গতে গানের ভাব-নির্যাস প্রতিষ্ঠা পূজা-পর্বের চৌতাল-নিবদ্ধ ললিত ‘ডুবি অমৃতপাথারে’তে। পূজা-পর্বেরই গান রূপকড়া তালে বাঁধা হাম্বির-নিবদ্ধ ‘কত অজানারে জানাইলে তুমি’র পরিবেশনা মুগ্ধ করে।
পুরো আয়োজনকে প্রধানত ধরে রেখেছিলেন দু’জন, সঙ্গীত পরিচালনায় সংস্থার কর্ণধার অনিতা পাল ও তালবাদ্যে বিপ্লব মণ্ডল। এসরাজ, কি-বোর্ড, মন্দিরায় অভ্র চট্টোপাধ্যায়, অমল সরকার, সুব্রত মুখোপাধ্যায় যথাযথ। যদিও কিছু গানে মন্দিরার সন্দিহান ভাব ঈষৎ কানে লাগে। পাঠ-আবৃত্তিতে কৃত্বিক ঘোষ চমৎকার। গ্রন্থনার ভাবনা-রচনা-সঙ্কলন অভিজিৎ পালের। ভাবনার নতুনত্বের কারণে তিনি কৃতিত্বের দাবিদার।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)