Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Music Show

এক বিরল মূর্ছনার সাক্ষী এ শহর

প্রথম পরিবেশনার শেষে ‘রঙ্গি সারি’, ‘ইয়াদ পিয়া কী আয়ে’র অনুরোধ আসতে শুরু করল দর্শকাসন থেকে। বসন্তোৎসবের আবহে কৌশিকী ধরলেন হোরি গান। মাঝ খম্বাজের এই ‘রাধা কী হোরি’র পরতে পরতে কৃষ্ণের গায়ে রং দিতে চাওয়া রাধার আকুলতা।

আমান আলি খান এবং কৌশিকী চক্রবর্তী এই প্রথম বার একসঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নিলেন।

আমান আলি খান এবং কৌশিকী চক্রবর্তী এই প্রথম বার একসঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নিলেন। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

সায়নী ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২৪ ০৫:৪০
Share: Save:

দোলের ঠিক আগের দিন এ শহর এমন এক সঙ্গীতসন্ধ্যার সাক্ষী হয়ে থাকল, যা আগে বড় একটা দেখা যায়নি। সরোদ আর কণ্ঠসঙ্গীত মিলেমিশে এক হয়ে গেল এ দিন নজরুল মঞ্চে। আমান আলি খান আর কৌশিকী চক্রবর্তী এই প্রথম বার একসঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নিলেন, সুরধ্বনিতে মাতালেন সঙ্গীতবেত্তাদের। সরোদ মায়েস্ত্রো বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর স্মরণে একটি সঙ্গীত উৎসবের আয়োজন করেছিল বালিগঞ্জ মৈত্রেয়ী মিউজ়িক সার্কল। উৎসবের দ্বিতীয় সিজ়নে আমন্ত্রিত শিল্পী ছিলেন আমান ও কৌশিকী। তাঁদের একক পরিবেশনার পরে অনুষ্ঠান শেষ হয় যুগলবন্দিতে।

এ দিন মঞ্চে উঠে সঙ্গীত পরিবেশনের আগে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে নিয়ে নিজের শৈশবের স্মৃতি ভাগ করে নিলেন কৌশিকী। জানালেন, আইটিসি সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির শুরুর দিনগুলোয় কী ভাবে তাঁর ‘জ্যেঠু’র স্নেহ, বকুনির মধ্য দিয়েই শিক্ষানবিশির প্রথম পাঠ আত্মস্থ করেছিলেন অজয় চক্রবর্তী-তনয়া। এ দিনের অনুষ্ঠানে দর্শকাসনে ছিলেন অজয় ও চন্দনা চক্রবর্তী। ‘‘আমি গাওয়ার সময়ে বাবা কখনও হাসেন না...’’ পরিবেশনার আগে কৌশিকীর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলা কথাগুলোয় হাসি ছড়িয়ে পড়ল সকলের মুখে। ভীমপলশ্রী ধরলেন কৌশিকী। মুহূর্তে পরিবেশ পাল্টে গেল প্রেক্ষাগৃহের। ‘করম করো মোরি সাঁই’-এর বিলম্বিত চলন আবিষ্ট করে ফেলল শ্রোতাদের। খাদের দিকের দ্রুত চলন ও সপাট তানে কৌশিকীর সাবলীলতা অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিল এই পরিবেশনাকে। ‘ঘির ঘির আয়ি বদরিয়া’র বন্দিশ ঝাঁপতালে পরিবেশন করলেন কৌশিকী। শেষ করলেন ‘যা যারে অপনি মন্দিরওয়া’ দিয়ে, দ্রুত তিনতালে। এ দিন তাঁর সঙ্গে তবলায় ওজস আঢ্য, হারমোনিয়ামে তন্ময় দেওচাকী ছিলেন। সারেঙ্গিতে মোরাদাবাদ ঘরানার যোগ্য উত্তরসূরি মুরাদ আলি খান এ দিন তাঁর যোগ্য সঙ্গতে শ্রোতাদের মন জয় করলেন। তানপুরায় ছিলেন সঙ্ঘমিত্রা সরকার ও রাইমা কর্মকার।

প্রথম পরিবেশনার শেষে ‘রঙ্গি সারি’, ‘ইয়াদ পিয়া কী আয়ে’র অনুরোধ আসতে শুরু করল দর্শকাসন থেকে। বসন্তোৎসবের আবহে কৌশিকী ধরলেন হোরি গান। মাঝ খম্বাজের এই ‘রাধা কী হোরি’র পরতে পরতে কৃষ্ণের গায়ে রং দিতে চাওয়া রাধার আকুলতা। ‘রঙ্গ ডারুঙ্গি’ আগেও একাধিক বার মঞ্চে পরিবেশন করেছেন কৌশিকী। এ দিনও শ্রোতাদের ভরিয়ে দিলেন শিল্পী, তাঁর গায়নশৈলীতে। প্রথমে আলাপের বিস্তার ও পরে কোমল স্বরের প্রয়োগে শিল্পী যেন মূর্ত করে তুললেন রাধার আনন্দ ও যন্ত্রণা, দুই-ই।

কৌশিকী মঞ্চ ছেড়ে দেওয়ার পরে আমান আলি খান এলেন। তাঁর প্রথম নিবেদন ছিল রাগ শ্রী। এই রাগের উপরে উস্তাদ আমজাদ আলি খানের কম্পোজ়িশন এ দিন শ্রোতাদের উপহার দিলেন আমান। ধীর থেকে দ্রুতে অনায়াস বিচরণ, ঝাঁপতাল-তিনতালের লয়ে মাতিয়ে রাখলেন উপস্থিত সকলকে। আমানের সঙ্গে তবলায় মন-ভরানো পরিবেশনা সত্যজিৎ তলওয়ালকরের। আমানের সঙ্গে তাঁর তালমিল আরও মনোগ্রাহী করে তুলেছিল পরিবেশনাটিকে। যদিও মাঝেমধ্যে সরোদের মূর্ছনাকে ছাপিয়ে যাচ্ছিল তবলার বোল। আমানের পাশে তানপুরায় বসেছিল ছোট্ট ঋষিথ, কৌশিকী ও পার্থসারথি দেশিকানের সুযোগ্য পুত্র।

আমানের দ্বিতীয় পরিবেশনা ছিল রাগ দেশের উপরে একটি প্রচলিত বন্দিশ। দেশ রাগের চিরচেনা সুরক্ষেপণ সরোদের তারে স্বর্গীয় আমেজ সৃষ্টি করল যেন। সত্যজিৎকেও হাত খুলে বাজানোর সুযোগ করে দিলেন শেষের দিকে।

এর পরেই কৌশিকী-আমানের যুগলবন্দি অনুষ্ঠানের শেষ পর্বের সূচনা করল। ‘‘ছোটবেলায় অজয় আঙ্কলের হাত ধরে এই মেয়েটি আমাদের বাড়ি গিয়েছিল, গান শুনিয়েছিল। তার পর থেকে এক মাস ধরে আব্বা আমাকে কথা শুনিয়েছিলেন, ‘রেওয়াজ করলে কী হয় দেখ!’ কৌশিকীকে নিয়ে আমার প্রথম স্মৃতি এটাই,’’ আমানের স্মৃতিচারণে লজ্জা পেলেন কৌশিকী। রাগেশ্রী দিয়ে শুরু করলেন দু’জনে। সরোদ ও কণ্ঠসঙ্গীতের যুগলবন্দির অভিজ্ঞতা সাধারণ ভাবে বিরল। প্রথম বার একসঙ্গে পারফর্ম করতে উঠে এই বিরল অভিজ্ঞতাই উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মনে চিরস্থায়ী করে গেলেন দুই শিল্পী। লয়কারীর পরে আমানের ধরতাই, কৌশিকীর দ্রুত তান ও সমে ফেরার মূহূর্ত অসম্ভব উপভোগ্য করে তুলেছিল যুগলবন্দিকে। এক সপ্তক থেকে অন্যটিতে নিখুঁত স্বর প্রক্ষেপণ কৌশিকীর জাত চিনিয়ে দেয়। একটি ‘সাওনি’ দিয়ে শেষ করলেন তাঁরা। মালিনী অবস্তির কণ্ঠে জনপ্রিয় ‘তুমকো আনে মে’ দিয়ে শেষ হল অনুষ্ঠান। এই পরিবেশনাটিতে কৌশিকীকে খানিক বিচরণের সুযোগ করে দিলেন যেন আমান, নিজে নেপথ্যে থেকে। সঙ্গে সত্যজিৎ ও ওজসের তবলার লহরা আলাদা প্রাপ্তি। শিল্পীদের সওয়াল-জবাবে অন্য স্তরে পৌঁছে গেল শেষের মুহূর্তগুলি।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে আয়োজিত এই মিউজ়িক ফেস্টিভ্যাল কোভিডের কারণে স্থগিত ছিল মাঝে। দ্বিতীয় সিজ়নে তা স্বমহিমায় ফিরে এল, শ্রোতাদের উপহার দিল এক অবিস্মরণীয় সঙ্গীতসন্ধ্যা। সেই সঙ্গে প্রতীক্ষারও শুরু, এই উৎসবের আগামী পর্বের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE