E-Paper

সমর্পণের আর্তি, মাধুর্যের দাপট

অনুষ্ঠানের পরের পর্বে কণ্ঠসঙ্গীত। কিরানা ঘরানায় প্রশিক্ষিত শিল্পী নমামি কর্মকার। শুরু করলেন রাগ মধুবন্তী দিয়ে। অল্প রাগরূপ বিস্তারের পরে প্রথম বন্দিশ ‘তোরে গুণ গাও’। বিলম্বিত চলনে মুগ্ধ করলেন শিল্পী। দ্রুতে ‘কাহে মান করো’ বন্দিশে সে মুগ্ধতার মাত্রা আরও বাড়ল।

সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০২৫ ০৫:৫৪
ভুবনেশ কোমকলি।

ভুবনেশ কোমকলি। —নিজস্ব চিত্র।

ভারতীয় মার্গসঙ্গীত নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই কাজ করে চলেছে ‘সুরমূর্ছনা’। সংস্থার বার্ষিক সঙ্গীত সম্মেলন আয়োজিত হয়েছিল সম্প্রতি। বরেণ্য শিল্পী এ কানন আর মালবিকা কাননের স্মরণে কলকাতার উত্তম মঞ্চে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি শুরু হয়েছিল তবলার বৃন্দবাদনে। তন্ময় বসুর ছ’জন নবীন শিক্ষার্থী-পরিবেশিত তালবাদ্য। স্থিতি-গতি-দ্রুতির সাম্য এবং সার্বিক পেশকারি মুগ্ধ করার মতো। হারমোনিয়ামে ছিলেন সজল দাস। প্রায় আধ ঘণ্টার এই দুরন্ত পরিবেশনা ওই নবীন শিল্পীদের কুর্নিশের দাবিদার।

অনুষ্ঠানের পরের পর্বে কণ্ঠসঙ্গীত। কিরানা ঘরানায় প্রশিক্ষিত শিল্পী নমামি কর্মকার। শুরু করলেন রাগ মধুবন্তী দিয়ে। অল্প রাগরূপ বিস্তারের পরে প্রথম বন্দিশ ‘তোরে গুণ গাও’। বিলম্বিত চলনে মুগ্ধ করলেন শিল্পী। দ্রুতে ‘কাহে মান করো’ বন্দিশে সে মুগ্ধতার মাত্রা আরও বাড়ল। শিল্পী তাঁর পর্ব শেষ করলেন তুলসীদাসের ভজন ‘সীতাপতি রামচন্দ্র’ দিয়ে। নমামিকে অনুপম সঙ্গত করলেন তবলায় পরিমল চক্রবর্তী, হারমোনিয়ামে অনির্বাণ চক্রবর্তী।

পরের শিল্পী কণ্ঠসঙ্গীতে মঞ্জুষা পাটিল। মরাঠি এই শিল্পীর তালিম আগরা-গ্বালিয়র ঘরানার। নির্মাণ-বিনির্মাণে দক্ষ এই শিল্পী শুরু করলেন মুলতানি দিয়ে। তিলওয়াড়া-নিবদ্ধ প্রথম বন্দিশ ‘গোকুল গাঁও’। গান এগোল। ছড়ের তারযন্ত্রের মতো তীক্ষ্ণ-মসৃণ কণ্ঠের তানকারিতে প্রেক্ষাগৃহ রণিত হয়ে উঠল। কণ্ঠের একই দাপট অব্যাহত আদ্ধা মধ্যলয়ে দ্বিতীয় বন্দিশ ‘মানত নাহি জিয়ারা মোরা’য়। দ্রুত তিনতালে ‘সাবরে কি ধুন লাগি’ অনবদ্য পরিবেশনা। শিল্পী তাঁর অনুষ্ঠান শেষ করলেন মীরার ভজনে— ‘মারে ঘর আয়ো জি’। তাঁর সঙ্গে তবলায় বিভাস সাংহাই এবং হারমোনিয়ামে রূপশ্রী ভট্টাচার্য অনবদ্য। বিশেষত, রূপশ্রী আর মঞ্জুষার সাঙ্গীতিক রসায়ন চমক তৈরি করছিল।

পরের পর্বে অনুষ্ঠান পৌঁছল বারাণসীতে। বেনারস ঘরানায়। গুজরাতে বেনারস সঙ্গীত-শৈলীর পত্তন ঘটানোর কারিগর নন্দন মেহতার কন্যা হেতাল মেহতা একক তালবাদ্যে। সঙ্গে হারমোনিয়ামে হিরণ্ময় মিত্র। শিল্পী তাঁর পরিবেশনা শুরু করলেন বিলম্বিত ধামারে। পরে মধ্য ও দ্রুত তিনতাল। তাঁর ঘরানা এবং গুরুকুলের নানা কম্পোজ়িশন, নানা টুকরা উপস্থাপন করলেন হেতাল। শিল্পীর ওজস্বী পেশকারি মন ছুঁয়ে যায়। ধা-বৈচিত্র, পাখোয়াজ-টুকরা, বহুবর্ণ তেহাই— অনবদ্য। শেষে খানিকটা আদানপ্রদানের ভঙ্গিতে সামনের সারিতে শ্রোতার আসনে উপবিষ্ট কলকাতা তথা দেশের নামী বাঙালি শিল্পীদের সঙ্গে ব্যতিক্রমী সেতু রচনা করলেন তাঁদের মুহূর্ত-ইঙ্গিত মান্য করে বাদন-কৃতি অনায়াস-সম্ভব করে তুলে। হেতাল মঞ্চ শাসনই করলেন কার্যত।

মঞ্জুষা পাটিল।

মঞ্জুষা পাটিল। —নিজস্ব চিত্র।

যদিও এতক্ষণ ধরে পূর্ণতার গন্ধমাখা সব মধুপাত্রই উপচে দিয়ে ঝরে পড়লেন অনুষ্ঠানের শেষ শিল্পী ভুবনেশ কোমকলি। উপচে দিলেন বাঁধিয়ে রাখার মতো একটা সময়খণ্ড উপহার দিয়ে। তুলনারহিত কণ্ঠমাধুর্যের অধিকারী এই শিল্পী মঞ্চে এলেন, কোনও কথা না বলে অনুষ্ঠান শুরু করলেন এবং ভাসিয়ে দিলেন। ভুবনেশ ধরলেন রাগ নন্দ। বিলম্বিত একতালে। বন্দিশ— ‘গোবিন্দ বীণ বাজায়ে’। অসীম এক ধৈর্যে বাঁধা বিলম্বিত-গতি। শিল্পীর কিংবদন্তি দাদু কুমার গন্ধর্ব বা গান-যাযাবর বাবা মুকুল শিবপুত্র বিষয়ে যেমন প্রত্যয় হয়— তাঁরা ঘরানা খোঁজেন না, ঘরানা তাঁদের খুঁজে বেড়ায়— সার্থক উত্তরাধিকারী ভুবনেশ সেই অনুভবটিকেই কলকাতার মঞ্চে যেন আরও একবার স্মরণ করিয়ে দিলেন আপন গায়কিতে। পারিবারিক উত্তরাধিকারের পাশাপাশি প্রতি মুহূর্তে নানা আঙ্গিকের বিচ্ছুরণ-সমাহার। দ্রুত তিনতালে ‘রাজন, আব তো আজা রে’— তিরতির করে কাঁপতে থাকা আর্তির ক্ষরণ, সমর্পণের শরীর গড়ে তুলল। সেই অবিস্মরণীয় পর্ব এক সময় শেষ হল। হাততালি পড়তে দেরি হল কিঞ্চিৎ। ঘোর তো নিজেকে কাটাতে সময় নেয়। শিল্পী অনুষ্ঠান শেষ করলেন কবীরের অবিস্মরণীয় নির্গুণ পদে— ‘গগন মে আওয়াজ হো রহি’। সমর্পণের আরেক সুললিত বয়ান। ভুবনেশের সঙ্গে তবলায় মাত করলেন সমর সাহা, হারমোনিয়ামে দীপক খসরাওয়াল।

নমামি কর্মকার।

নমামি কর্মকার। —নিজস্ব চিত্র।

গোটা আয়োজনে সময় মেনে এবং ধারাবাহিকতা বজায় রেখে রাগ-রাগিণী নির্বাচন নিভৃত সৌন্দর্যচিন্তার জাদু। বেশ বড় সময়-পরিসরের আয়োজন। তবে, দুরন্ত ব্যবস্থাপনা-উপস্থাপনায় ঘড়ির কাঁটা অর্থ হারিয়েছিল। এমন অনবদ্য এবং সুঠাম অনুষ্ঠান সম্পাদনার জন্য প্রভূত প্রশংসা প্রাপ্য আয়োজক সংস্থা ‘সুরমূর্ছনা’র।

অনুষ্ঠানের শেষে উত্তম মঞ্চ থেকে বেরিয়ে নির্জন হয়ে আসা রাতের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চোখ চলে গিয়েছিল উপরের দিকে, আকাশে। এক-দু’পশলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে আকাশ। মেঘের আস্তরে অদৃশ্য সব তারা। মুহূর্তে মনে পড়ে গেল এক গান, যা বাঙালি-মাত্রেরই মনে পড়তে বাধ্য! ঋত্বিক ঘটকের ছবি ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় ব্যবহৃত, শতকান্তরের ভেন্ডিবাজার ঘরানার কিংবদন্তি আমান আলি খানের বাঁধা সেই অকল্পনীয় দ্রুত তিনতালের হংসধ্বনি-বন্দিশ— ‘লাগি লগন পতি সখী সঙ্গ’। মনে পড়ে গেল অনিল চট্টোপাধ্যায়ের সেই বাঁধভাঙা অভিব্যক্তিও। আর অবশ্যই স্মৃতি জুড়ে বাজতে থাকলেন অরকুট কান্নাভিরান— এ কানন... ছবিতে যাঁর শ্রীকণ্ঠ ওই চিরসুন্দর বন্দিশটিকে চিরসময়ের জন্য ধরে রেখেছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Cultural Events Cultural Program Classical Music Music Show

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy