কলকাতার বিড়লা অ্যাকাডেমি অব আর্ট অ্যান্ড কালচারে সম্প্রতি আয়োজিত হয়েছিল এক মনোজ্ঞ প্রদর্শনী। ইনস্টিটিউট অব কনটেম্পোরারি ইন্ডিয়ান আর্ট, ‘অষ্টগুরু’র সহায়তায় শিল্পী টম ওয়াট্টাকুজ়ি তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী নিবেদন করলেন। নাম, ‘দ্য শ্যাডোস অব অ্যাবসেন্স’।
ছায়া-সুনিবিড়: বিড়লা অ্যাকাডেমিতে শিল্পী টম ওয়াট্টাকুজ়ির একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
টমের জন্ম কেরলে। প্রথমে শান্তিনিকেতনে, পরে বরোদায় এবং আরও পরে বিদেশে কিছু বছর কাটিয়েছেন এই শিল্পী। তাঁর ১৬টি প্রধান কাজ নিয়ে এই প্রদর্শনী সাজিয়েছেন প্রফেসর আর. শিবকুমার। এই ক্যানভাসগুলো গত কয়েক বছরে আঁকা কিন্তু এ দেশে কখনও দেখানো হয়নি। এ বার কলকাতার শিল্পরসিকরা সে সুযোগ পেলেন।
ছায়া-সুনিবিড়: বিড়লা অ্যাকাডেমিতে শিল্পী টম ওয়াট্টাকুজ়ির একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
টম ওয়াট্টাকুজ়ির কাজগুলি একেবারে অন্য রকম। প্রত্যেকটি ছবিতেই গল্প বলার ঢঙে একটি আখ্যানের মুখোমুখি হবেন দর্শক। ছবির গঠন আপাতদৃষ্টিতে বাস্তবধর্মী। অথচ তাঁর ছবি কিন্তু বাস্তবধর্মী নয়। কারণ প্রত্যেকটি ছবিতেই লুকিয়ে আছে বহু সম্পর্কের জটিলতা। ছবির পৃষ্ঠপটে স্বপ্নের চরিত্রদের আনাগোনা এবং তার পরে চরিত্রগুলি পরস্পর মিলেমিশে এক বিচিত্র নাটকীয়তা। শিল্পী যা বলতে চেয়েছেন, তা স্পষ্টত সাররিয়েল, কিন্তু তাঁর ভাষা অত্যন্ত সংযত এবং নিয়ন্ত্রিত।
ছায়া-সুনিবিড়: বিড়লা অ্যাকাডেমিতে শিল্পী টম ওয়াট্টাকুজ়ির একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
শিল্পী মনে করেন যে, আপাত বাস্তবধর্মী কাজের যথেষ্ট প্রয়োজন আছে শিল্পে। বিশেষ করে এখন। প্রথম ছবিটি ‘ফাদার অ্যান্ড সান’। এই ছবিটি তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে যে, পিতা এবং সন্তানের আলিঙ্গনে এক অদ্ভুত ভাব ফুটে উঠেছে। দু’জনেরই চোখ আবেশে বন্ধ। ইটালির শিল্পী রাফায়েলের আঁকা ম্যাডোনা এবং শিশুর ছবিতে যে ভাবে ভাবাবিষ্ট অবস্থায় একটা আধ্যাত্মিক দরজা দিয়ে মানুষ ঢুকে পড়তে পারে, কিছুটা সেই রকম।
ছায়া-সুনিবিড়: বিড়লা অ্যাকাডেমিতে শিল্পী টম ওয়াট্টাকুজ়ির একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
দ্বিতীয় ছবির নাম ‘দ্য ইভনিং স্লিপ অব অ্যান ওল্ড ম্যান’ একটি ট্রিপটিক। অসাধারণ ছবি। বৃদ্ধ মানুষটি ঘুমে-জাগরণে আসা-যাওয়া করছে। বৃদ্ধের মুখের উপরে যে অসাধারণ আলো ফেলেছেন শিল্পী, তাতে দর্শকের দৃষ্টি সোজা ওই মানুষটার উপরে গিয়ে পড়ে। যদিও এখানে অন্য চরিত্ররাও আছে। বাঁ-দিকে মেয়েটির মুখে আসন্ন বিপদের পূর্বাভাস। তার মুখের আলোটিও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রত্যেকটি চরিত্র আলাদা ভাবে ব্যস্ত এবং প্রত্যেকের মুখের ভাষাও আলাদা।
ছায়া-সুনিবিড়: বিড়লা অ্যাকাডেমিতে শিল্পী টম ওয়াট্টাকুজ়ির একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
এর পরের ছবিটি ‘দ্য কাপল’। বাড়ির অন্দরমহলে ঘটে যাওয়া নাটকের এক দৃশ্য। এক দিকের দেওয়ালে দম্পতির সদ্যবিবাহিত অবস্থার ছবি এবং অন্য দেওয়ালে ক্রুশ। পরিষ্কার চাদরে ওদের বিবাহিত জীবনের ঔদাসীন্য, নির্লিপ্তি যেন আঁকা আছে। প্রেমের অভাব সুস্পষ্ট ভাবে এঁকেছেন শিল্পী। এখানেই তাঁর শৈল্পিক দক্ষতা ধরা পড়ে। ওরা চাদর পাতছে বিছানায়। জানলা দিয়ে আলো এসে পড়েছে দেওয়ালে, আর এঁকে দিচ্ছে জটিলতার এক ডিজ়াইন, চতুর্ভুজ এক জালিতে।
এ বারে দর্শক দেখবেন ‘লেসনস অব লাইফ-৫’। পারিবারিক ছবির মধ্যে এটি শেষ ছবি। এই একটি ছবিতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একটা যেন সুখী ভাব দেখা যায়। পরিবারের কর্তা তার ছোট্ট মেয়েটিকে জীবনের প্রথম পদক্ষেপ শেখাচ্ছে। এই ছবিতে দায়িত্ববোধ আছে। আনন্দে মেতে আছে এক মেয়ে। দ্বিতীয়টি হয়তো বা পাখিকে খাওয়াতে ব্যস্ত। সুখী পারিবারিক জীবনের ছবি এঁকেছেন শিল্পী টম।
‘বার্থডে’ ছবিতে ট্রিপটিকের মতো গঠন থাকলেও এটি আদতে তা নয়। নাটকের মাঝখানে ঘুমন্ত সন্তান-সহ শায়িত জননী। দেওয়ালে আলোকসজ্জা। দুই বালিকা মাকে প্রদক্ষিণ করে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু দু’টি পুরুষ চরিত্র ছবির ডান এবং বাঁ-দিকে থেকেও নিজস্ব জগতে বিরাজমান। ডান দিকের মানুষটি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবছে। বাঁ-দিকের বৃদ্ধ পিতার দৃষ্টি ছড়িয়ে আছে অসীমের দিকে। খাটে শোয়া জননী যেন নিজের চিন্তার জগতে ডুবে আছে, সকলের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে। শিল্পীর ছবিতে প্রচুর নাটকীয়তা পাওয়া যায়। আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হচ্ছে, তা না-ও হতে পারে। শিল্পরসিককে ছবির সামনে দু’দণ্ড দাঁড়াতে হবে, ভাবতে হবে।
এ বার দেখা যায় একটি ছবি, যার নাম ‘দ্য সিকার অব লাইট’! সম্পূর্ণ ভাবে আত্মমগ্ন এক যুবক। দু’টি হাত বুকের উপরে রাখা। কী খুঁজছে সে? তা সে পেল কি না, জানে না কেউ। যুবকটি যেন সম্পূর্ণতার এক প্রতীক।
রেনেসাঁ-পরবর্তী বাস্তবধর্মী ছবির মতো আলোর ব্যবহার করেননি শিল্পী টম। নিজের মতো করে সব ছবিতে আলো ফেলেছেন। কোথাও ডান দিক থেকে, কোথাও বাঁ-দিক থেকে, আবার কোথাও বা উপর থেকে। কিছু চরিত্রকে প্রতিচ্ছায়ায় রেখেছেন। শিল্পীর অনেক ছবিতেই দেখা যায়, মানুষের পরস্পরের প্রতি বিচ্ছিন্নতা। আবার অনেক ছবিতে একতা, অন্তরঙ্গতা এবং সহানুভূতির গল্পও মেলে। সব মিলিয়ে ক্যানভাসের উপরে তেলরঙের একরাশ ছবি অত্যন্ত উপভোগ্য।
এই একক প্রদর্শনী টমের শিল্পসম্ভারকে যেন বৃহত্তর শিল্পের ইতিহাসের পাতায় উত্তরণ ঘটাতে সাহায্য করল।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)