Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Art exhibition

বিশ্বাস ও বিদ্রোহের সমন্বয়

বিড়লা অ্যাকাডেমিতে ১৪ জন শিল্পী নিজেদের ২৫ বছরের শিল্প-সখ্য উদ্‌যাপনের জন্য একটি বিশেষ প্রদর্শনীতে একত্রিত হয়েছিলেন।

A Photograph of an art

চিত্রভাষ: বিড়লা অ্যাকাডেমিতে আয়োজিত প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম ফাইল ছবি।

শমিতা বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৩ ০৮:৪১
Share: Save:

বিড়লা অ্যাকাডেমিতে ১৪ জন শিল্পী নিজেদের ২৫ বছরের শিল্প-সখ্য উদ্‌যাপনের জন্য একটি বিশেষ প্রদর্শনীতে একত্রিত হয়েছিলেন। এই দলটি তৈরি করার চিন্তা ওঁদের মাথায় আসে বেশ কিছু বছর আগে, যখন শিল্পীরা নিজেদের কাজ ভাগ করে নিতেন। পরস্পরের শিল্পচিন্তা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হত এবং আরও বিভিন্ন বিষয়ে ভাবনার বিনিময় হত। ওই খোলামেলা বাতাবরণের জন্যই নিজেদের দলের নাম রাখেন ‘ওপেন উইন্ডো’। এই শিল্পীরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে যথেষ্ট দক্ষ। অনেকেই শিক্ষকতা করেন। ছবি আঁকা ছাড়াও ভাস্কর্য, ছাপাই ছবির অভিজ্ঞতাও অনেকেরই আছে। করোনার পরে এই প্রথম একত্রিত হয়েছিলেন তাঁরা। এই প্রদর্শনীটির নাম ‘বিশ্বাস ও বিদ্রোহ’। এখানে শিল্পীরা অতীতে যে বিশ্বাস নিয়ে কাজ করেছেন, যে বিশ্বাস নিয়ে বড় হয়েছেন, সেই বিশ্বাসের মূলেই আঘাত করেছেন বর্তমান জীবনের টালমাটাল অবস্থার ছবি তুলে ধরে।

জনক ঝঙ্কার নার্জারীর ভাস্কর্যের কথাই প্রথমে বলি। তাঁর একটি সুন্দর মার্বেলের কাজ এখানে আছে। এটির নাম ‘আই সাপোর্ট দি ক্রিয়েশন’। আমাদের প্রাকৃতিক জগতের উপরে যেন একটি ধ্যানলভ্য তূরীয় অবস্থার আলো দেখাচ্ছেন। এই কাজে বিশেষ বিদ্রোহ দেখতে পাওয়া যায় না। আছে চরম শান্তি।

তাপস বিশ্বাসের ভাস্কর্য ‘ইউন্যানিমাস’ রেজিন, স্লেট পাথর এবং স্টিল দিয়ে নির্মিত একটি ছেলের মূর্তি। ছেলেটি যেন জীবনযাপনের ভারে ন্যুব্জ। বেঁচে থাকার বিপর্যয় বেশ বোধ করা যায়।

এ ছাড়াও চন্দ্রশেখর দাসের ভাস্কর্য ছিল এই প্রদর্শনীতে। একটি ঘোড়ার মূর্তি, যেটি পেরিয়ে চলেছে অসমতল ভাঙাচোরা জমি। এটিও বাধার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ছবি।

প্রদীপ রক্ষিত একাধারে কবি এবং চিত্রশিল্পী। তাঁর বিমূর্তকরণ যেন শুধুই প্রকৃতির কথা নয়। প্রাকৃতিক এবং জাগতিক দুনিয়ার মধ্যে কোথাও অন্য কিছুর ছোঁয়া পাওয়া যায়। তেলরঙে বেশ কিছু বড় কাজ করেছেন তিনি।

হিরণ মিত্র অনেক রকম মিডিয়াম বা মাধ্যমে কাজ করেন। তিনি চিত্রশিল্পী, গ্রাফিক ডিজ়াইনার, থিয়েটারের সেট ডিজ়াইন করেন এবং তা ছাড়া প্রচুর লেখালিখিও করেন। প্রথম জীবনে ফিগারেটিভ কাজই করতেন, কিন্তু এখন অনেকটাই অন্য রকম কাজ করেন। লাইন এবং শেড দিয়ে বেশ কিছুটা নিজের মতো করেই বিমূর্তকরণ করেন সম্পূর্ণ নিজের ভাষায়। সেই ভাষা কিছুটা প্রতিবাদেরই ভাষা।

সমীর আইচ প্রধানত প্রতিবাদী শিল্পী। এখানে ‘জিমন্যাস্টিক অব আ মাদার উইথ হার চাইল্ড’-এ যেন মায়ের মুখে চিরাচরিত সেই মাতৃসুলভ আনন্দ ধরা পড়ে না। শিশুটির কোনও অশান্তি নেই কিন্তু মায়ের মুখে অজানা আশঙ্কা। ছবিটিতে কালো রঙের ব্যবহার খুব সুন্দর ভাবে আনা হয়েছে। সেখানেই শিল্পীর দক্ষতা লক্ষণীয়।

অমিতাভ ধরের ‘আ গেম’ ছবিটি ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক এবং টেক্সচার হোয়াইট দিয়ে করা হয়েছে। ছবিটি বেশ মজার। এখানে পাশবিক প্রবৃত্তির সঙ্গে ভালবাসার একটা মেলবন্ধন এনেছেন শিল্পী। ছবিটি আকর্ষক।

প্রসেনজিৎ সেনগুপ্তর প্রতিকৃতির উপরে দখল প্রশংসার যোগ্য। ক্যানভাসে ধরেছেন প্রকৃতিবাদী ছবি। ন্যাচারালিজ়ম দিয়েই করেছেন কাজটি, কিন্তু খুব অন্য ধাঁচের কাজ। চাঁদের আলোয় শুয়ে থাকা এই ছেলেটি চাঁদকে ভালবাসে। সে যেন সেই আলো সম্পূর্ণ ভাবে শোষণ করে নিয়ে অন্য এক জগতে অবস্থান করছে। বিষাদবিধুর এই ছবি।

সুদেষ্ণা হালদারও সেই আধুনিকতার বিপর্যয়ের কথাই বলতে চেয়েছেন, ক্যানভাসের উপরে অ্যাক্রিলিকে করা কাজটিতে। তাঁর কাজে মুখ্য চরিত্র একজন নৃত্যরত পুরুষ। কিন্তু সেই নৃত্যের ভঙ্গিতে এক আদিমতার ছাপ। এই আদিম পুরুষ যেন আধুনিক সভ্যতার হাজার সমস্যায় জর্জরিত। মানুষকে সচেতন করতে কিছু বলতে চাইছে সে।

তাপস কোনারের কাগজের উপর গোয়াশের কাজ। ‘ম্যাজিক অব ড্রিঙ্কিং মোমেন্টস’ বেশ অন্য রকম ছবি। পৌরাণিক কিছু চরিত্রকে অদ্ভুত ভাবে টুকরো টুকরো করে কাগজে বসিয়েছেন। যেন আধুনিক জীবনের শূন্যতা বা কর্মহীনতাকে তুলে ধরেছেন। এই কাজ তাপসের নিজস্ব শিল্পীসত্তার পরিচয়বাহী।

চয়ন রায়ের মিশ্র মাধ্যমের ছবিতে অ্যাক্রিলিক, সুতো এবং লোহার জালের সমন্বয় ঘটিয়েছেন ক্যানভাসে। বর্তমান পরিস্থিতির বেদনার ছায়া আছে তাতে। অস্তিত্ববাদের বিপর্যয়ের কথাই বলতে চেয়েছেন শিল্পী। সম্পূর্ণ বিমূর্ত ছবি। সুনীল দে-র ক্যানভাসের উপরে অ্যাক্রিলিকে করা বিমূর্ত ছবি। সীমিত প্যালেটে কাজ করেছেন, কিন্তু ভাবটি সুন্দর ফুটেছে। দশরথ দাস পাঁচটি মিশ্র মাধ্যমের ছবি দেখিয়েছেন। কিন্তু পাঁচটির‌ই শিরোনাম এক— ‘ডিপেন্ড অন দ্য লেটার’। পুরনো ঐতিহ্যবাহী নানা ইউরোপীয় পেন্টিংয়ের টুকরো টুকরো অংশ পটভূমিতে রেখে সামনের অংশে আধুনিক সভ্যতার মেশিন, জন্তু-জানোয়ার, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি দিয়ে অতীত এবং আধুনিকতাকে এক জায়গায় ধরেছেন। ঋষি বড়ুয়ার অ্যাক্রিলিক শিটের উপর রিভার্স পেন্টিংয়ে আধুনিক মানসিকতার জটিলতা এবং সমস্যাদীর্ণ জীবনের ছবি পাওয়া যায়।

শিল্পীরা এখানে একত্রিত হয়ে নানা সমস্যার কথা বলেছেন ঠিক‌ই, আবার কোথাও আশার আলো দেখাতেও সফল হয়েছেন। সেখানেই এই প্রদর্শনীর সার্থকতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Art exhibition Faith artist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE