Advertisement
E-Paper

চিত্রে সমসময়ের এক প্রতিবাদী ধারাভাষ্য

প্রদর্শনীটি আয়োজিত হয়েছিল জলসাঘর আর্ট গ্যালারিতে। প্রয়াত শিল্পী দেবব্রত মুখোপাধ্যায় স্মরণে এই প্রদর্শনী।

অতনু বসু

শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২২ ০৭:৫৩
প্রতীকী: শিল্পী দিলীপ দেবনাথের একক প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম

প্রতীকী: শিল্পী দিলীপ দেবনাথের একক প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম

তিনি চেষ্টা করেছেন, তাঁর সময়ের একটি সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থাকে চিত্রে প্রকাশ করার। রেখা, ড্রয়িংয়ের অনুপুঙ্খময়তায় তিনি সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন নিঃসন্দেহে। প্রতিবাদী কিন্তু মুখর নন, বরাবর নিজেকে যথাসম্ভব আড়ালে রাখা শিল্পী দিলীপ দেবনাথের একক প্রদর্শনী তাই এক অর্থে খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। যাঁরা তাঁকে দীর্ঘকাল চেনেন, তাঁদের বেশির ভাগের পক্ষে যদিও এ প্রদর্শনী দেখা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। প্রদর্শনীটি আয়োজিত হয়েছিল জলসাঘর আর্ট গ্যালারিতে। প্রয়াত শিল্পী দেবব্রত মুখোপাধ্যায় স্মরণে এই প্রদর্শনী।

প্রায় কুড়িটির কাছাকাছি কাজ ছিল। দু’টি ভাস্কর্য, বাকি সব ড্রয়িং, ছোট পেন্টিং কাগজে। প্রখর ড্রয়িং, তুলি ও নিবের রেখার ওই ছন্দোময় অথচ দুরন্ত অভিব্যক্তিময় চলন ছবিগুলিকে প্রাণিত করেছে। সামান্য কয়েকটি তুলির টানটোনে তিনি অবয়বী এক-একটি চরিত্রের গতি, ভঙ্গি, বিশেষত একটা ফোর্সকে চমৎকার ভাবে উপস্থাপিত করেছেন। হিউম্যান ফিগার ও তার মুহূর্তগুলির এক নিখুঁত রিয়্যালিজ়মকে দিলীপ যে ভাবে মূর্ত করেছেন, তা মনে রাখার মতো।

দীর্ঘকাল নীরবে কাজ করা এই শিল্পী সমাজ-সংস্কার, শাসনব্যবস্থা, মানুষের দৈনন্দিন যাপন, রাজনীতি ইত্যাদিকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। প্রচুর কাজ করলেও, বহু জনের কাছে সে সব কাজ অলক্ষ্যেই রয়ে গিয়েছে। তাঁর তীব্র প্রতিবাদ নিবিষ্ট হয়ে থাকে সৃষ্টিতে। রাজনৈতিক আদর্শের হাত ধরেই নিজস্ব নির্মাণের গতিপথ সঞ্চারিত হয়েছে। সেই হিসেবে তাঁর ছবির রাজনৈতিক ভাষা বুঝতে অসুবিধে হয় না, দর্শকের আত্মোপলব্ধিতে ধাক্কা দেয় সেই প্রতিবাদ। এই জায়গাটিতে দিলীপ কোনও দিনই কোনও কিছুর সঙ্গেই আপস করেননি। বামপন্থায় বরাবর অবিচল এই শিল্পী তাঁর জাত চিনিয়েছেন এক-একটি ছবির মধ্য দিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ের যে সব নৈরাজ্য ও নৈরাশ্যজনক ঘটনা বা এক ধরনের রাজনৈতিক অরাজকতার বাতাবরণ— তাঁর সরব প্রতিবাদসমূহই প্রতিধ্বনিত সেই সব চিত্রের রং, রেখা, বিষয় ও ভাষ্যে। তাই তিনি নিজেই বলেছেন, “এ ছবির রং আলাদা, কুশীলব আলাদা, আলাদা সঙ্গ। এ ছবির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য রাজনৈতিক এবং স্পষ্ট।” এই স্পষ্টোচ্চারণই তাঁর মন্ত্র।

তিনি জানিয়েছেন যে, সামাজিক রাজনৈতিক ওঠাপড়া থেকে পরিস্থিতির যে পরিবর্তন ঘটেছে, তা শিল্পীকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছে। হ্যাঁ, তিনি অনেক কাজেই বিষয়কে প্রত্যক্ষ ভাবে ব্যক্ত না করে, রূপক বা প্রতীকের সংকেতেও দেখিয়েছেন। তাই তিনি বলেওছেন যে, “রূপকের প্রতি অনুরাগ এবং কাব্য পুরাণাশ্রিত বিষয়-ভাবনা আমার ছবিতে প্রাধান্য পেয়েছে।” মহাকাব্যিক ভারতীয় পুরাণের রাজনীতিকেও তিনি উপলব্ধি করিয়েছেন।

জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার ভাবনায় তিনি মধ্যমণি পেঁচার রূপক-এ, ভণ্ড তপস্বীর ধারণাকে যেন উসকে দিয়েছেন, বুঝতে অসুবিধে হয় না। এই পেঁচার নানা রূপকে তিনি শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন অনুষঙ্গের সাহায্যে প্রাঞ্জল করেছেন। উষ্ণীষ, সিংহাসন, আলঙ্কারিক রাজছত্র ইত্যাদির সঙ্কেত— যার আড়ালে এক ধরনের হিংস্রতার ছায়া তাঁর ছবির অন্যতম গুণ। কিরিকিরি রেখার বুনট, চমৎকার ছায়াতপ, সর্বোপরি পরিছন্ন ড্রয়িংয়ের পরিমিত ব্যবহার এক রকম নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করে। আহত, পর্যুদস্ত ও পতিত ঘোড়াটি যেন জনমানসের প্রতীক। তার উপরে নখর জান্তব হিংসার প্রতিভূ ওই স্তন্যময়ী পেঁচার নারীরূপ। এমনই এক ছবি ঘোড়ামুখো মানব ও বহুস্তনী চোখ বাঁধা মানবীর স্ফীত পেট অবস্থান, পেঁচা তাঁর চিত্রে প্রতীকী, কিন্তু ভয়ঙ্করী! রেডিশ ব্রাউন ও যৎসামান্য ব্ল্যাক মিশ্রিত তাঁর ড্রয়িংগুলি অসাধারণ। এক রকম জ্যামিতি তৈরি হয়েছে এই বুদ্ধিমত্তার ড্রয়িংয়ে। এখানেও রূপক অর্থে তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট। ঘোড়া ও মনুষ্য অবয়ব নিয়ে শিল্পীর অন্তর্ভেদী অবলোকন গভীরতর রাজনৈতিক ব্যাখ্যার নিপুণ এক ধারাভাষ্যকে প্রতিফলিত করে। এই সূক্ষ্মতর স্ক্র্যাচ/স্ট্রোক ও অনেকটা হালকা পেপার-হোয়াইট ছাড়া ভলিউম ছবিকে মহার্ঘ করেছে। দু’টি ভাস্কর্যও প্রদর্শনীর অন্যতম আকর্ষণ।

আসলে লোভ, লালসা, নির্লজ্জ অবস্থা, দ্বেষ, স্বার্থান্বেষণ, আত্মম্ভরিতা, নৈঃশব্দ্যের হত্যালীলার আড়ালে ছদ্মবেশী রূপ, এক প্রখর ডিক্টেটরশিপের চরম নিদর্শনগুলিকে তিনি বুদ্ধিদীপ্ত ভাবে তাঁর ছবিতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ফলে সেই সব পোশাক ও আবরণ-নিরাবরণের অন্তরালের ভয়াল রূপটিই তাঁর ছবির রূপক, সঙ্কেত, প্রতীক। তাঁর কাছে এ সব ছবির বিষয় নিপীড়িত, আর্ত মানবিকতা। তাঁর ছবিতে ‘বারবার ভিন্ন ভিন্ন রূপে অত্যাচারিত মানুষের অসহায়তা, প্রতিবাদহীনতা ধরা দিয়েছে’— এ তাঁরই নিজস্ব ভাষ্য।

ছবির এই ‘ইনার মিনিং’-এর মধ্যে আত্মগোপন করে থাকা অত্যাচার আর প্রতিবাদহীনতা, অত্যাচারী ও অত্যাচারিত, নিপীড়ন-শোষণ ও শোষণকারী, ভেকধারী মানবী ও শোষিত মানবসমাজ মানুষকে নিঃসন্দেহে একটা ধাক্কা দেয়। তবে তিনি কি কোথাও বলতে চেয়েছেন সেই সুবিখ্যাত গণসঙ্গীতের কথাই— ‘বিচারপতি, তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা’? হয়তো চেয়েছেন।

Art Art exhibition
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy