তিনি চেষ্টা করেছেন, তাঁর সময়ের একটি সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থাকে চিত্রে প্রকাশ করার। রেখা, ড্রয়িংয়ের অনুপুঙ্খময়তায় তিনি সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন নিঃসন্দেহে। প্রতিবাদী কিন্তু মুখর নন, বরাবর নিজেকে যথাসম্ভব আড়ালে রাখা শিল্পী দিলীপ দেবনাথের একক প্রদর্শনী তাই এক অর্থে খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। যাঁরা তাঁকে দীর্ঘকাল চেনেন, তাঁদের বেশির ভাগের পক্ষে যদিও এ প্রদর্শনী দেখা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। প্রদর্শনীটি আয়োজিত হয়েছিল জলসাঘর আর্ট গ্যালারিতে। প্রয়াত শিল্পী দেবব্রত মুখোপাধ্যায় স্মরণে এই প্রদর্শনী।
প্রায় কুড়িটির কাছাকাছি কাজ ছিল। দু’টি ভাস্কর্য, বাকি সব ড্রয়িং, ছোট পেন্টিং কাগজে। প্রখর ড্রয়িং, তুলি ও নিবের রেখার ওই ছন্দোময় অথচ দুরন্ত অভিব্যক্তিময় চলন ছবিগুলিকে প্রাণিত করেছে। সামান্য কয়েকটি তুলির টানটোনে তিনি অবয়বী এক-একটি চরিত্রের গতি, ভঙ্গি, বিশেষত একটা ফোর্সকে চমৎকার ভাবে উপস্থাপিত করেছেন। হিউম্যান ফিগার ও তার মুহূর্তগুলির এক নিখুঁত রিয়্যালিজ়মকে দিলীপ যে ভাবে মূর্ত করেছেন, তা মনে রাখার মতো।
দীর্ঘকাল নীরবে কাজ করা এই শিল্পী সমাজ-সংস্কার, শাসনব্যবস্থা, মানুষের দৈনন্দিন যাপন, রাজনীতি ইত্যাদিকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। প্রচুর কাজ করলেও, বহু জনের কাছে সে সব কাজ অলক্ষ্যেই রয়ে গিয়েছে। তাঁর তীব্র প্রতিবাদ নিবিষ্ট হয়ে থাকে সৃষ্টিতে। রাজনৈতিক আদর্শের হাত ধরেই নিজস্ব নির্মাণের গতিপথ সঞ্চারিত হয়েছে। সেই হিসেবে তাঁর ছবির রাজনৈতিক ভাষা বুঝতে অসুবিধে হয় না, দর্শকের আত্মোপলব্ধিতে ধাক্কা দেয় সেই প্রতিবাদ। এই জায়গাটিতে দিলীপ কোনও দিনই কোনও কিছুর সঙ্গেই আপস করেননি। বামপন্থায় বরাবর অবিচল এই শিল্পী তাঁর জাত চিনিয়েছেন এক-একটি ছবির মধ্য দিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ের যে সব নৈরাজ্য ও নৈরাশ্যজনক ঘটনা বা এক ধরনের রাজনৈতিক অরাজকতার বাতাবরণ— তাঁর সরব প্রতিবাদসমূহই প্রতিধ্বনিত সেই সব চিত্রের রং, রেখা, বিষয় ও ভাষ্যে। তাই তিনি নিজেই বলেছেন, “এ ছবির রং আলাদা, কুশীলব আলাদা, আলাদা সঙ্গ। এ ছবির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য রাজনৈতিক এবং স্পষ্ট।” এই স্পষ্টোচ্চারণই তাঁর মন্ত্র।