Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

পাঠ পরিবর্তন

দশকের পর দশক ধরে পাঠকের রুচি বদলের খতিয়ান দিচ্ছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্যবাঙালির সাহিত্য পড়া নিয়েও অঢেল গল্প চালু হয়ে গেছে গত পঞ্চাশ-ষাট বছরে। তেমন কিছু গল্প আমি চাক্ষুষও করেছি। সে-সব গল্প পর পর সাজালে এখন একটা রুচি বিবর্তনের ছবি পাই। আমার কটকটে বন্ধুরা যাকে সোজাসাপ্টা বলে দেয় গোত্রান্তর। ১৯৬৫-র একটা গল্প দিয়ে শুরু করছি, পরে আরও পিছনে যাব। সে-সময় ঘরে ঘরে ‘ঘরোয়া’ নামের এক সিনেমা ও সাহিত্যের মাসিক। আমাদের বাড়িতে আসে, আর কাড়াকাড়ি করে পড়া হয়। সেখানে বম্বের ফিল্ম জগৎ নিয়ে একজন (অবশ্যই শচীন ভৌমিক নন, যাঁর তো ভক্তই ছিলাম আমরা) ফি-সংখ্যায় একটা লম্বা রিপোর্ট লিখতেন।

মডেল: অর্জুন চক্রবর্তী ও তৃধা চৌধুরী। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

মডেল: অর্জুন চক্রবর্তী ও তৃধা চৌধুরী। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

শঙ্করলাল ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৬
Share: Save:

বাঙালির সাহিত্য পড়া নিয়েও অঢেল গল্প চালু হয়ে গেছে গত পঞ্চাশ-ষাট বছরে। তেমন কিছু গল্প আমি চাক্ষুষও করেছি। সে-সব গল্প পর পর সাজালে এখন একটা রুচি বিবর্তনের ছবি পাই। আমার কটকটে বন্ধুরা যাকে সোজাসাপ্টা বলে দেয় গোত্রান্তর।

১৯৬৫-র একটা গল্প দিয়ে শুরু করছি, পরে আরও পিছনে যাব। সে-সময় ঘরে ঘরে ‘ঘরোয়া’ নামের এক সিনেমা ও সাহিত্যের মাসিক। আমাদের বাড়িতে আসে, আর কাড়াকাড়ি করে পড়া হয়। সেখানে বম্বের ফিল্ম জগৎ নিয়ে একজন (অবশ্যই শচীন ভৌমিক নন, যাঁর তো ভক্তই ছিলাম আমরা) ফি-সংখ্যায় একটা লম্বা রিপোর্ট লিখতেন।

সে-বার এক নায়িকাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে শিউরে ওঠার মতো সব বাক্য লিখেছিলেন। যার একটি আজও ভুলিনি—‘তাঁর (সেই নায়িকার) ভাগ্য যেন জ্যৈষ্ঠের আকাশ’! এরকম আরও এক ডজন চোখে পড়ল।

কী ঘটল মগজে জানি না, আমি আর বন্ধু উৎপল (চক্রবর্তী, পরে আবগারি বিভাগের বড়কর্তা হয়েছিলেন) ফোন ঘুরিয়ে ধরলাম পত্রিকার সম্পাদক বীরেন সিমলাই মশাইকে। অতি সংযত, ভদ্র বাচনের মানুষ। লক্ষ্মীছাড়া বাংলার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ মন দিয়ে শুনে খুব শান্ত গলায় বললেন, ‘তাহলে পুজোসংখ্যা ‘দেশ’-এ সমরেশ বসুর ‘বিবর’ উপন্যাসটা পড়ুন। দেখুন কী বাংলা চলছে। তখনও ‘দেশ’ এসে পৌঁছোয়নি বাড়িতে, তাই বলতে হল, ‘‘ঠিক আছে। পড়ে নিই, তারপর ফোন করব।’’

‘দেশ’ আসতে প্রথম মুহূর্ত থেকে পড়া শুরু করলাম ‘বিবর’ এবং পৃষ্ঠা পাঁচেক পর থেকে বিলকুল ফিদা হয়ে গেলাম। অবিকল একই দশা উৎপলের। ওদিকে ‘দেশ’-এর চিঠিপত্রের পাতায় যখন ‘বিবর’ নিয়ে নারায়ণী সেনাদের কুরুক্ষেত্র চলছে আমরা বসার ঘর থেকে আলোচনাটা প্রথমে পাড়ার জামাইদা’র রেস্টুরেন্ট, পরে সাঙ্গুভ্যালি আর শ্যামল রেস্টুরেন্ট, শেষে কফি হাউসে নিয়ে তুললাম। সেখানে গিয়েও টের পেলাম কোনও না কোনও টেবিলে, কখনও না কখনও উছলে উঠছে ‘বিবর’ প্রসঙ্গ। ‘বিবর’-এর কথা মাথায় ঢোকানোর জন্য কৃতজ্ঞতা বশে সিমলাই মশাইকে আর ফোন করে জ্বালাইনি।

সাহিত্যের করুণা যে কোন পথ দিয়া জীবনে আসে এ নিয়ে ঠিকমতো ভাবা যেত না পঞ্চাশের দশকে। সিনেমা ভর করে তো সারাক্ষণ ঢুকছিলই, সিনেমার পত্রপত্রিকা তখন সেরা সাহিত্যের বাহনই বলতে গেলে। একটা ছোট্ট স্মৃতি বা গল্প, যাই বলুন, বলি?

বেশ চোখ মুছতে মুছতে ‘উল্টোরথ’ নাকি ‘জলসাঘর’-এ পড়ে ফেলেছিলাম সুবোধ ঘোষের ‘সুজাতা’ উপন্যাস। যাকে পাই ধরে বলি। কখনও ছাদে বা রকে বসে বা কোথাও যাবার জন্য ট্রামের অপেক্ষায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু কে আর বালকের কমেন্টকে পাত্তা দেয়। ফলে দেখতে দেখতে আমিও ভুলে গেলাম সুজাতার দুঃখকষ্ট।

এরপর হঠাৎ একদিন হলে হলে লেগে গেল বিমল রায়ের হিন্দি ছবি ‘সুজাতা’, নায়িকার রোলে স্নিগ্ধ সুন্দরী নূতন। নায়ক সুনীল দত্তের লিপে তালাত মাহমুদের প্রেমের গান ‘জ্বলতে হ্যায় যিসকে লিয়ে’-ও ইন্সট্যান্ট হিট। অমনি খোঁজ পড়া শুরু হল কাহিনি নাকি কোনও বাঙালির?

এবং অচিরে এও উতরোল যে ‘সুজাতা’-র কাহিনিকারেরই কলমে রোববার-রোববার আনন্দবাজারের পাতায় এসেছে ‘ভারত প্রেমকথা’-র একেকটি উপাখ্যান। তার কিছু দিনের মধ্যে এই কাহিনিকার সুবোধবাবুর আরও এক কাহিনি উদিত হল রুপোলি পর্দায় ‘শুন বরনারী’ টাইটেলে। ‘থির বিজুরি’ নামে ওঁর এক গল্প সংকলনও বাজারে আসে এ সময় এবং আধুনিক বাংলা ছোট গল্পের এক মানদণ্ড হয়ে ওঠে।

কার কলমে কী ভাল আসে, কার দর কত, এসব বার করার জন্য কলেজ, লাইব্রেরি, টিউশানির মাস্টারের দ্বারস্থ হতে হচ্ছিল না বাঙালি ছেলেছোকরাদের; পাড়ার রক আর চায়ের দোকানই ঢের কাজের। যেখানে বসে তারা এও জেনে যায় জলসায় হেমন্তর ফিজ কত, গুরু ও গীতা দত্তের দাম্পত্যে ভাঙন ধরিয়েছেন ওয়াহিদা রহমান এবং সন্ধ্যার ক্ল্যাসিকালের টক্কর না নিয়ে রঞ্জি স্টেডিয়ামের জলসা থেকে উঠে গেছেন লতা।

বলা বাহুল্য, এর অনেক কথাই মুখে মুখে রটা। তবে গুরু ও গীতার ঘটনাগুলো এসেছিল এক ফিল্মপত্রে বিমল মিত্রের ধারাবাহিক স্মৃতিচারণা ‘বিনিদ্র’ থেকে। বলতে নেই, জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কবিতাটা আমি প্রথম পড়ি এক সিনেমার ম্যাগাজিনে। শচীন ভৌমিক পুরো কবিতাটাই তুলে দিয়েছিলেন ওঁর কলামে সেরা রোম্যান্টিক কবিতার নমুনা হিসেবে।

আর একবার ওঁর জনপ্রিয় প্রশ্নোত্তর কলামে ‘আপনার মতে এখনকার শ্রেষ্ঠ বাঙালি ঔপন্যাসিক কে?’ এই প্রশ্নের জবাবে লিখেছিলেন, ‘‘শুধু আমার কেন, সবার মতে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।’’ সে-সময় ‘সপ্তপদী’ রিলিজ হয়-হয়, আর গোটা রাজ্য ম’ ম’ করছে তারাশঙ্করের খ্যাতির সৌরভে। ম্যাগাজিনে ছবি বেরোল ছবির মহরতে লেখকের পাশে বসে উত্তমকুমার। কাগজে বিজ্ঞাপন বেরোল তারাশঙ্করের সই ছাপিয়ে যে তিনি তাঁর বিয়োগান্তক কাহিনির মিলনাত্মক চলচ্চিত্ররূপ অনুমোদন করেছেন। মধ্য কলকাতার তালতলা পাড়ার নিয়োগিপুকুর লেনের পাবলিক লাইব্রেরিতে ‘সপ্তপদী’ বইটা তুলতে গিয়ে জানলাম আমার আগে সাতজনের নাম দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ সেখানেও আরেক সপ্তপদী!

বাঙালির সাহিত্যরুচির ছবি ধরতে আমি আরেকটু পিছিয়ে ১৯৫৫-য় যাব। তার আগে রুচি কথাটাকেই একটু বাজিয়ে দেখব। পারি তো?

খাদ্যরুচির বাইবেলস্বরূপ যে-বইটি ‘দ্য ফিজিওলজি অফ টেস্ট’ (স্বাদের শারীরবিজ্ঞান)— তার লেখক জ্যঁ-অঁতেলম্ ব্রিয়- স্যাভারাঁ (১৭৫৫-১৮২৫) অমর হয়ে আছেন একটি মন্তব্যের জন্য। যখন লিখলেন, ‘‘টেল মি হোয়ট ইউ ইট অ্যান্ড আই উইল টেল ইউ হোয়ট ইউ আর!’’

অর্থাৎ ‘আমাকে বলো তুমি কী খাও, আর আমি বলে দেব তুমি লোকটা কী’। সহজ করে বললে, খাওয়াদাওয়ার মধ্যে শুধুই আমাদের জাতিপরিচয় নয়, ব্যক্তিপরিচয়ও অনেকটাই সেঁধিয়ে। মানুষের মনের অনেকখানি ছবি আসে তার খাদ্যরুচিতে।

আমার বইঅন্তপ্রাণ বাবা অবশ্য মনে করতেন সব চেয়ে ভাল মানুষ চেনা যায় বইয়ে। কারণ কে কী পড়ছে দেখে কে কী ভাবছে, কীসে মজে আছে, তার মনে কী-কী ধারণা, অনুভূতি, রাগ-বিরাগ কাজ করছে আঁচ করা যায়। বাবার মত ছিল: ‘ইউ আর হোয়ট ইউ রিড’। তুমি যা পড়, তুমি আসলে তাই।

আমি এই অতি উপাদেয় বিতর্কের মধ্যে যাব না। বরং, যেমন বলছিলাম, ১৯৫৫-য় পিছিয়ে যাব ...

রুশ নেতৃদ্বয় বুলগানিন ও ক্রুশ্চেভ এসেছেন কলকাতায়। শহরে জনজোয়ার তাঁদের দর্শন নেবার। বাবাকে বাড়ি এসে বই বিক্রি করতেন যে-প্রবীণ ভদ্রলোক তিনি কিন্তু হতাশার সুরে বললেন, ‘‘বড়বাবু, রাশিয়া নিয়ে এত হইচই দেখে বেশ কিছু টলস্টয়, তুর্গেনিভ জোগাড় করে রেখেছিলাম। কই, সেভাবে তো কাটাতে পারলাম না?’’

বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তাহলে কাটে-টা কী?’’

ভদ্রলোক বললেন, ‘‘ওই যা-সব বই নিয়ে পরে বায়োস্কোপ হয়। মানে বাংলা গল্প-উপন্যাস আর কী!’’

বাবা হেসে বললেন, ‘‘তার মানে যদি হয় শরৎবাবু, তারাশঙ্কর, তাতে ক্ষতি কী? তবে এখানে টলস্টয় বিক্রি হওয়াটাও খুব দরকার। যাক্ গে, আপনার টলস্টয় যা আছে সব রেখে যান।’’

দু’ আড়াই টাকা দামের খান পনেরো মোটা মোটা টলস্টয়, তুর্গেনিভ রেখে চলে গেলেন ভদ্রলোক। মেধাবী ছাত্র দেখে দেখে সেগুলো দান করা ধরলেন বাবা। এদের একজন ছিলেন মেডিকালে স্ট্যান্ড করা এক যুবক। যিনি এর বহু দিন পর আমার কাছে কবুল করেছিলেন, ‘‘টলস্টয়ের ওই গল্পগুচ্ছ পড়ে কী একটা হল ভেতরে। ঠিক করলাম গ্রামের ছেলে গ্রামে ফিরেই কাজ করব। তাই করেছি ... আর শান্তিতেই আছি।’’

১৯৫৫-র আরেকটি দৃশ্য কদাচ ভোলার নয়। সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ ছবি দেখে ফিরে লোকজনের মুখের অবস্থা। এতই স্তম্ভিত তারা যে রা কাড়তে পারছে না। একটা ছবি দেখে এল, না উপন্যাস পড়ে বেরোল, বোঝা মুশকিল। এদের অনেকেরই ‘পথের পাঁচালী’ পড়া, কিন্তু ছবি নিয়ে বলার মধ্যে শুধু অপু-দুর্গার রেল দেখা, দুর্গার মৃত্যু আর সর্বজয়ার কান্না। ছবির যে-সিকোয়েন্সগুলো বাঙালির বুকে সেই থেকে ছেপে বসে আছে।

দৃশ্যের উল্লেখটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ‘পথের পাঁচালী’-র পর থেকে লোকজন দেখতাম সত্যজিৎ রায়ের ছবি এলে আলোচনায় বসত এবার কার কাহিনি নিয়ে ভদ্রলোক ছবি করতে চলেছেন। কারণ কস্মিন কাল থেকেই তো বাঙালি বই ধরে ধরে ছবি দেখে এসেছে। বইয়ের সঙ্গে ছবিকে না মেলালে আর মজা কোথায়? যে-চলচ্চিত্রদর্শন ধারায় একটা ভূমিকম্পের মতো হয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’। বই পড়া থাকলেও ছবিকে ছবির মতো দেখতে হবে।

একদিন এক ঘরোয়া আড্ডায় যা নিয়ে খুব সুন্দর বলেছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের বিশ্রুত অধ্যাপক জ্যোতি ভট্টাচার্য।

বলেছিলেন, ‘‘‘পথের পাঁচালী’ দেখাটা উপন্যাসের পুনর্পাঠের মতো হয়েছিল আমাদের, জানো তো।’’

কথা হচ্ছিল আশির দশকের উপান্তে। এর কিছু দিন পর আমি ম্যাক্সমুলার ভবনে নিকোস কাজানজাকিস-এর উপন্যাস ‘জোর্বা দ্য গ্রিক’ অবলম্বনে মাইকেল কাকোয়ানিস-এর মহৎ চলচ্চিত্রটি দেখানোর ব্যবস্থা করি। অ্যান্থনি কুইন, অ্যালান বেটস, ইরেন পাপাস ও লিলা কেদ্রোভার অভিনয় এবং মিকিস থিওডোরাকিস-এর সঙ্গীতে সে এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। ছবিটা দেখে বহুক্ষণ স্তব্ধ ছিলেন জ্যোতি ভট্টাচার্য, মুগ্ধতা যেন আর কাটে না। শেষে কোনও মতে বললেন, ‘‘এ তো আরেক ‘পথের পাঁচালী’ দেখালে। এবার উপন্যাসটা পড়াও।’’

দিন পনেরোর মধ্যে বড় আকারের উপন্যাসটা দু’দুবার পড়ে ফেরত দিতে দিতে বলছিলেন জ্যোতিবাবু, ‘‘এই বোধ হয় প্রথম একটা ছবি দেখে বইতে ফিরে গেলাম।’’

বলেছিলাম, ‘‘কেন, পঞ্চাশের দশকে এটাই তো বাঙালি করছে দেখতাম।’’ জ্যোতিবাবু বললেন, ‘‘ঠিক। সেই পড়ুয়া বাঙালি কি আর আছে? সিনেমা দেখার নেশা তো ভাল, যদি সেটা ভাল ছবির নেশা হয়। তা বলে পড়ার নেশায় ইস্তফা দেবে কেন সে?’’

বই পড়ে সিনেমা দেখা আর সিনেমা দেখে বই খোঁজাটাই সার নয় পঞ্চাশের দশকের বই পড়ার। শংকরের ‘কত অজানারে’ তো সিনেমা হয়নি, অথচ, কী তুমুল বৈঠক তাই নিয়ে বাড়িতে বাড়িতে, বৈঠকখানায় বৈঠকখানায়!

বৈঠকখানা কথাটাই তো অচল হয়ে গেছে এখন। মধ্যবিত্ত বাঙালি পাড়ায় ক’টা বাড়িতেই বা বৈঠকখানা থাকত? কিন্তু বৈঠকখানা থাকলে সেখানে চা, তেলেভাজা, মুড়ি, তাস, দাবার মতো থাকতেই হত সাত্তার, আহমেদ, কিট্টুর ফুটবল, মাঁকড়, হাজারের ক্রিকেটের পাশাপাশি শ্যামাপ্রসাদ, বিধান রায়, পুদুচেরীর মাদার, সাহেব বিবি গোলাম, কী হাটে-বাজারে চর্চা।

হাফপ্যান্ট পরা আমাদের এই সব বৈঠকে ঢোকা ছিল না। বড় জোর মুঠো করে মুড়ি-আলুর চপ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া ছিল। কখনও বৈঠকখানার জানলার বাইরের ধাপিতে কেদরে বসা ছিল। ওই ভাবেই ঝুলন্ত বসে একদিন টের পেয়েছিলাম বাংলা গল্পের জগতে এক নতুন খেলোয়াড় এসেছে, শংকর। প্রথম লেখা ‘কত অজানারে’ দিয়েই নিজেকে জানান দিয়েছেন।

পঞ্চাশের দশকে চারটে মৃত্যুর চর্চা খুব শুনেছি। প্রথমটি কাশ্মীরে বন্দিদশায় শ্যামাপ্রসাদবাবুর, দ্বিতীয়টি আইনস্টাইনের, তৃতীয় ও চতুর্থটি, যথাক্রমে জীবনানন্দ ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের। সুধীন্দ্রনাথের মৃত্যুর খবর কাগজে কেমন এসেছিল মনে নেই, তবে দিনের দিন খবরটা আমাদের বাড়িতে এনেছিলেন তৎকালে মধ্য কলকাতার এক প্রসিদ্ধ সন্তান। আর মাথা নেড়ে বার বার বলছিলেন, ‘‘খুব ক্ষতি হয়ে গেল। খুব ক্ষতি হয়ে গেল। সুধীনদা চলে গেলেন।’’

সুধীন দত্ত কে সেটাই তখন আমার পরিষ্কার জানা নেই, আর আজও পরিষ্কার নয় কবির কী সম্পর্ক ছিল প্রাণোচ্ছল এই মানুষটির সঙ্গে। এত দিনের দূরত্বে এখন শুধু এটাই মনে আসে যে মধ্য কলকাতার আমরা বেশ একটু কমপ্লেক্সেই থাকতাম যে অধিকাংশ বড় সাহিত্যিকের ঠিকানাই উত্তর কলকাতায়। স্বয়ং কবিগুরুই বুঝেশুনে জন্মেছিলেন জোড়াসাঁকোয়। আমাদের মুখরক্ষা করেছিলেন শুধু কবিকুলমণি মাইকেল মধুসূদন, মৌলালির মোড়ের কাছে এক বিলিতি খাঁচার ইমারতে জীবনের শেষ কিছু দিন কাটিয়ে।

বাঙালির কবি-কবি স্বভাব আর কবিতা-প্রেম নিয়ে কথাবার্তার অন্ত নেই। কিন্তু কোনও বিয়ে বা জন্মদিনের উপহারে গীতাঞ্জলি, সঞ্চয়িতা বা কাজী নজরুলের সঞ্চিতার বেশি কিছু চোখে পড়ত না। যে ট্যাডিশন ভঙ্গ করেছিল অপরূপ প্রচ্ছদে মোড়া প্রেমেন্দ্র মিত্রের পুরস্কৃত কাব্যগ্রন্থ ‘সাগর থেকে ফেরা’। ষাটের দশকে ঘরে ঘরে নাম ছড়িয়েছে জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসুর, কিন্তু শক্তি, সুনীল, বিনয়ের কবিতা নিয়ে কফির কাপে তুফান ওঠা দেখতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ষাটের দশকের শেষ পাদ অবধি। তত দিনে উপন্যাসের ক্ষেত্রে সমরেশ বসুর ‘বিবর’ ও ‘প্রজাপতি’ এবং বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভরে বৃষ্টি’-র ভয়ঙ্কর পর্ব কেটে গেছে।

ভারতের স্বাধীনতার আশপাশ সময়ে জন্ম যে-বাঙালি প্রজন্মের তাদের সাবালক হওয়ার সঙ্গে ছয়ের দশকটা ওতপ্রোত জড়িয়ে। তাদের সাহিত্য পড়ার সঙ্গেও ষাটের দুই অর্ধেরই নিবিড় যোগ।

‘বিবর’, ‘প্রজাপতি’ যেমন বই পড়াপড়ি থেকে ‘নিষিদ্ধ’ শব্দটা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল, তেমনি ১৯৬৬-তে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ বই হয়ে প্রকাশ পেয়ে সাহিত্যের পুনর্পাঠ ব্যাপারটাকে প্রায় নতুন করে চালু করল। কেন, বলি ...

‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’-র বছর দুই আগে কালিদাসকে নিয়ে ‘কুমারসম্ভবের কবি’ শরদিন্দুবাবুর উপন্যাসটা বাজারে এসেছিল। আর তারও বছর পাঁচ-ছয় আগে এক ফিল্ম ম্যাগাজিনে আলাউদ্দিন খিলজিকে নিয়ে ওঁর দুর্ধর্ষ নভেলেট ‘শঙ্খ কঙ্কণ’ মানুষকে বুঁদ করে দিয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই; ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’, ‘গৌড়মল্লার’, ‘কালের মন্দিরা’-র মতো সুগবেষিত, অপূর্ব বিনোদনী ঐতিহাসিক উপন্যাসও যে তিনি দশ-পনেরো-কুড়ি বছর আগে লিখেছেন তার স্মৃতি অনেকটাই নিভে এসেছিল। প্রথমে শারদপত্রে প্রকাশ, পরে বই আকারে মুক্তি এবং শেষে রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়ে ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ শরদিন্দুকে এমন এক প্রচার দিল যা এক দশক আগে ‘ঝিন্দের বন্দী’ সিনেমা হয়ে ওঁকে দিয়েছিল।

তবে ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’-র প্রচারের প্রভাব অনেক ব্যাপক ও গভীর হল। কারণ শুধু ঐতিহাসিক উপন্যাসের রকমসকম নয়, আলোচনায় উঠে আসতে লাগল লেখকের গদ্য, উপন্যাসের ভাষা, কল্পনা ও বাস্তবের মিলমিশ ও বিচ্ছেদ। এই বাঙালি পাঠককে কিন্তু তৈরি করেছিল ষাটের দশকের প্রথমার্ধ। আরও বিশেষ করে বললে ১৯৬১-তে রবীন্দ্রশতবার্ষিকী ও তার দীর্ঘ অনুরণন। ১৯৬৪-তে কবির ‘নষ্টনীড়’ গল্প অবলম্বনে ‘চারুলতা’ ছায়াচিত্র এবং ১৯৬৫-র মার্চে সতীনাথ ভাদুড়ীর অকাল প্রয়াণ।

যে-প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে সতীনাথের প্রসঙ্গ আনলাম তাদের প্রিয়তম সতীনাথীয় উপন্যাস ‘জাগরী’ লিখিত (১৯৪৫) ও পুরস্কৃত হয়েছিল তাদের জন্মের আগে, ধারাবাহিক ‘অচিন রাগিণী’-র আলোচনা তারা শুনেছে বড়দের মুখে এবং লেখকের মহৎ কীর্তি ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’-এ তারা ঢোকার পথ পায়নি ভাষা, জীবন ও ভঙ্গির জটিলতা ভেদ করে। ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ এবং অংশত ‘বিবর’ উপন্যাসের ভাষাকে স্বাধীন এক প্রসঙ্গ করে তাদের ফিরিয়ে দিয়েছিল ঢোঁড়াই চরিতে।

রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-তে যেতে খুব বেশি সময় নেননি সত্যজিৎ। অর্থাৎ এক গদ্য থেকে আরেক গদ্যে। বাঙালির এক জীবন থেকে আরেক জীবনে এবং দশক শেষে ‘দেশ’ পত্রিকার পূজা বার্ষিকীতে তিনি লেখা ধরলেন ফেলুদাকে নিয়ে রহস্যোপন্যাস। উপন্যাস রচনায় ওঁর ঝটিতি দুরন্ত সাফল্যও বাঙালির পাঠাভ্যাসে এক ‘গেমচেঞ্জার’-এর কাজ করেছে। এক হাওয়াবদলই যেন দিনে দিনে।

এখনও আমরা ষাটের দশকের শেষ দু’তিনটে বছর ছেড়ে যাইনি কিন্তু। আমরা এখনও নিত্য বসছি কফি হাউসে, বসন্ত কেবিনে, দিলখুশা, অ্যালেন, বেঙ্গল, কাফে ডি মনিকোতে। সেখানে আলোচনা বলতে উঠে আসে শক্তির ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’, বিনয়ের ‘ফিরে এসো চাকা’ এবং বাংলা উপন্যাসের এক নতুন স্বর। তাঁর সদ্য মাড়ভাঙ্গা কাজ, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ যা নিয়ে ছবি করছেন সত্যজিৎ।

কফি হাউসে নিত্য বসেন নির্মাল্য আচার্য তাঁর ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘এক্ষণ’ পত্রের কাজ ও আড্ডা নিয়ে। মাঝে মাঝেই এসে পড়েন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র সৌরভ জড়ানো সৌমিত্র, বসেন জানলার পাশে শীতের বা বসন্তের রোদটা গায়ে নিয়ে।

অন্য টেবিলে তখন হয়তো চর্চা চলছে ‘এক্ষণ’-এর মহাকবি দান্তেকে নিয়ে গড়া সংখ্যা নিয়ে। বিভিন্ন সময়ে যেমন কথা চলেছে তাঁদের প্রকাশিত কমলকুমার মজুমদারের গল্প ‘গোলাপ সুন্দরী’ বা ‘শ্যাম নৌকা’ নিয়ে। দ্বিতীয়টির প্রকাশকাল তো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বছর ১৯৭১।

বৃহৎ বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলোয় যখন উপন্যাসের জোয়ার লেগেছে, তাদের শারদসংখ্যাগুলো ঝলমল করছে রমাপদ, সমরেশ, সুনীল, শ্যামল, শীর্ষেন্দুর নামে ও কাজে, তখন তিনটি নাম ও তাঁদের কাজের ক্রমপ্রসরমাণ খ্যাতি নজরে আসতে লাগল পাঠকের। এক, সত্যজিৎ রায়। তাঁর ফেলু ও শঙ্কু যে থাকার জন্য এসেছে সেটা সবাই টের পাচ্ছে। দুই, ‘হাজার চুরাশির মা’-র রচয়িতা মহাশ্বেতা দেবী, যিনি সাহিত্যে এক নতুন খননকার্য শুরু করতে চলেছেন অরণ্যের জীবন-মৃত্যু, জয়-পরাজয় ও অধিকার নিয়ে উপন্যাস লিখে। আর তিন, কমলকুমার। তাঁর রচনা পাঠ কতটা হয় হলপ করে বলতে পারব না, কারণ তখন তাঁর লেখা কোনও পত্রিকায় বেরোলে সেই পৃষ্ঠাগুলো কেটে কেটে প্রিয় পাঠকদের পাঠান। অথচ তিনি সারাক্ষণ চর্চার মধ্যে থাকেন।

চর্চায় ব্যাপক ভাবে উঠে এসেছিলেন ‘এক্ষণ’-এ এক অপূর্ব এবং বিস্ময়কর স্মৃতিরেখানির্ভর উপন্যাসোপম রচনা ‘কর্তামশাই’ লিখে অন্ধ চিত্রকর বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। সে-সময় কফি হাউসে একটা মন্তব্য শুনেছিলাম এক তরুণ বুদ্ধিজীবীর, ‘‘যাঁর চোখে ঝুলত মাইনাস তোরো-চোদ্দোর চশমা। এ লেখা কোনও শিল্পী ছাড়া কারও কম্ম নয়। বাস্ রে, যা ডিটেল! যা ডিটেল!’’ বহুকাল পর ওই লেখা নিয়ে অনুরূপ মন্তব্য ধ্বনিত হতে শুনেছি কলকাতা বিশারদ রাধাপ্রসাদ গুপ্তের কণ্ঠে। সঙ্গে তাজ্জব করা সংযোজন: শুধু শিল্পী হলেই হবে না। হতে হবে অন্ধ শিল্পী। কত রকম আওয়াজের কথা বলা আছে খেয়াল করেছ? বাসন মাজার আওয়াজ, কলতলার কলকাকলি, ঘড়ির ঢং, রেলের ধ্বনি...

সত্তর দশকের মূল ধারা গল্প-উপন্যাসে বড় নাম হয়ে উঠতে সময় নেননি সুনীল, শীর্ষেন্দু, শ্যামল, দেবেশ, অতীন, প্রফুল্ল। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘বারো ঘর এক উঠোন’ এবং সন্তোষকুমার ঘোষের ‘শেষ নমস্কার: শ্রীচরণেষু মা’কে’ ধারাবাহিক উপন্যাস পড়ে ‘এর পর নতুন কী? নতুন কী?’ ভাব সবার মধ্যে। ‘দেশ’ সম্পাদক পর পর তিনটি তুরুপের তাস বাজারে ছেড়েছিলেন। প্রথমে সুনীল, কিছু দিন পর শীর্ষেন্দু এবং আরও কিছু কাল পর সমরেশ মজুমদার।

শীর্ষেন্দুর ‘যাও পাখি’ আর সমরেশের ‘উত্তরাধিকার’-এর সাফল্য বাড়িয়ে বলার সুযোগ নেই। দুটি অনবদ্য ধারাবাহিক। কিন্তু বাংলা ধারাবাহিকের শিরোমণি কীর্তির মতো হল সুনীলের ‘সেই সময়’। আকার-প্রকার, ভাষা ও বিনোদনে এই সময়ের এক সেরা স্মৃতি ‘সেই সময়’।

তবে সাহিত্যিক বিচারে সত্তর দশকের উপন্যাসে স্টাইল, ফর্ম ও কন্টেন্টে অতি মার্জিত আধুনিকতা ও গভীরতার কাজগুলো এল তত দিনে ষাটোর্ধ্ব এক তরুণ ভাবুকের কলমে—রমাপদ চৌধুরী। ১৯৭৪-এর পুজোসংখ্যায় ‘খারিজ’ উপন্যাস দিয়ে যে-প্রক্রিয়ার শুরু। ক্রমে ‘দাগ’, ‘বাহিরী’ ও ‘বীজ’-এ বিস্ফোরণ।

আশির দশক থেকে দেখা গেল ড্রইংরুমে ড্রইংরুমে বইপত্র, ম্যাগাজিনের জায়গা মারছে টেলিভিশন। লেখক-কবিদের নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই, আড্ডা মানেই সিনেমা-টিভি’র তারকা। আর যখন সিরিয়াল নেই তখন দিনভর ক্রিকেট। বাংলা গল্প-উপন্যাসের মান রাখার জন্য টিভি’র পর্দাতেও নতুন-পুরনো কাহিনি এসেছে। কিন্তু সে-সব চোখে দেখা দায়।

একটা সময় ছায়াছবি দেখে লোকে বইয়ের খোঁজ করত। এখন টিভির প্রযোজনায় বিরক্ত হয়ে বইগুলোকেই বাতিল করে। এক সময় বাঙালি দর্শক ছবি দেখে অনুযোগ করত উপন্যাসের কত কিছুই বাদ গেছে পর্দায়। আর আজকাল কাহিনিকে হাজার এপিসোড টেনে দর্শকের জীবন পয়মাল করে ছাড়ে টিভি। কোনও নামকরা বই পর্দায় আসছে শুনলে হৃদকম্প হয় তার।

তবে নতুন সহস্রাব্দের সাহিত্যপাঠকের কাছে এ সব কোনও সমস্যাই নয়। কারণ বাংলায় কিছু পড়াপড়ি তাঁদের অনেকে হয়তো’বা ছেড়েই দিয়েছে। আধুনিক ইংরেজি শিক্ষায় বলীয়ান তারা চাইলেই জে. কে. রওলিং, জেফ্রি আর্চার, টম ক্লান্সি, মাইকেল ক্রিস্টন পড়তে পারেন। পুজোসংখ্যার ফসলের জন্য তার সময় কোথায়?

এই পাঠককুলের মধ্যে সিরিয়াস জনের দৃষ্টি কাড়ে হয়তো’বা মার্কেজ, কুন্দেরা, উম্বের্তো একো, রুশদি, বিক্রম শেঠের কাজে। বাঙালির লেখা উপন্যাসের কথা উঠলে এরা নাম করবে হয়তো’বা অমিতাভ ঘোষ, অমিত চৌধুরি ও কুণাল বসুর। এবং ভুল করবে না। কারণ বাঙালি, বলা উচিত কলকাতার জীবন নিয়ে দেখে, বুঝে, গবেষণা করে লেখার জীবন বেছে নিয়েছেন এঁরা। ভাষাটাই শুধু ইংরেজি।

উচ্চাঙ্গ গবেষক ও অধ্যাপিকা হিমানী বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি কানাডা থেকে এসে কিছু দিন এখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে তো স্তম্ভিত। জানলেন তারা নাকি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে চর্চা করছে ইংরেজিতে রবীন্দ্রনাথ পড়ে।

পোড়খাওয়া রাজনীতিকদের মধ্যেও সাহিত্য পড়ার চলটা কেমন ছিল, তার একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই।

দুই বর্ষীয়ান কংগ্রেসি হুমায়ুন আহমেদ আর অতুল্য ঘোষের মধ্যে মতভেদ চলছে তখন। কবীর সাহেব কলকাতায় আসতে দু’জনের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক হল বড় হোটেলে। দীর্ঘ বৈঠকের পর তাঁরা বেরিয়ে আসতে স্বভাবতই রিপোর্টারদের জিজ্ঞাস্য ছিল: কী কথা হল?

হাসিমুখে অতুল্যবাবুর জবাব ছিল: আমরা দু’জন আলব্যের কামুর উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করলাম।

১৯৫৬-য় নোবেল পুরস্কার পেলেন কামু, আর চার বছরের মাথায় দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল তাঁর। এর খুব কাছাকাছি সময়ে ওঁর প্রথম সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘দ্য আউটসাইডার’ বাংলায় অনুবাদ করে ফেলেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। নাম দিয়েছিলেন ‘অচেনা’।

ষাটের দশকের গোড়াতে আততায়ীর গুলিতে নিহত হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। গোটা বিশ্ব মুহ্যমান হয়ে গিয়েছিল। সেই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বই লিখলেন উইলিয়াম ম্যাঞ্চেস্টার। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রবিবার-রবিবার বইটির বঙ্গানুবাদ বেরোতে থাকল আনন্দবাজারের সাময়িকীতে।

এক কথায় দুর্ধর্ষ সেই অনুবাদ করেছিলেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। আমরা চাতকের মতো অপেক্ষায় থাকতাম সেই অনুবাদের। পরে মূল গ্রন্থ ‘ডেথ অফ আ প্রেসিডেন্ট’ পড়ে বুঝলাম মূলের চেয়ে অনুবাদটাই অনেক ভাল।

বাঙালি ছেলেমেয়েদের টিনটিন কমিক্সে টেনে এক বড় দায়িত্বও পালন করেছিলেন নীরেন্দ্রনাথ। শুধু টিনটিন কেন, গাবলুর অনুবাদ, আরও বহু দিন আগে থেকে গোয়েন্দা রিপ ও অরণ্যদেবের অনুবাদও তো ওঁরই সোনার কলমে। আফশোস হয় এই অপূর্ব কবি কেন আরও আরও অনুবাদে হাত ছোঁয়াননি।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এক প্রকাশনা সংস্থার পুজো সংখ্যাগুলোয় অবধারিত ভাবে থাকত একেকটি বিদেশি সাহিত্যকর্মের অনবদ্য বঙ্গানুবাদ। স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু এক বার করলেন গোগোল-এর মহৎ গল্প ‘দ্য ওভারকোট’-এর অনুবাদ। যে-গল্পটি সম্পর্কে দস্তৈয়েভস্কির অমর উক্তি আছে: আমরা সবাই (রুশ লেখকরা) গোগোলের ওভারকোটের তলা থেকেই বেরিয়ে এসেছি।

বলা বাহুল্য বুদ্ধদেবের অনুবাদটিও ছিল চমৎকার। পাশাপাশি আরও এক জনের অনুবাদে বাঙালি ছেেলপুলেদের জীবন বর্তে যাচ্ছিল। যাঁর নাম নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, যিনি লিখতেন অতি স্বাদু গদ্য এবং নিজের মৌলিক রচনায় যতিচিহ্ন হিসেবে দাঁড়ির ব্যবহার উঠিয়ে দিয়েছিলেন। পরিবর্তে ব্যবহার করতেন ফুটকি। বিদেশি লেখার অনুবাদে কিন্তু তিনি ফুটকি ব্যবহার করতেন না।

একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থার দাক্ষিণ্যে বাঙালি কিশোর-কিশোরী ক্রমান্বয়ে পেয়েছে রবার্ট লুই স্টিভেনসনের অমর কীর্তি— ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’, ‘কিডন্যাপড’, ‘ব্ল্যাকঅ্যারো’, ‘ডক্টর জ্যাকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড’। একটা নতুন জগৎই খুলে যাচ্ছিল তাদের চোখের সামনে। সেই সাহিত্যের ভোজে আরও যোগ হচ্ছিল অস্কার ওয়াইল্ডের গল্প ‘দ্য হ্যাপি প্রিন্স’ বা ‘দ্য সেলফিশ জায়েন্ট’। কিংবা আলেকজান্ডার ডুমা বা জুল ভার্নের বহু কাহিনি।

অনুবাদ এবং বিদেশি সাহিত্যসংশ্লিষ্ট মৌলিক বাংলা রচনার চল কিন্তু বহু দিনের। কোনান ডয়েলের ‘দ্য হাউন্ড অফ দ্য বাস্কারভিলজ’-এর অনুবাদ (বাস্কারভিলের কুক্কুর) তো হয় সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের এক পূর্বসূরির কলমে। পরে সত্যজিৎ নিজেও অপূর্ব অনুবাদ করেছেন এডোয়ার্ড লিয়রের ননসেন্স রাইমের, আর এও বলে গেছেন লুইস ক্যারল না হলে সুকুমার রায় হতেন না।

আমার একটা প্রশ্ন রেখেছিলাম ওঁর কাছে— মধ্যযুগীয় শিল্পী হিয়েরোনিমাস বশ্-এর ছবিরও একটা ছায়া দেখি আপনার বাবার ছবিতে। ভুল দেখি?

সত্যজিৎ খানিকক্ষণ ভেবে বলেছিলেন, হতে পারে, অসম্ভব নয়। তবে বাবা কোথায় কবে বশ দেখেছিলেন বলতে পারব না।

পঞ্চাশের অতি উচ্চমানের বাংলা মাসিক পত্রিকা প্রকাশ পেত। সেই পত্রিকা ‘ত্রয়ী’-তে কবি রবার্ট ব্রাউনিং ও তাঁর স্ত্রী কবি এলিজাবেথ ব্যারেট-এর সম্পর্ক নিয়ে একটা ধারাবাহিক উপন্যাস বেরোত ‘ব্রাউনিঙের প্রেম’। হাফ প্যান্ট পরা বয়েসে অমলেন্দু বসুর (যদি খুব ভুল না করি) সেই উপন্যাস পড়ে মুগ্ধাতিমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। পরে ফুল প্যান্ট পরা বয়েসে ‘ব্যারেটস অফ উইম্পোল স্ট্রিট’ নাটক পড়তে পড়তে মনের চোখে ভেসেছিল ওই লেখা।

বাংলা অনুবাদে জিম করবেট এবং কেনেথ অ্যান্ডারসন-এর শিকার কাহিনি পরিবেশন করার গুরু এবং সূক্ষ্ম দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। তদ্দিনে তিনি খুবই প্রতিষ্ঠিত আর তাঁর অরণ্যচর উপন্যাসের নামডাক হয়েছে। এমন এক দিন ওঁর প্রিয় প্রকাশকের অপিসে দেখা ওঁর সঙ্গে।

কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, নিজের লেখা সেরে এত সব বই অনুবাদের সময় কোথায় পান? তাতে উত্তর দিলেন, ‘‘আরে বাবা, ওতেই তো আমার সংসার চলে, আর করেও তো বড় আনন্দ পাই।’’

আশির দশকের গোড়ায় দেদার অনুবাদ চলছিল কোনান ডয়েল ও আগাথা ক্রিস্টির গল্প-উপন্যাসের। তাতে মন ভরার থেকে কষ্ট হয়েছে বেশি। মনে পড়েছে কী অসাধারণ সব অগাথা ক্রিস্টি অনুবাদ পড়েছি ইস্কুলে থাকতে। সে-ও সেই নীরেন্দ্রনা‌থ চক্রবর্তীর হাতে। ক্রিস্টির সেরা কীর্তি ‘টেন লিটল নিগারস’-এর তর্জমায় ‘দশ পুতুল’ আর ‘দ্য বিগ ফোর’-এর অনুবাদে, যদ্দুর মনে করতে পারি, ‘দ্য বিগ ফোর’ই। পরে মূল লেখা পড়ার পরও সেই স্বাদ থেকে গেছে।

শেষে আরেকটি অনুবাদের কথা বলব, উইলিয়ম হিকির অপরূপ ডায়েরির অনুবাদে বিনয় ঘোষের ‘হিকির ডায়েরি’। আহা কী প্রয়োগ বাংলা গদ্যের! সপ্তদশ শতকের ইতিহাস, জীবন ও সমাজ যেন সিনেমাস্কোপ স্ক্রিনে ভেসে উঠছে এক স্কুল বালকের মনের ভেতরে। সময়টা সেই ষায়ের দশকের গোড়া।

আর এর বেশ কিছুকাল পরে হাতে আরেক আশ্চর্য অনুবাদকর্ম। সঙ্গীতপণ্ডিত রামেশ্বর মিত্র কৃত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশাস্ত্রে মুসলমান চিন্তকদের অবদান-সমন্বিত ‘মোগল যুগের সংগীত চিন্তা’। এ বই পড়া বাঙালির কোনও দিনও শেষ হবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE