E-Paper

শাস্ত্রীয় নৃত্যগাথায় বাঙ্ময় পৌরাণিক আখ্যান

কৃষ্ণানুগামিনী রাধা কখনওই লক্ষ্মী বা বিষ্ণুজায়ার মতো নিত্যা হয়ে উঠতে পারেননি। রুক্মিণী বা সত্যভামার মতো কৃষ্ণজায়ার স্বীকৃতিও পাননি।

শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:২২
অনুষ্ঠানে নৃত্যশিল্পী।

অনুষ্ঠানে নৃত্যশিল্পী।

গত ২৪ অক্টোবর ২০২৫ বিড়লা সভাঘরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ভারতীয় বিদ্যাভবন এবং জি এল মেহতা প্রযোজিত নৃত্যগাথা সিজ়ন ফোর। ওই দিনের প্রথম নৃত্যানুষ্ঠান ছিল ‘কুচিপুড়ি কলামাধুরী’ নিবেদিত কুচিপুড়ি নৃত্য আঙ্গিকের অনুষ্ঠান ‘অনুভব’। নৃত্য পরিচালনা এবং কোরিয়োগ্রাফিতে ড. মাধুরী মজুমদার।

তিনি রাধা। দেবী নন, নন সামান্যা নারী। জায়া বা জননীর ঘরোয়া পারিপাট্য তাঁকে মানায় না। তা হলে তিনি কে? কাব্যে, সাহিত্যে, পুরাণে বহুচর্চিতা একাকিনী এই রমণীকে নিয়ে আলাদা করে কেউ কি কখনও ভেবেছে? অথচ তাঁরই অভিসারের শৃঙ্গার রসে পদাবলি সাহিত্যের মোহিনী বিস্তার। তাঁকে নিয়ে কবিদের কল্পনার অন্ত নেই। তাঁদেরই একজন কবি বিদ্যাপতি, যিনি মৈথিলী ভাষায় পদ রচনা করেছেন শ্রীরাধিকার ভাবসম্মিলন। শ্রীমদ্ভাগবতের রাসলীলা পর্বে গোপিনীরা বলছেন, ‘এই নারীর দ্বারাই আরাধিত হয়েছেন ভগবান শ্রীহরি!’ এই রাসলীলা পর্বে ব্যবহৃত ‘অনয়ারাধিত’ শব্দটি থেকেই ‘রাধা’ শব্দের উৎপত্তি বলে ভাবা হয়।

কৃষ্ণানুগামিনী রাধা কখনওই লক্ষ্মী বা বিষ্ণুজায়ার মতো নিত্যা হয়ে উঠতে পারেননি। রুক্মিণী বা সত্যভামার মতো কৃষ্ণজায়ার স্বীকৃতিও পাননি। অথচ যুগে যুগে প্রেমের দৃষ্টান্ত হয়ে থেকেছে রাধাকৃষ্ণের লীলা। কৃষ্ণের সঙ্গ তিনি যত না পেয়েছেন, তার চেয়ে বেশি সময় তাঁর কেটেছে কৃষ্ণবিহনে। এখানেই রাধাবাদের অনন্যতা। মহাভারতে দেখি, ব্যাধের তির লেগে মৃত্যু হয় কৃষ্ণের, সেই সঙ্গে রাধারও। অর্থাৎ যিনি কৃষ্ণের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাঁরও লয় হয়ে যাচ্ছে। তা হলে প্রশ্ন হল, ‘রাধা’ বলে সত্যিই কি কেউ ছিলেন, না কি ‘রাধাবাদ’ নিছকই কল্পনা, যার জন্ম কবির মনে?

বিদ্যাপতির ভাব সম্মিলনের ছয়টি পদকে কেন্দ্র করে এক অন্য ভাবনার নৃত্য নিবেদন ‘অনুভব’। কুচিপুড়ি নৃত্যশৈলীতে অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে ‘রাধা’র বিভিন্ন রূপকে ফুটিয়ে তুলেছেন তিস্তা পোদ্দার, নবনীতা দেব, সেঁজুতি সেন, মধুমিতা পাত্র, সোমা দেব ও ড. মাধুরী মজুমদার। কথকের ভূমিকায় অদ্রিজা গুহরায়ের অভিনয় এবং মুদ্রার ব্যবহার বেশ ভাল। পাঠে রত্না মিত্র, কণ্ঠসঙ্গীতে বৃন্দা রাধাকৃষ্ণন নৃত্যানুষ্ঠানটিতে এক অন্য মাত্রা এনে দেন। ড. মাধুরী মজুমদারের বলিষ্ঠ কোরিয়োগ্রাফি ও নৃত্যাভিনয় প্রশংসার দাবি রাখে।

দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠান কলকাতা কলামণ্ডলম নিবেদিত ভরতনাট্যম এবং মোহিনীআট্টম আঙ্গিকে ‘পুরুষোত্তম শ্রীরাম’। কোরিয়োগ্রাফি ও নৃত্যভাবনায় কলকাতা কলামণ্ডলমের স্বর্ণদীপা মোহান্ত, ভাষ্যরূপ দেবাংশু দাস, হিন্দিতে পাঠ রাকেশকুমার ত্রিপাঠী। অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনায় সৌমিত কুট্টি। শ্রীরামচন্দ্রের জীবনধারায় দেখা যায়— শ্রীহরির অবতার হলেন শ্রীরামচন্দ্র, যিনি রক্ষাকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং ‘পুরুষোত্তম’ ভাবমূর্তি ধারণ করেছিলেন। ‘পুরুষোত্তম শ্রীরাম’ নৃত্যালেখ্যটিতে কলকাতা কলামণ্ডলমের ছাত্রছাত্রীরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ভরতনাট্যম এবং মোহিনীআট্টম নৃত্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। একে একে রামের জন্ম, বেড়ে ওঠা, ধনুর্ভঙ্গ ও সীতার সঙ্গে বিবাহ, মন্থরার কুটিল প্ররোচনায় রামের বনবাস যাত্রা, শূর্পনখার ছলনাময়ী আগমন ও তার নাসিকা ছেদন, রাবণের সীতাহরণ ও জটায়ু বধ এবং পরিশেষে পবনপুত্র হনুমানের সঙ্গে রামের সাক্ষাৎকার... সবই দেখানো হয়।

রামের ভূমিকায় শতাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের বলিষ্ঠ চলনভঙ্গিমা এবং অভিনয়— বিশেষ করে হরধনু ভঙ্গ যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে। মোহিনীআট্টম নৃত্য প্রয়োগে ইলিনা বসু, অঙ্কিতা দত্ত সুন্দর। ভাল লাগে শবরীরূপী স্বর্ণদীপা, রাবণরূপী সম্প্রীতি, জটায়ুরূপী অঙ্কিতা, শূর্পণখারূপী তৃষা, সূত্রধর বা কথকরূপী চন্দন ও হনুমানরূপী রাহুলের নৃত্যাভিনয়। সমবেত নৃত্য পরিবেশনে তৃষা চক্রবর্তী, তপজা চক্রবর্তী, শ্রীলেখা চট্টোপাধ্যায় যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। তুলসীদাসের বিখ্যাত ‘শ্রীরামচন্দ্র কৃপালু ভজমন হরণ’ ভজনের সঙ্গে সমবেত নৃত্য ছিল নজরকাড়া উপস্থাপনা। সৌমিত কুট্টির সুন্দর ও অভিনব পরিকল্পনা, যেখানে ভরতনাট্যম এবং মোহিনীআট্টমের মেলবন্ধন ঘটেছে— তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। স্বর্ণদীপা মোহান্তের পরিচালনায় কলকাতা কলামণ্ডলমের ছাত্রছাত্রীদের এই সার্থক ও মনোরম উপস্থাপনা যথেষ্ট আনন্দ প্রদান করেছে।

অনুষ্ঠান

বালি রবীন্দ্রভবনে পায়েল ডান্স ট্রুপ উপস্থাপন করল নৃত্যানুষ্ঠান ‘সৃজনী’। নৃত্য নির্দেশনায় ছিলেন মৌসুমী ভাণ্ডারী। অনুষ্ঠানের সূচনা হয় ‘প্রণবালয়া’ গানের মাধ্যমে, যা এক ভক্তিমূলক নৃত্য। এর পর ধারাবাহিক ভাবে পরিবেশিত হয় একাধিক আঙ্গিকভিত্তিক উপস্থাপনা। উল্লেখযোগ্য পর্বগুলির মধ্যে ছিল ‘কানুর প্রীতি’ ও ‘নটখট বাঁশিওয়ালা’ যেখানে ফুটে ওঠে শ্রীকৃষ্ণের চিরন্তন প্রেম ও লীলাখেলা। সন্ধ্যার আরও আকর্ষণ ছিল শ্রদ্ধাঞ্জলি ‘এক ঝলক মাধুরীর’ ও ‘দিল সে এ আর রহমান’, যেখানে কিংবদন্তি শিল্পীদের স্মরণ করা হয়। অন্য দিকে ‘অভিসার’, ভানু সিংহের পদাবলীর উপরে ভিত্তি করে এক নৃত্যরূপায়ণ। অনুষ্ঠানের একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল ‘প্রয়াস’ সংস্থার শিশুশিল্পীদের পরিবেশনা। মৌসুমী ভাণ্ডারীর উদ্যোগে পরিচালিত এই সামাজিক প্রতিষ্ঠানটি অনগ্রসর শিশুদের নিখরচায় নৃত্যশিক্ষা প্রদান করে থাকে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Dance Cultural Program

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy