E-Paper

কাব্য-গানে মুখর এক সন্ধ্যা

‘কোলাহল তো বারণ হল...’ এই গানটি দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করলেন জয়তী। সারা প্রেক্ষাগৃহ সুরে ভরে গেল। ব্রততী শোনালেন রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনদেবতা’ কবিতাটি। অপূর্ব পরিবেশনা।

সৌম্যেন সরকার

শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৫ ০৭:২৭
মঞ্চে মনোময়-ব্রততী-জয়তী।

মঞ্চে মনোময়-ব্রততী-জয়তী। নিজস্ব চিত্র।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম, সামাজিক ও মানসিক অবস্থানেই তাঁরা দু’জনে প্রায় বিপরীত সীমান্তের দুই মানুষ। একজনের অভিজাত পরিবারে জন্ম, যিনি নিজে অর্জন করেছেন শিক্ষা, সংস্কৃতি, সম্মান আর দেশকে দিয়েছেন নতুন সম্মান আর আভিজাত্য। অর্জন করেছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পুরস্কারটি। আর একজন জন্মেছিলেন বর্ধমানের চুরুলিয়া নামে এক অখ্যাত গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে। কিন্তু জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়ে তিনি হয়ে উঠলেন বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও সঙ্গীতকার, বাংলা ভাষার সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সঙ্গীতের রচয়িতা, কবি ও গায়ক। বাংলা সংস্কৃতির এই দুই মহীরুহকে নিয়েই আয়োজিত হয়েছিল একটি অনুষ্ঠান, কলামন্দির প্রেক্ষাগৃহে। নিবেদনে বোরোলিন। ‘হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনায় নজরুল’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানটিতে অংশ নিয়েছিলেন বাংলার তিন জনপ্রিয় শিল্পী— মনোময় ভট্টাচার্য, ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় ও জয়তী চক্রবর্তী। শুরুতেই রবীন্দ্রনাথকে নিবেদন করে ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েক পঙ্‌ক্তি শোনালেন, যা হৃদয় স্পর্শ করে। এই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান ভাগাভাগি করে শোনান জয়তী চক্রবর্তী ও মনোময় ভট্টাচার্য। তারই মাঝে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়।

‘কোলাহল তো বারণ হল...’ এই গানটি দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করলেন জয়তী। সারা প্রেক্ষাগৃহ সুরে ভরে গেল। ব্রততী শোনালেন রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনদেবতা’ কবিতাটি। অপূর্ব পরিবেশনা। মনোময় শোনালেন কাজী নজরুল সৃষ্ট শ্যামকল্যাণ রাগে আধারিত গান ‘সেদিন ছিল গোধূলি লগন শুভদৃষ্টি ক্ষণ’। গানটির মধ্যে চমৎকার একটি ব্যঞ্জনা ফুটে উঠল। জয়তী গাইলেন রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্যায়ের গান ‘তুমি কোন কাননের ফুল’। চমৎকার পরিবেশনা। ব্রততী শোনালেন ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা, যেটি উৎসর্গিত হয়েছিল বিজয়ার করকমলে, ‘দুয়ারে-বাহিরে যেমনি চাহি রে/ মনে হল যেন চিনি/ কবে নিরুপমা, ওগো প্রিয়তমা, ছিলে লীলাসঙ্গিনী?’। মনোময় পরিবেশন করলেন নজরুল রচিত একটি কীর্তনাঙ্গের গান ‘মম মানস মাধবীলতার কুঞ্জে এই তো প্রথম মধুপ গুঞ্জে’। এর পরে জয়তীও রবীন্দ্রনাথের একটি কীর্তনাঙ্গের গান গাইলেন, যেটি রচিত হয়েছিল ১৮৮৫ সালে— ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’। দু’টি গানই সুখশ্রাব্য। এর পরে মনোময়ের কণ্ঠে ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি’ একটি অনবদ্য পরিবেশনা। ফুলের জলসায় চিরবিদ্রোহী কবি নীরব হয়ে গিয়েছিলেন ১৯৪২ সালে। কবির ২২ বছর বয়সের রচনা ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনালেন ব্রততী। শ্রোতারা আবিষ্ট হয়ে শুনলেন। এই কবিতার অনুষঙ্গে আবহসঙ্গীতের ব্যবহার প্রশংসনীয়। জয়তী শোনালেন আরও কয়েকটি গান— ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে’, ‘নীল অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায়’, ‘রাত্রি এসে যেথায় মেশে’, ‘ও যে মানে না মানা’। সব ক’টি গানই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে গেয়েছেন শিল্পী। তবু তার মধ্যে ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে’ গানটি মর্মে আঘাত করে। অসাধারণ পরিবেশনা।

মনোময়ের অন্যান্য গানের মধ্যে ছিল নজরুলের একটি গজ়ল ‘সহসা কি গোল বাঁধালো পাপিয়া আর পিকে’, একটি অপ্রচলিত গান ‘সতীহারা উদাসী ভৈরব কাঁদে’, ‘আমার গহীন জলের নদী’। সব ক’টি গানই মনকে আকৃষ্ট করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘আমার গহীন জলের নদী’। ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবৃত্তি সম্পর্কে কোনও কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অনবদ্য তাঁর শব্দ প্রক্ষেপণ ও ভঙ্গি। তিনি শোনালেন নজরুলের কবিতা ‘তোমার কণ্ঠে রাখিয়া এসেছি মোর কণ্ঠের গান’, ১৯১৫ সালে রচিত রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘ঝড়ের খেয়া’, ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের ‘কৃতজ্ঞ’ নামক কবিতার অংশ থেকে আর একটি কবিতা ‘বলেছিনু ভুলিব না, যবে তব ছলছল আঁখি’ এবং অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে নজরুলের লেখা ‘রবিহারা’ কবিতার অংশ, যেটি রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পরে আকাশবাণী থেকে নজরুল পড়েছিলেন। এই কবিতার সঙ্গে আবহসঙ্গীত একটি বিশেষ মাত্রা যোগ করেছিল। অনুষ্ঠানের অন্তিম পর্বে মনোময় পরিবেশন করলেন একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘ক্ষত যত ক্ষতি যত মিছে হতে মিছে’। ব্রততী শোনালেন ‘থাকব না ভাই, থাকবে না কেউ, থাকবে না কিছু’। অনুষ্ঠান শেষ হল মনোময় ও জয়তীর দ্বৈতকণ্ঠে ‘যখন ভাঙল মিলনমেলা’ গানটি দিয়ে। এই অনুষ্ঠানের যন্ত্রশিল্পীদের সাধুবাদ অবশ্যপ্রাপ্য। মঞ্চসজ্জাও অনুষ্ঠানটিকে বিশেষ রূপ দিতে সাহায্য করেছিল।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Kalamandir Rabindranath Tagore Kazi Nazrul Islam

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy