Advertisement
E-Paper

প্রণব-বাড়ির দুর্গাপূজা

রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কীর্ণাহারের মিরিটির বাড়ির দুর্গাপূজা। সেই বাড়িতে দুর্গাষ্টমী কাটিয়ে এলেন সঙ্গীতা ঘোষ অনা, তোমার জন্য ফুল এনেছি। কত্তো ফুল।’’ ছোট্ট পল্টুর ডাকে দুর্গামণ্ডপ ছে়ড়ে দৌড়ে বেরিয়ে এল কিশোরী অনা। সাজিতে করবী, টগর, জবা, বেলফুল... ।

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০

অনা, তোমার জন্য ফুল এনেছি। কত্তো ফুল।’’ ছোট্ট পল্টুর ডাকে দুর্গামণ্ডপ ছে়ড়ে দৌড়ে বেরিয়ে এল কিশোরী অনা। সাজিতে করবী, টগর, জবা, বেলফুল... ।

সে তো কোন যুগের কথা।

তবে সে দিনও ছিল দুর্গাপুজোর এমনই এক দিন। ভাই বাগান থেকে তোলা ফুল ‘গিফ্ট’ দিয়েছিল দিদিকে, পুজোয়।

সময়ের সরণি পেরিয়ে সেই পল্টু এখন দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রণব মুখোপাধ্যায়। অনা, তাঁরই সাড়ে ছ’বছরের বড় দিদি, অন্নপূর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়।

আলপথ দিয়ে ছুটে চলা, পুজোর সময় বাগান থেকে দিদির জন্য ফুল তুলে আনা— সবই আজ ফ্ল্যাশব্যাক।

সম্বিৎ ফিরল হুটারের শব্দে। অন্নপূর্ণা যেন বহু যুগের ওপার থেকে এক লহমায় এসে পড়লেন বাস্তবের মাটিতে। ‘‘ওই যে পল্টু কীর্ণাহার থেকে বিশ্রাম সেরে চলে এসেছে। চলো চলো, দুর্গামণ্ডপে যাই... সন্ধিপূজা শুরু হবে।’’

দুর্গাষ্টমী। মিরাটি (আদরের নাম মিরিটি), কীর্ণাহার।

মুখোপাধ্যায় পরিবারের ১১৯ বছরের পুজো।

‘‘পুজোয় এক-এক দিনে দেড় হাজার পাতও পড়ে। ষষ্ঠীর রাত থেকে শুরু হয় খাওয়াদাওয়া। বাড়ির লোক, গ্রামের লোক, বাচ্চারা, পুলিশের লোক, রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে যাঁরা আসেন... ভাত-ডাল-তরকারি-মুড়ি-নাড়ু-লুচি,’’ জানালেন যাদব ঘোষ, যিনি সর্বার্থেই মুখোপাধ্যায় বাড়ির ‘কেয়ারটেকার’।

‘‘পুজোর পুরো ব্যাপারটাই ও ম্যানেজ করে’’, হাসতে হাসতে জানালেন কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়, প্রণববাবুর বোন, কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া কন্যা। পুজোয় যাঁরা কাজ করতে আসেন তাঁদের প্রত্যেকের জন্য হলুদ রঙের ‘আইডেনটিটি কার্ড’, যেখানে ছাপার অক্ষরে লেখা ‘মুখার্জি বাড়ির পুজো’!

শতাব্দী পার করে আসা দুর্গাপুজোর ঐতিহ্য অমলিন রাখতে এতটুকুও কসুর করেননি মিরিটির মুখুজ্জেরা।

পুজোর চার দিন সকাল থেকেই সাধারণ মানুষের ঢল এই বাড়ির প্রাঙ্গণে। পুষ্পাঞ্জলি থেকে প্রসাদ... তার পর পাত পেড়ে মধ্যাহ্ন ভোজন। সপ্তমী-অষ্টমী নিরামিষ, নবমী-দশমী ভাত-ডাল-তরকারির সঙ্গে মাছ।

একাদশীতেও লোক আসেন, মুড়ি-নারকেল নাড়ু দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। ‘‘আমাদের বাড়িতে চার রকমের নাড়ু হয়। সিরির, খইয়ের, নারকেলের দু’রকমের— গুড় ও চিনির,’’ জানালেন রাষ্ট্রপতির ভাগ্নেবৌ, মাধবী বন্দ্যোপাধ্যায়। এ তো একেবারে সাবেকি রীতিনীতি মেনে চিরপরিচিত ঘরোয়া মেনু!

আজও এই বাড়ির পুজোর যাবতীয় কাজ ও প্রসাদ বিতরণের দায়িত্ব বাড়ির মেয়ে-বৌদের উপরেই। রাশি-রাশি ফল, মিষ্টি ও ভোগপ্রসাদ থালায় সাজিয়ে মহিলারা দ্রুত বিলি করছেন ভিআইপি-সহ গ্রামের মানুষজনের মধ্যে।

ছেলেবেলা থেকে পুজোর এমনই ধারা দেখে এসেছেন এই পরিবারের সদস্যরা। ‘‘এই যে তখন গ্রাম্য মানুষেরাই বেশি আসতেন। এখন পল্টুর দৌলতে নামীদামি মানুষের আগমন’’, অনাবিল স্বীকারোক্তি অন্নপূর্ণাদেবীর।

আর পুজো সংক্রান্ত পুরো ব্যাপারটার ব্যবস্থাপনায় রয়েছেন প্রণব-পুত্র সাংসদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। অতিথিদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা থেকে চণ্ডীপাঠের সময় বাবার পাশে দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বালিয়ে জোরালো আলো দিয়ে তাঁর পাঠে সুবিধা করে দেওয়া... সবেতেই তিনি।

ঘরের ছেলে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে কেটে গিয়েছে চারটে পুজো। প্রতিবারই দিল্লি থেকে লোকলস্কর-পাত্রমিত্র পরিবৃত হয়ে এসেছেন তিনি। এবং পট্টবস্ত্র পরিহিত হয়ে পুজোয় স্তবপাঠ, চণ্ডীপাঠ থেকে মহাষ্টমীর দিন তন্ত্রধারকের ভূমিকা পালন, স্থানীয় মানুষের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ, কথোপকথন— কোথাও এতটুকু ফাঁক না-রেখে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে গিয়েছেন।

প্রণববাবুদের পুরনো মাটির বাড়ি।ছবি: প্রতিবেদক

এখানকার অতিথিদের সিংহভাগের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয়। তবুও আজও তাঁকে ঘিরে উৎসাহের অন্ত নেই। তাক লেগে যায় ‘ভিজিটর্স প্রোফাইল’ দেখে! প্রোটোকলের ঘেরাটোপ ও তীক্ষ্ণ নজরদারির দরুন ক্যামেরাবন্দি করা সম্ভব হয়নি সেই সব আবেগমথিত জনতার ছবি... সারাদিন ধরে একাধিক দীর্ঘ লাইন একই সঙ্গে এগিয়ে চলছে... লাঠি হাতে খঞ্জ থেকে নুয়ে পড়া বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ-তরুণ-তরুণী, এমনকী বালক-বালিকাও... মুখুজ্জে বাড়ির প্রাঙ্গণে জনবিস্ফোরণ, ধাক্কাধাক্কি... সবাই এক বার দেখবে, প্রণাম করবে, কথা বলবে, ঘরের ছেলের সঙ্গে। সেই মানুষটির সঙ্গে, যিনি তাঁদের কাছে এই মুহূর্তে জীবন্ত রূপকথা। রাইসিনা হিলসের বাসিন্দা হয়ে যিনি মিরিটি গ্রামকে তুলে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক মানচিত্রে।

ভারতের এক নম্বর নাগরিক, পুজোর এই চারটে দিন, তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটায়, শৈশবের-বাল্যের-কৈশোরের চারণভূমিতে হয়ে যেতে চান সেই আগেকার ‘পল্টু’।

প্রোটোকল না-মেনেই তিনি চলে যান নবপত্রিকা স্নানের আগে বাড়ির অদূরে কাঁদরের ঘাটে ঘট ভরতে। ফার্স্ট লেডি শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পর এটি দ্বিতীয় পুজো। স্ত্রীর হয়ে অতিথি আপ্যায়নের দায়িত্বও এখন তিনিই নিয়েছেন। আন্তরিকতার সঙ্গে অনাবিল ভাবে বলেন, ‘‘নবমীর পুজোয় এসো কিন্তু। রাতে খেয়ে যাবে অবশ্যই।’’

সম্প্রতি দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে এক আলাপচারিতায় রাষ্ট্রপতির সামনে প্রশ্ন রেখেছিলাম— কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ পোর্টফোলিও, রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় বক্তৃতা, নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রে সভা, মিরিটির দুর্গাপুজোয় চণ্ডীপাঠ... কোন মন্ত্রবলে তিনি দিনের পর দিন এত বিবিধ দায়িত্ব অনায়াসে সামলেছেন?

হাসিমুখে তিনি জানান, এর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে মিরিটির মাটিতে— তাঁর শিকড়ে। আলপথ ধরে ছ’কিলোমিটার হেঁটে স্কুল যাওয়া ও ছ’কিলোমিটার হেঁটে স্কুল থেকে ফেরা। বর্ষায় গামছা পরে, স্কুলের ইউনিফর্ম ও বই গলায় বেঁধে! ‘‘পথের প্রতিটি গাছকে চিনতাম, নাম জানতাম। প্রতিটি বাড়িই যেন আমার নিজের। সেখানকার জেঠিমা-কাকিমা-মাসিমারা কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘কী রে পল্টু খিদে পেয়েছে...?’ কী করে যে বুঝতেন! মিরিটিতে পুজোয় কতশত মানুষ আসেন।’’

অষ্টমীর রাতে মিরিটির পথ ধরে চলতে চলতে মনে হল, এই গণদেবতাই ‘পল্টু’র প্রেরণা, কর্মশক্তির উৎস।

Pranab Mukherjee Durga puja
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy