E-Paper

সম্পর্কের স্বীকৃতি নিয়ে এক ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টা

শিল্পী দেবাশিস পালের কাজও এই আবহের উপযোগী শিল্পকর্ম। হাজার বছরের স্বপ্নে বহুবর্ষজীবী একটি মরুভূমি, সময়ের বিভ্রান্তে স্পর্শ করে এনভারের তীর।

পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৫:৪১

সম্প্রতি দু’মাস ধরে ইমামি আর্ট গ্যালারিতে সম্পূর্ণ নতুন এক ভাবনার উপস্থাপনা করলেন শিল্পী দেবাশিস পাল, নাম ‘আ থাউজ়্যান্ড ইয়ার্স অব ড্রিমিং’। ইদানীং কিছু গ্যালারিতে দেখা যায় শুধুমাত্র ভিসুয়াল আর্টসের উপরে আলো ফেলে বাকি অংশকে প্রায়ান্ধকার করে রাখা। অবশ্যই তার যৌক্তিকতা গড়ে ওঠে মূল শিল্পের চাওয়া কিংবা না চাওয়ার উপরে। ফলে দর্শক, শিল্প ও ওপেন স্পেসের মিশেলে নাটকীয়, চলচ্চিত্র-গৃহের অনুভূতির সৃষ্টি হয়। এবং সেই শিল্প সহজেই অনুভবী দর্শকের মনোযোগ কেড়ে নেয়।

এ ক্ষেত্রে শিল্পী দেবাশিস পালের কাজও এই আবহের উপযোগী শিল্পকর্ম। হাজার বছরের স্বপ্নে বহুবর্ষজীবী একটি মরুভূমি, সময়ের বিভ্রান্তে স্পর্শ করে এনভারের তীর। এখানে পাপীরা পাপ ধুয়ে ফেলে আত্মার মুক্তির জন্য জলপান করে। এই ঐশ্বরিক খোঁজে শিল্পী বেছে নেন মরুভূমির মতো এক টুকরো জমি। যেখানে ফুল ফোটে না। ব্যক্তি হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে স্থাপন করেছেন একটি চ্যালেঞ্জিং প্রোডাকশন। কোনও কিছুর পরোয়া না করে দেবাশিস ‘ভালদারোর, হাসানলু' প্রেমিকদের মতো প্রিয় মানুষদের আলিঙ্গন করেন। নির্বাচিত পরিজনকে আনন্দ দেওয়ার জন্য সচেতন ভাবেই তুলে ধরেন লুকিয়ে রাখা সরলতার দৃষ্টি।

বিরল এই প্রদর্শনীতে দু’টি ঘর মিলিয়ে ছিল অভাবনীয় ইনস্টলেশনের বিস্তার। সঙ্গে গঙ্গা তীরবর্তী বারাণসীতে গড়ে তোলা বিশেষ চলচ্চিত্র ‘আ থাউজ়্যান্ড ইয়ার্স অব ড্রিমিং’-এর সিকোয়েন্স। আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব আচার-অনুষ্ঠানে দু’টি পুরুষের মধ্যে বিবাহের অনুরূপ ঘোষণা। এবং নিবিড় সম্পর্কের আভাসে বিরতি ঘটে শিল্পীর আকাঙ্ক্ষা, হতাশামূলক সংগ্রামের দৃশ্যগুলির সঙ্গে। আবার বিয়ের ব্যান্ড এবং একটি সাদা ঘোড়ার সঙ্গে জুড়ে থাকে ফুলাভরণে অন্তরঙ্গ শিল্পী ও তাঁর প্রেমিকার নিরাবরণ শরীর।

দ্বিতীয় সেগমেন্টে যৌন পরিচয় গোপন করা এবং ক্রমাগত অঙ্গবিন্যাস হেতু সমস্ত জায়গায় উদ্বেগজনিত ব্যাধির প্রক্রিয়ায় যেন হাঁপাতে থাকেন শিল্পী দেবাশিস। শিরোনামের চারপাশে বুননকৌশল, অভিনয়ের স্থিরচিত্র, অঙ্কন এবং ভাস্কর্য অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যথাযথ ট্রিটমেন্টে যুক্ত হয় পুজোর নৈবেদ্য, ধর্মীয় আচার। অরক্ষিত শরীরে সজ্জার উপকরণগুলি জীবাশ্মের মতো লাগে। মুখোশের খেলার দ্বৈত যাপনে মানিয়ে নেওয়া মুশকিল, তবুও বেঁচে থাকার কোনও সংস্করণের আশায় বাঁচেন শিল্পী।

ইন্ডিয়ান কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ড্রাফ্টসম্যানশিপ থেকে ভাস্কর্য নিয়ে পাশ করার পরে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স সম্পূর্ণ করেন শিল্পী। মাল্টিডিসিপ্লিনারি আর্টিস্ট হিসেবে দেবাশিস পাল, বিষমকামী নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সমাজের লিঙ্গ পরিচয়ের সমস্যাগুলি খুঁজতে থাকেন। দুই পুরুষের অন্তরঙ্গ, অস্বীকৃত আকাঙ্ক্ষাগুলিকে প্রায় বিদ্রোহের মতো উত্তর ভারতীয় হিন্দু বিবাহের সামগ্রী দিয়ে সাজিয়ে তোলেন।

প্রতিষ্ঠার প্রতিনিধিত্বে ‘শেলস অব পাস্ট লাইফ’, ‘দ্য স্কিন অব ড্রিম’ ইত্যাদির ভাস্কর্য নির্মিত ইনস্টলেশনগুলিতে, বিবাহসজ্জার গভীর কামনা পরতে পরতে সেজে উঠেছে বিভিন্ন উপাদানের সংগ্রহে— যেমন কড়ি, ল্যাটেক্স, তুলো, সুতো, পুঁতি, ক্রিস্টাল, প্লাস্টিকের হেলমেট ইত্যাদি। চাক্ষুষ প্রতিক্রিয়ায় প্রদর্শনীর এই অভিনব রূপায়ণ মন্ত্রমুগ্ধ করে তোলে।

মারিও ডিসুজ়ার কিউরেট করা এই প্রদর্শনীর শেষ দিন ‘কুইয়ার আর্ট অব ড্রিমিং’ শিরোনামে শিল্পী এবং অধ্যাপক নীলাদ্রি আর চট্টোপাধ্যায়ের দ্বৈত প্রশ্নোত্তর পর্ব ছিল। সেখানে উঠে এসেছিল জীবনে শৈল্পিক প্রভাব ও বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে শিল্পীর নিজস্ব যুক্তি এবং গ্রহণযোগ্যতার নিশ্চিতকরণ চাওয়া। সব মিলিয়ে মনে রাখার মতো একটি পরিকল্পনা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Emami Art Gallery

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy