Advertisement
E-Paper

দ্বিতীয় ইনিংসে নাজেহাল

শেষ জীবনে নাতি-নাতনির দায় সামলাতে জেরবার ওঁরা। খোঁজ নিলেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়মঞ্জুলিকার এখন মাঝেমধ্যেই আর ধৈর্য থাকে না। এই আটষট্টিতে যখন ছ’ বছরের দুরন্ত বাচ্চার পিছনে ছুটতে হয় তখন বিরক্ত লাগে। দুর্ব্যবহার করে ফেলেন। তারপরই অসম্ভব গ্লানিবোধ হয়। মনে হয়, নিজের নাতি, তাকে নিয়ে এত অসহ্যপনা করে ফেলছেন! নালিশ করছেন! স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছেন? নাকি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সহ্যক্ষমতা কমে যাচ্ছে বলে এমন হচ্ছে?

শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৩

মঞ্জুলিকার এখন মাঝেমধ্যেই আর ধৈর্য থাকে না।

এই আটষট্টিতে যখন ছ’ বছরের দুরন্ত বাচ্চার পিছনে ছুটতে হয় তখন বিরক্ত লাগে। দুর্ব্যবহার করে ফেলেন। তারপরই অসম্ভব গ্লানিবোধ হয়। মনে হয়, নিজের নাতি, তাকে নিয়ে এত অসহ্যপনা করে ফেলছেন! নালিশ করছেন! স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছেন? নাকি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সহ্যক্ষমতা কমে যাচ্ছে বলে এমন হচ্ছে?

খুব আফশোস হয় শুচিস্মিতার। নিজের মেয়ের ভিতর একটু-একটু করে নিজের জীবনবোধ, আদর্শ, নিজের পছন্দের আদবকায়দা, রুচিবোধ গেঁথে বড় করে তোলার ইচ্ছে ছিল।

কিন্তু চাকরির জন্য দিনের অনেকটা তাকে রাখতে হচ্ছে শ্বশুর-শাশুড়ির ভরসায়। তাতে হয়তো নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে, কিন্তু বাচ্চাকে নিজের মতো গড়ে তোলা যাচ্ছে না।

এখন যখন দেখেন পাঁচ বছরের মেয়ে শ্বশুরের কায়দায় শব্দ করে মুখ ধুচ্ছে কিংবা শাশুড়ি যে ক’টি শব্দের উচ্চারণ ভুল করেন সেই শব্দগুলো ওই ভুল উচ্চারণেই বলতে শিখছে তখন কেমন অসহায় লাগে ওর।

যখন জানতে পারেন সারাদিনে কেউ মেয়েকে একটু গল্পের বই পড়ে শোনায়নি বা গান শোনায়নি, বরং ঝামেলা এড়াতে টিভিতে কার্টুন চালিয়ে বসিয়ে রেখেছে তখন নিজেকে দোষী মনে হয় শুচিস্মিতা। অথচ কাউকে কিছু বলতে পারেন না।

চাকরিটা ছেড়ে দেবে কিনা ভাবছেন দেবপ্রিয়া। চার বছরের অনীককে ছেড়ে আসতে হয় শ্বশুর-শাশুড়ির উপর।

ক্রমশ বুঝতে পারছে, এই সুবিধাটুকু তাঁদের কাছ থেকে নিতে হচ্ছে বলে অনীকের উপর অধিকারটাই যেন হারিয়ে ফেলছেন।

অনীক কী খাবার খাবে, কখন খাবে, কখন খেলতে যাবে, সাঁতার শিখবে কিনা, কোন টিচারের কাছে টিউশন নেবে, সমস্ত ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছেন তার দাদু-দিদা।

দেবপ্রিয়া কিছু বলতে গেলে গ্রাহ্যই করছেন না। স্বামী বুধাদিত্যকে বলতে গেলে সে উল্টে বলছে, ‘‘ঝামেলা পাকিয়ো না। ওরাই তো দেখে। বেশি বললে যদি অভিমানে সব দায়িত্ব ছেড়ে দেন তা হলে আমরাই মুশকিলে পড়ব।’’

শ্যামবাজারের দেবদুলাল আর অনামিকা এই বুড়ো বয়সে না পারছেন দায়িত্ব ধরতে, না পারছেন ছাড়তে।

নাতি-নাতনি মামাবাড়ি বেড়াতে এল, তাদের নিয়ে আহ্লাদ করলেন, হইহুল্লোড় করলেন, সেটা আলাদা আনন্দ। কিন্তু প্রত্যেক দিন তাদের দেখাশোনা, খাওয়াদাওয়া, স্কুল-পড়াশোনা-অসুখবিসুখের দায়িত্ব নিতে গেলে যে আর আনন্দ থাকে না, বোঝা হয়ে ওঠে।

অথচ একমাত্র মেয়ের ছেলে। মেয়ে-জামাই চাকরি করেন। মেয়েকে না-ও করতে পারছেন না। দেবদুলাল আর অনামিকা বাইরে কোথাও বেড়াতে যাবেন, বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়দের বাড়ি কয়েক দিন কাটিয়ে আসবেন বা বাড়িতেই নিজেদের সময়মতো ঘুমোবেন, টিভি দেখবেন, গল্পের বই পড়বেন—সব মাথায় উঠেছে।

শুধু নাতির পিছনে দৌড়তে হচ্ছে। সারাজীবন সংসারের জোয়াল ঠেলে জীবনের এই শেষের দিকে একটু ঝাড়াঝাপ্টা থাকতে চেয়েছিলেন। সেই সময় আবার নতুন করে একটা বাচ্চা মানুষের দায়িত্ব বড্ড চাপের হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এঁদের মধ্যে একাংশ ব্যাপারটা উপভোগ করছেন। বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে নিজেদের অকেজো-নিঃসঙ্গ লাগতে শুরু করেছিল, সেখান থেকে নাতি বা নাতনিকে আশ্রয় করে জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পাচ্ছেন, পুরনো দিনগুলো যেন ফিরে এসেছে। আবার অন্য একটা অংশের কাছে এ এক মহা বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাপের ছুঁচো গেলার দশা। না পারছেন গিলতে, না পারছেন ওগড়াতে।

তার ফলে হাজারো দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই ভুল বোঝাবুঝি, মন কষাকষি, ইগোর লড়াই শুরু হচ্ছে। পারস্পরিক সম্পর্কে তিক্ততা বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে তার নেতিবাচক প্রভাব গিয়ে পড়ছে খুদে সদস্যটির উপর।

এক দিকে সে বাবা-মাকে পুরোপুরি পাচ্ছে না, তার অভাববোধ তৈরি হচ্ছে, অন্য দিকে নিজেদের ইগোর লড়াইয়ে বাবা-মা বা দাদু-দিদা নিজেদের রাগ নিজেদের অজান্তেই হয়তো ঝেড়ে ফেলছেন নাতি বা নাতনিটির উপর।

মনস্তাত্ত্বিক হিরণ্ময় সাহা জানাচ্ছিলেন, ইদানীং এমন অনেক ঘটনা দেখতে পাচ্ছেন যার শিকড় গাঁথা রয়েছে বাড়ির বয়স্কদের কাছে বাচ্চার মানুষ হওয়ার ভিতরে। দাদু-দিদা এবং বাবা-মা যে সম্পূর্ণ দু’টো আলাদা আইডেনটিটি বাচ্চারা সে সম্পর্কে অনেক বেশি ওয়াকিবহাল। মা-বাবা ও দাদু-দিদার মধ্যে দায়িত্ববদলটা সবচেয়ে বেশি ধাক্কা দেয় বাচ্চাকে এবং অনেকেই সেটা মেনে নিতে পারে না। তাদের মনে হয়, বাবা-মা তাকে অবহেলা করে দাদু-দিদার কাছে ফেলে রেখেছে। তার থেকে কেউ অবসাদে ডুবে যায়, অন্যদের সঙ্গে মিশতে পারে না, একা-একা থাকতে ভালবাসে আবার অনেকের মধ্যে একটা আগ্রাসন তৈরি হয়। তারা মারধর করে, অভব্য ব্যবহার করে।

হিরণ্ময়বাবু সম্প্রতি একটি কেস পেয়েছিলেন। বছর তেইশের একটি ছেলে। অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও মেধাবী। সে এক-একটি বিখ্যাত জায়গায় পড়ার সুযোগ পাচ্ছে কিন্তু পড়তে যাচ্ছে না, ছেড়ে দিচ্ছে।

তার কাউন্সেলিং করে জানা গেল সে দাদু-দিদার কাছে মানুষ হয়েছে। মা-বাবা দু’জনেই চাকরি করতেন। এতে তার মনের ভিতর একটা ক্ষোভ-অভিমান তৈরি হয় মা-বাবার উপর। এখন একের পর এক সুযোগ ছেড়ে দিয়ে সে বাবা-মাকে পরোক্ষে কষ্ট দিতে চাইছেন, ছোটবেলায় নিজে যে কষ্ট পেয়েছিল তার প্রতিশোধ নিতে চাইছে।

মনোবিদ মোনালিসা ঘোষও বলছিলেন, পরিবর্তিত সামাজিক কাঠামোয় আর্থিক প্রয়োজনে আত্মীয়তার ডায়নামিক্স বদলে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে স্ট্রেস আর বিভ্রান্তি। আগে দাদু-দিদারা নাতি-নাতনিদের সঙ্গে শুধু কোয়ালিটি টাইম কাটাতেন। একটু বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, গল্প শোনানো, রান্না করে খাওয়ানো ইত্যাদি। তার মধ্যে কোনও দায়দায়িত্ব, বাধ্যবাধকতা ছিল না। বরং একটা মানসিক শান্তি বা আনন্দের জায়গা ছিল। কিন্তু যখনই নাতি-নাতনিদের পুরো দায়িত্বটা তাঁদের ঘাড়ে চলে আসছে তখন রিল্যাক্সেশন থাকছে না, বিষয়টা অনেকের কাছেই যন্ত্রণার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এঁদের মধ্যে বেশিরভাগই তখন নাতি-নাতনি সম্পর্কে অত্যন্ত বেশি নালিশ করতে শুরু করছেন।

আসলে তাঁরা যে সময় বাচ্চা মানুষ করেছেন তখনকার পরিস্থিতি, পড়াশোনা, ভ্যালুসিস্টেম, বাচ্চাদের অবসরযাপন, সব অন্যরকম ছিল। দু’টোর মধ্যে যখন কিছুতেই মেলাতে পারেন না তখন বয়স্করা আরও অসহায় হয়ে যান। তার উপর বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে শারীরিক ক্ষমতা, ধৈর্য কমতে থাকে। ফলে বাচ্চাদের তালে তাল দেওয়াও দুরূহ হয়ে ওঠে। অনেকে আবার নাতি-নাতনির প্রতি প্রয়োজনে কড়া হতে পারেন না। এতে বাচ্চারা হাতের বাইরে যেতে থাকে এবং তাতে দাদু-দিদার নালিশ আরও বাড়ে। মা-বাবা অফিসে থাকাকালীন ফোন করে অনেকে বাড়ির ছোটটির দুষ্কর্মের খতিয়ান দিতে বসেন। আবার কেউ মা-বাবা অফিস থেকে বাড়ি ফেরা-মাত্র নালিশের ঝাঁপি খুলে বসেন।

রাজারহাটের বাসিন্দা দিবাকর চৌধুরী নিজের অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছিলেন। স্ত্রী মারা যান যখন তখন তাঁদের এক ছেলের বয়স সাত আর এক জনের দুই। বাধ্য হয়ে তাদের দায়িত্ব দিতে হয় দিবাকরবাবুর বৃদ্ধ বাবা-মায়ের উপর। তার পরেই শুরু হয় নালিশের বন্যা। রোজ এই নালিশের ধাক্কায় দিশেহারা হয়ে শেষপর্যন্ত দিবাকরবাবু সিদ্ধান্ত নেন, আলাদা ফ্ল্যাট কিনে আয়ার হাতেই বাচ্চাদের মানুষ করবেন। তাই করেছেন। অন্তত তাতে মা-বাবার সঙ্গে সুসম্পর্কটা রক্ষা করা গিয়েছে। একটু বড় হওয়ার পর ছেলেদের ভাল রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের হস্টেলে দিয়ে দিয়েছেন।

সমাজতাত্ত্বিক রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায় বলছিলেন, বাচ্চা দেখার তাগিদে নিউক্লিয়ার পরিবার আবার যৌথ পরিবারে বদলে যাচ্ছে। লোকে বাবা-মাকে নিয়ে থাকতে চাইছেন। যাঁরা সেটা পারছেন না তাঁরা উল্টে আফশোস করছেন, এমনকী বাচ্চার পরিকল্পনা করতে ইতস্তত করছেন।

কিন্তু এর উল্টো যুক্তিও রয়েছে। মনের টানে নয়, নিছক প্রয়োজনের তাগিদে যে পরিবার একত্রিত হচ্ছে সেই পরিবার কতটা ভালবাসার বা সুস্থ বোঝাপড়ার সুতোয় গাঁথা থাকবে?

বেলগাছিয়ার অমিত করমহাপাত্র যেমন বলছিলেন, বিয়ের দু’বছর পরে বউকে নিয়ে আলাদা হয়েছিলেন কারণ কিছু বিষয়ে বউয়ের সঙ্গে বাবা-মায়ের বনছিল না। তার পর যখন ঋদ্ধি জন্মালো তখন সমস্যায় পড়লেন।

স্ত্রী অরিতার বাবা-মা পটনায় থাকেন। তা হলে বাচ্চাকে কোথায় রেখে দু’জনে অফিস যাবেন?

শুধু আয়ার উপর ওইটুকু শিশুকে রাখতে ভরসা পাচ্ছিলেন না। ফলে সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজেদের অসুবিধাকে গুরুত্ব না দিয়ে মেয়ের প্রয়োজনে আবার বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে থাকবেন।

অমিতের বাবা-মা তখন আপত্তি করেননি। কিন্তু পরে যত সময় এগিয়েছে তত পারিবারিক কোনও বিষয়ে মনোমালিন্য হলেই তাঁরা ঋদ্ধিকে দেখাশোনার প্রসঙ্গ তুলে অমিত ও অরিতাকে খোঁচা দিয়েছেন।

এমনকী ছুটির দিন অরিতা সারা দিন ঋদ্ধিকে নিয়ে কী কী করবেন, কোথায় যাবেন সেখানেও অমিতের বাবা-মা নিজেদের মতামত দিয়ে ফেলতেন।

শেষ পর্যন্ত অমিত আর অরিতা আবার আলাদা থাকাই শ্রেয় বলে বেছেছিলেন। ঋদ্ধিকে এখনও ২৪ ঘণ্টার আয়ার উপরেই রেখে যান। আয়া অন্তত তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন না বা মেয়েকে রেখে যাওয়ার জন্য ব্যাঁকা কথা শোনান না।

রিমার স্বামী কাজের সূত্রে জামশেদপুরে বদলি হলেন। রিমা নিজেও চাকরি করেন। ছেলে তমালকে নিয়ে পড়লেন সমস্যায়। ঠিক হল সকালে রিমা তমালকে স্কুলে পৌঁছে দেবে। তার পর স্কুলবাস নামিয়ে দেবে মামাব়ড়ি, রিমার বাবা-মায়ের কাছে।

ফেরার পথে রিমা ছেলেকে বাড়ি নিয়ে আসবেন। সামনাসামনি বাবা-মা এই ব্যবস্থা নিয়ে কোনও আপত্তি বা মন্তব্য করেননি। কিন্তু বাড়ির অন্য এক সদস্যের থেকে রিমা একদিন জানতে পারলেন, তাঁর বাবা তাঁর অনুপস্থিতিতে প্রায়ই তমালকে দেখা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

এমন কথাও বলেন যে, ‘‘আমরা কী বুড়োবয়সে নাতি-নাতনির আয়ার কাজ করার জন্য রয়েছি? যদি বাচ্চা রাখতে না পারে তা হলে বাচ্চার কথা ভাবা কেন?’’ এর পর তমালকে ক্রেশ-এ রাখতে শুরু করেছিলেন রিমা।

তবে দাদু-দিদার এই ভূমিকা বদল যেমন অনেক জটিলতা তৈরি করে থাকে তেমন কিছুটা সুবিধাও আনে। অন্তত বাড়ির ছোটদের সঙ্গে বয়স্কদের পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠা, সান্নিধ্য পাওয়াটাও তো অনেকটাই।

পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তা থেকেই একসঙ্গে থাকতে থাকতে পরিবারের ভিত কখন যেন নতুন করে পোক্ত হয়ে ওঠে। বাদবাকি অস্বস্তি একটু সহানুভূতি আর বোঝাপড়ায় মিটিয়ে ফেলতে পারলে...!

এই পেরে ওঠার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সমাধানের অঙ্কুর।

অলংকরণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

granny grandchild second grandchild grandmother child fostering nurturing
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy