Advertisement
E-Paper

শোনা গল্প, গল্প শোনা

ছেলেবেলায় শোনা রাক্ষোস-খোক্কোস, রাজা-রানির গল্প। ঘুমপাড়ানি ভাললাগা সেই সব গল্পের স্মৃতিতে ফিরে গেলেন নবনীতা দেবসেন এবং সমরেশ মজুমদারমা কোনও দিন আমায় ভয়ের গল্প বলেননি। রাক্ষোস-খোক্কোস নিয়েও বলেছেন কি? মনে পড়ে না। মা খুব রাজকন্যা, রাজা-রানির গল্প বলতেন। সমুদ্র, পাহাড়, নদী, মাঠের গল্প বলতেন। গল্প বলে বলে মা ছবি আঁকতে পারতেন। আমি বালিগঞ্জে বড় হওয়া মেয়ে। ছেলেবেলায় ক’টাই বা গ্রাম দেখেছি! মায়ের কাছে গল্প শুনতে শুনতেই আমি গ্রাম চিনতে শিখেছি।

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৫ ০০:০৩
Share
Save

মা হত চাষিবউ আমি চাষির মেয়ে

নবনীতা দেবসেন

মা কোনও দিন আমায় ভয়ের গল্প বলেননি। রাক্ষোস-খোক্কোস নিয়েও বলেছেন কি? মনে পড়ে না।

মা খুব রাজকন্যা, রাজা-রানির গল্প বলতেন। সমুদ্র, পাহাড়, নদী, মাঠের গল্প বলতেন। গল্প বলে বলে মা ছবি আঁকতে পারতেন।

আমি বালিগঞ্জে বড় হওয়া মেয়ে। ছেলেবেলায় ক’টাই বা গ্রাম দেখেছি! মায়ের কাছে গল্প শুনতে শুনতেই আমি গ্রাম চিনতে শিখেছি।

মা টুনটুনির গল্প বলতেন।— ‘রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরে সে ধন আছে।’ মা ছড়া বলতেন। আমি হাঁ হয়ে চেয়ে থাকতাম।

আমার পিসিমা, মাসিমারাও আমাকে গল্প শোনাতেন, কিন্তু সেগুলো যেন ঠিক মায়ের মতো নয়।

মায়ের অনেক বানানো গল্প ছিল। সেই গল্পে আমি কখনও চাষির মেয়ে হয়েছি। মা হয়েছেন চাষিবউ। আমরা দু’জন মিলে মিছিমিছি খেতে ফসল তুলতাম। পুকুরে নামতাম। আমার ফ্রকটাকেই জাল বানিয়ে কোঁচড়ে মাছ ধরতাম।

কোনও এক দুপুরবেলা খাটের ওপর বসে আছি। মা বলত, ‘‘দেখো, এটা কিন্তু আসলে খাট নয়। জাহাজ। আমরা জাহাজে করে চলেছি সাগরের ওপর দিয়ে। নীল জল। জলে মাছ সাঁতার কাটছে। দেখো দেখো!’’ আমি তখন ছোট নাবিক, মা বড় নাবিক। অমন করে মা আমার মধ্যে কত যে কল্পনা উস্কে দিয়েছেন!

লাউ গড়গড়ের গল্প, প্রদীপের দৈত্যর গল্প মায়ের কাছেই প্রথম শোনা। কথাসরিৎসাগর-পঞ্চতন্ত্রের গল্প কত বার যে বলেছেন, ঠিক নেই। কিন্তু দক্ষিণারঞ্জনের গল্প মা কোনও দিন শুনিয়েছেন কি? বোধ হয় না।

বরং মায়ের কাছে স্নো হোয়াইট, গোল্ডি লক্স, রবিনহুড... এমন অনেক বিদেশি গল্প শুনেছি।

এক চড়াইয়ের গল্প বলতেন মা। চড়াই, চড়াইয়ের বউকে বলল, ‘‘আজ না আমার খুব পিঠে খাবার শখ হয়েছে।’’

তো, পিঠে করতে আটা এল। নারকোল এল। পিঠে করল চড়াই-বউ। কিন্তু চড়াই বাসায় ফেরার আগেই সে একটা মাত্র পিঠে চড়াইয়ের জন্য রেখে নিজেই সব পিঠে খেয়ে দিল।

চড়াই ফিরে বলল, ‘‘এ কী, তুমি একটা মাত্র পিঠে করেছ?’’ তখন চড়াই-বউ উত্তর দিল, ‘‘না গো, অনেক করেছিলাম, একটা পুড়ে গেল। একটা হাত থেকে কোথায় যে পড়ে গেল, খুঁজেই পেলাম না...।’’ এমনি করে চড়াই-বউয়ের অজুহাত যেন আর শেষ হয় না!

মায়ের কাছে এক রাজকন্যার গল্প শুনতাম। খুব কষ্টের। রানি-মা মারা গেছেন। মারা যাওয়ার আগে কন্যাকে তিনি একখানা শাঁখ দিয়ে গেছেন। শাঁখে ফুঁ দিলেই তাতে রানি-মায়ের ছবি ফুটে ওঠে। তিনি কথা বলেন। মায়ের জন্য কষ্ট হলেই রাজকন্যা শাঁখে ফুঁ দেয়, আর তার মা ছবি হয়ে দেখা দেন তাকে। কথাও বলেন।

ছোটবেলায় খেতে বসে খুব দুষ্টুমি করতুম। তখন মায়ের গল্পগুলো অন্যরকম হত। মা বলতেন, ‘‘দেখো, দেখো, আমরা এখন একটা গ্রামের মধ্যে দিয়ে চলেছি। এই দেখো পুকুর ঘাট। গাছ। গাছে গাছে কত পাখি। সবুজ মাঠ। আমরা আলের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে খেতের মধ্যে নেমে গেলাম। পটল খেত। সেখান থেকে পটল নিয়ে ফিরতে লাগলাম বাড়ি। বাড়ি ফিরে রান্না হল। পটল ভাজা। আর আমরা আয়েশ করে পটল ভাজা খেতে লাগলাম।’’ এর মধ্যেই কখন যে আমার অবাক মুখের ফাঁকে সত্যিকারের পটলভাজা চালান হয়ে গেছে, বুঝতেই পারিনি।

একদম দুধ খেতে চাইতাম না। মা তখন কোত্থেকে এক গল্প পাড়তেন, কার এক জনের বেশ! সে নাকি দশ মিনিটে চোঁ চোঁ করে দশ গ্লাস দুধ খেয়ে নিতে পারত। সেই শুনে আমার খুব মানে লাগত। ভাবতাম, ‘‘এ মা, ছি ছি! ও দশ গ্লাস দুধ খায়, আমি এক গ্লাসও খেতে পারব না!’’ ব্যস, দুধ খাওয়া হয়ে যেত।

ঘুম পাড়াতে গিয়ে মায়ের গল্পগুলো আবার আরেকরকম। তখন রাজার গল্প, পরির গল্প, রাজকুমারীর গল্প।

মায়ের যত বানানো গল্প, সবগুলো মা গুছিয়েগাছিয়ে লিখেও ফেলেছিলেন। তা দিয়ে বইও হয়েছে। একটা রূপকথার বইয়ের নাম ছিল ‘গল্পের আলপনা’। সে সব যে কোথায় গেল!

আমার মেয়েরাও ছেলেবেলায় আমার মতোই ছিল। খেতে চাইত না। ঘুমোতে চাইত না। দুষ্টুমি করত। আমি ওদের মায়ের মতোই গল্প বলতাম। ওরা তাই শুনতে শুনতেই বড় হয়েছে।

এখন আমার বড় মেয়েকে দেখি, নাতনিকে খুব গল্প বলে। তবে সে গল্প তো আমাদের মতো নয়। ছেলেভুলানো গপ্পোও যে সব দিনে দিনে বদলে বদলে গেছে!

ছেলেবেলায় ওরাই ছিল আমার নায়ক-নায়িকা

সমরেশ মজুমদার

আমি জন্মেছি চা-বাগানে। আমার ঠাকুরমাকে আমি পাইনি। বিধবা বড় পিসিমাকে পেয়েছি। তিনিই আমাকে ছোটবেলায় নানা রকম প্রশ্রয় দিতেন।

বছর চারেক বয়েসের কথা মনে পড়ে। আমার দুপুরগুলো কাটত পিসিমার কাছে।

বাড়িতে বাবা, মা, ঠাকুরদা, বড় পিসিমা ছাড়া, আর ছিল ঝাড়িকাকু। আমাদের বাড়ির সব কাজ করত। কিন্তু কেউই ওকে কাজের লোক বলে ভাবত না। আমি তো নয়ই। বছর পঞ্চাশ বয়েস। হাফ প্যান্ট পরত। গায়ে হাতকাটা গেঞ্জি। খালি পা। আমাদের একটা কুকুরও ছিল, কালু। সে ছিল সবার ন্যাওটা।

আর ছিল এক পেতনি। যাকে আমি দেখতে পেতাম না, বড় পিসিমা পেতেন। ভরদুপুরে পিসিমার কাছে গিয়ে বলতাম, ‘‘ও কি এসেছে গো?’’ পিসিমা বলতেন, ‘‘এখনও আসেনি। এলে তো তোকে জ্বালাতন করবে। ঘুমোতে পারবি না। শুয়ে পড় শিগ্গিরি। ও আসার আগেই ঘুমিয়ে পড়।’’

প্রায় প্রতি দুপুরে পেতনির আক্রমণ থেকে বড় পিসিমাই আমাকে বাঁচান! এটাই আমার বিশ্বাস ছিল।

একটু যখন বড় হলাম, ঝাড়িকাকুর সঙ্গে আমার দোস্তি হয়ে গেল। আমাদের বাড়ির পেছনে একটা ঝরনা ছিল। রাতের বেলা সবার খাওয়া হয়ে গেলে ঝাড়িকাকু সেই ঝরনায় বাসন মাজতে যেত। চার ধার নির্জন। খাঁ খাঁ অন্ধকার। আমি কেবলই ভাবতাম, ওখানে ও যে যায়, নিশ্চই পেতনিটার দেখা পায়।

প্রতি দিন সকালে ঝাড়িকাকুর সঙ্গে যখন প্রথম দেখা হত, আমি জিজ্ঞেস করতাম, ‘‘কাল যে গেলি কিছু কি দেখলি?’’ ঝাড়িকাকু নানা রকম বলত।

এক দিন বলল, ‘‘চাঁদের আলো, ঝিঁঝিঁর ডাক। হঠাৎ পাশের কুল গাছের মাথা থেকে খোকন বলে উঠল, ‘আমাকে এক টুকরো মাছ দিবি?’’’

আমি বললাম, ‘‘খোকন কে?’’ ও বলল, ‘‘ও বাব্বা, খোকন রে! ও বাড়ির বড়বাবুর ছেলে। গাছ থেকে পড়ে মরে গিয়েছিল।’’

তখনই আমার খোকনদার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। খোকনদা যখন মারা যায়, খুব কষ্ট হয়েছিল আমার। মা কিন্তু আমায় দেখতে যেতে দেয়নি। কিন্তু ঝাড়িকাকুর কথা শোনার পর থেকেই আমার খুব ওকে দেখতে যেতে ইচ্ছে করত। কেবলই খোকনদার গল্প শুনতে চাইতাম। ঝাড়িকাকু বলত, খোকনদা নাকি জ্যোৎস্না রাত হলেই ওর সঙ্গে দেখা করতে আসে।

এক রাতে ফিনফিনে জ্যোৎস্না। ঝাড়িকাকু ঝরনার ধারে চলে গেল। আমি বসে বসে খুব ভাবছি, আজ কী বলবে খোকনদা, কে জানে!’’

পরদিন সকালেই ধরলাম ঝাড়িকাকুকে। ও বলল, ‘‘খোকনের মনে খুব কষ্ট রে। ওর চেনা লোকগুলো সব পাল্টে যাচ্ছে, তাই। আমি বলেছি তোর কথা। তুই ওর সঙ্গে দেখা করতে চাস। ও বলল, ওকে বলো, আমি যে গাছ থেকে পড়ে মরে গেছি, সেটায় উঠে লাফ দিতে। তবেই আমার দেখা পাবে।’’

শুনে ভাবলাম, ও বাবা! অত উঁচু গাছে উঠব কী করে? বড় পিসিমাকে ধরলাম। সব বললাম। পিসিমা শুনে তো রেগে আগুন। চিৎকার করে ঝাড়িকাকুকে ডেকে পাঠালেন। ধমক দিয়ে বললেন, ‘‘ফের যদি অমন কথা বলেছিস, তোকে এ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেব।’’

ঝাড়িকাকুর গল্প বলা বন্ধ হয়ে গেল। আমি কিন্তু তক্কে তক্কে থাকতাম। এক দিন ওকে একা পেয়ে বললাম, ‘‘আজ আমাকে নিয়ে যাবি?’’ ফিসফি‌স করে ঝাড়িকাকু উত্তর দিল, ‘‘আজ যে অমাবস্যা। আজ ও আসবে না।’’

খোকনদাকে আমার আর দেখা হয়নি। সেই পেতনিকেও না। কিন্তু দিনের পর দিন দু’জনকে নিয়ে কত কল্পনা করেছি, কত হাজার হাজার গল্পে ডুব দিয়েছি!

আরেকটু বড় হয়ে যখন ভূতের গল্প পড়ার ছাড়পত্র পেলাম, তখন শুধু একটা তফাত খুঁজে পেলাম। গল্পের যত ভূত সব আসে রাত্তিরে। অন্ধকারে। অমাবস্যার দিনে তাদের বাড়়বাড়ন্ত বেশি। শুধু পিসিমার পেতনি আসত ভর দুপুরে। আর ঝাড়িকাকুর ‘খোকন’ ফটফটে জ্যোৎস্নায়।

আমার ছেলেবেলার গল্পের ভুবনে এরাই ছিল আমার নায়ক আর নায়িকা।

samaresh majumdar story bengali writer Nabaneeta Dev Sen

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}