Advertisement
E-Paper

শতাধিক সোমনাথের এ যেন এক অন্য মহাকাশ

রঙিন স্কেচ পেনের আঁকিবুকি যতটা স্কেচি, ততোধিক মুহূর্তের উন্মাদনা অথবা কর্মচঞ্চলতার কায়িক শ্রমকেই প্রতিপন্ন করে।

অতনু বসু

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২০ ০০:৫৭
প্রান্তিক: সোমনাথ হোরের প্রদর্শনীর একটি কাজ

প্রান্তিক: সোমনাথ হোরের প্রদর্শনীর একটি কাজ

১৯২১-এ তাঁর জন্ম। শতবর্ষের প্রাক্কালে তাই শিল্পীর শতাধিক ছোট ও সামান্য বড় কাজের একটি মনোজ্ঞ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল দেবভাষা। যেখানে সোমনাথ হোরের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল। প্রদর্শনীটি সম্ভব হয়েছে ওঁর একমাত্র কন্যা চন্দনা হোরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। ক্ষতচিহ্ন, যন্ত্রণা, আঘাত, অত্যাচার সোমনাথ দেখেছেন। ছবি এঁকেছেন সেই সব মানুষের, যাঁরা মাটির কাছাকাছি— নিম্ন বর্গের, নিচু শ্রেণির। অত্যাচারিত, দলিত, শ্রমিক, মেহনতি মানুষদের জন্য লিখেছেন, এঁকেছেন আরও বেশি। সারাজীবন মানুষের কথা ভেবেছেন কমিউনিস্ট আদর্শে দীক্ষিত এই শিল্পী।

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন, ‘এটি প্রদর্শনী নয়, এক প্রজ্ঞার সামনে দাঁড়ানো।’ এ কথার তাৎপর্য আছে। একজন মানুষের তিরিশ বছরের খণ্ড মুহূর্তে মানুষ কী রকম ভাবে রং, রেখা, তক্ষণ, পাথরছাপের মাধ্যমে জীবনের নানা কর্মচঞ্চলতা, যাপন ও দৈনন্দিনতার মুহূর্তগুলিকে বাস্তবায়িত করিয়েছেন একজন সংগ্রামী মহান চিত্রকর-ভাস্করকে দিয়ে, সেটিই দেখার মতো। তাঁর প্রজ্ঞার অন্তরালে সত্যিই এ সমস্ত কিছু ভেসে ওঠে ‘শান্তিনিকেতন অ্যান্ড আদার স্টোরিজ়’-এ।

রঙিন স্কেচ পেনের আঁকিবুকি যতটা স্কেচি, ততোধিক মুহূর্তের উন্মাদনা অথবা কর্মচঞ্চলতার কায়িক শ্রমকেই প্রতিপন্ন করে। বিরাম-বিলাস-বৈভবের পরিসরে নয়, খেটে খাওয়া মানুষের প্রেক্ষাপটটিকে চিনতে চেষ্টা করেছেন বরাবর। তাই তো অমন সব বিষয়কে নিয়েই তাঁর বহু ড্রয়িং, স্কেচ, আঁকাআঁকি। তিনি তো বলেইছিলেন, ‘শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট’ তাঁর ছবিতে ভর করত। ‘বিন্যাসের দিকে নজর দিলেও কিন্তু তা বিষয়কে প্রতিভাত করার উদ্দেশ্যে।’ যদিও আলাদা করে শরণার্থী সিরিজ় এখানে নেই। ওই বিষয় সম্পর্কিত ব্যাপারে এ-ও জানিয়েছিলেন যে, ‘ছবি বিষয়নির্ভর না হলেও চলে, বিষয় অনেক ক্ষেত্রে নান্দনিক অনুভূতিতে বাধা সৃষ্টি করে। আমার তখন উভয়সংকট। বিষয়কে ভুলতে পারি না—বিষয়কে না ভুললে শিল্পকর্মের উত্তরণ ঘটে না।’

সত্যিই তো। এ প্রদর্শনীর প্রায় সব ছবিই বিষয়নির্ভর নয়। আর নয় বলেই তাঁর তুলি-কালির রেখা, স্কেচ পেনের দ্রুত টানটোনের সৃষ্টি, পেনের সরু ড্রয়িংয়ে করা মানুষ ও জন্তু, গৃহপালিত পশুর মুহূর্তগুলি অতটা প্রাণবম্ত। ঝকঝকে পরিচ্ছন্নতার কৃত্রিমতা নেই, আছে তাঁর তুলি-কলমের উচ্চকিত স্বর, পরিমিত ও প্রয়োজনীয় সংলাপ— সে রং বা রেখা যা-ই হোক। কোনও কোনও ড্রয়িং স্কাল্পচারাল কোয়ালিটিরও। এই চিন্তাক্লিষ্ট, বিষণ্ণ, কৌতূহলী বা দ্বিধাগ্রস্ততার একটা ছাপ তো তাঁর ওই সমস্ত কাজের অলঙ্কার! এখানে স্পেস নিয়ে ভাবনার বালাই নেই। বিষয়হীন বিষয়। তাৎক্ষণিক দর্শন বা স্মৃতিচিহ্নিত কোনও খণ্ড-বিচ্ছিন্ন সময়কে কিছু টানটোনে মূর্ত করেছেন ওই মাধ্যমগুলিতে।

গল্পগাছা, অবসরযাপন, একলা মানুষ, দ্বৈত সত্তার ভিন্ন মুহূর্ত...বিষয় হিসেবে কী না এসেছে! একটু লক্ষ করলেই বোঝা যাবে, তিনি রেখাকে দু’রকম ভাবে পরিচালনা করেছেন। এই রেখা কখনও দ্রুত, তীব্র ভাবে ছটফটে। ইচ্ছাকৃত বঙ্কিমতা এনে, ভেঙেচুরে, অতিরিক্ত রেখার সমাহারে যেমন তৈরি হচ্ছে ড্রয়িং‌। আবার রেখা যেখানে স্থিতধী অবয়বের ভঙ্গি বা প্যাটার্ন বা মুহূর্ত, সেখানে প্রত্যক্ষ দর্শনের ফলে গড়ন ও বিন্যাস অনুযায়ী রেখাকে পরিচালনা করেছেন। এখানেই পরিমিতিবোধ ও প্রয়োজনীয়তার বাইরে যে অন্য কিছু হতে পারে না, তা স্পষ্ট উপলব্ধি করিয়েছেন। কোথাও অত্যল্প আভাস দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। কোথাও ছিন্নভিন্ন রেখার রঙিন স্ট্রোক ও অন্য ধরনের ছায়াতপ তৈরি করেছেন। যার সঙ্গে পেন-ইঙ্ক ও ছাপচিত্রের ছায়াতপের আকাশ-পাতাল তফাত। এই টোনের গাঢ়ত্ব ও অপসৃয়মাণতা নির্দিষ্ট ড্রয়িং বা মিশ্র মাধ্যম, প্যাস্টেল বা ছাপচিত্রের ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছে।

লাল পেনের রেখার দ্রুততা, কাব্যিক রেখার সংক্ষিপ্ত তির্যক ভঙ্গিতে অনবদ্য স্কেচ যেমন করেছেন, তেমনই আপাতহালকা ঘষামাজা অবস্থাটিতে গাঢ় রেখার প্রাধান্যে চরিত্রকে বাঙ্ময় করেছেন।

পেন-ইঙ্কে করা দাঁড়ানো ষাঁড়ের ছবিগুলি দেখে মনে পড়ে যায়, ’৮৭ সালের এক ডায়েরিতে লিখছেন, ‘(ব্রোঞ্জ) মোষের পেছনের পা দুটি কেটে নিলাম, ও দুটিকে বেয়াড়া মনে হচ্ছিল, আবার জুড়তে ত হবেই।’ এখানে তাঁর মোষেরা তো ভাস্কর্য নয়। তাদের পিছনের পা দু’টিও চমৎকার ড্রয়িংয়ে অটুট। তাই বোধহয় লিখেছিলেন, ‘জ্যান্ত জীবের অঙ্গ বিকৃতি সহ্য হয়ে যায়, কিন্তু যাহা জড় তাহা বড় মুখর, অবহেলা চলে না।’

Devbhasha Painting Exhibition
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy