Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

তাঁর স্পষ্টকথার তারিফ করতেন রবীন্দ্রনাথও

তাঁর পাণ্ডিত্যে স্তব্ধ হতেন বিশ্বখ্যাতরা। ব্যক্তিজীবনে একের পর এক শোক তাঁর ঋজুতায় ছাপ ফেলেনি। তিনি ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। লিখছেন অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়জোর শোরগোল স্কটিশ চার্চ কলেজের শিক্ষকমহলে। সবের মূলে একটি ছাত্র। তখন মাস্টার্সে দর্শন অথবা অঙ্ক পড়ার ব্যবস্থা বহাল কলেজে। ছেলেটি অঙ্ক আর দর্শন দু’টোই খুব ভাল করে। গোলমাল বেধেছে অঙ্কের বিখ্যাত অধ্যাপক গৌরীশঙ্কর দে আর দর্শনের উইলিয়াম হেস্টি সাহেবের মধ্যে।

ব্রজেন্দ্রনাথ শীল

ব্রজেন্দ্রনাথ শীল

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

জোর শোরগোল স্কটিশ চার্চ কলেজের শিক্ষকমহলে।

সবের মূলে একটি ছাত্র।

তখন মাস্টার্সে দর্শন অথবা অঙ্ক পড়ার ব্যবস্থা বহাল কলেজে। ছেলেটি অঙ্ক আর দর্শন দু’টোই খুব ভাল করে।

গোলমাল বেধেছে অঙ্কের বিখ্যাত অধ্যাপক গৌরীশঙ্কর দে আর দর্শনের উইলিয়াম হেস্টি সাহেবের মধ্যে।

দু’জনেরই দাবি, ছাত্রটি পরীক্ষা দিক তাঁদের বিষয়ে।

ছাত্র পড়ল মহা ফাঁপরে।

শেষমেশ সে ঠিক করল অঙ্কেই মাস্টার্স করবে।

এ দিকে ফর্ম পূরণের দিন আরেক গোল। হেস্টি সাহেবের মুখটা বোধহয় মনে পড়ে গেল ছাত্রের। ফর্মে বিষয়ের জায়গায় সে অঙ্কের বদলে লিখে ফেলল দর্শন।

কী হবে এ বার?

প্রস্তুতি তো নিয়েছে অঙ্কে। দ্বিতীয় বার ফর্ম ফিলাপের উপায় নেই। শিক্ষকরা ঘোর দুশ্চিন্তায়। কিন্তু ছাত্রটি অবিচল।

পরীক্ষার ফল বেরোলে দেখা গেল ছাত্রটি দর্শনে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে পাশ করেছে। ছাত্রের নাম? ব্রজেন্দ্রনাথ শীল।

পরের জীবনে যাঁর পরিচয় এক বিখ্যাত দার্শনিক।

ছাত্রবেলার ওই অভূতপূর্ব কাণ্ডে জড়ানো ব্রজেন্দ্রনাথ বরাবরই এমন অদ্ভুত প্রকৃতির। ছেলেবেলা থেকেই কোনও একটি মাত্র বিষয়ে তাঁর মন টেকে না।

অন্তত দু’টি ঘটনার কথা বলা যেতে পারে।

ব্রজেন্দ্রনাথ তখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। বীজগণিতটা ভীষণ ভাল লাগে। উঁচু ক্লাসের জটিল অঙ্কগুলো নিমেষে কষে ফেলেন। বন্ধু থেকে মাস্টারমশাই সকলেই ভীষণ অবাক।

এনট্রান্স পরীক্ষায় ব্রজেন্দ্রনাথ বৃত্তি পেলেন। ভর্তি হলেন জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইনস্টিটিউশনে। ব্রজেন্দ্রনাথের অঙ্ক-প্রতিভা তত দিনে চাউর হয়ে গিয়েছে সব মহলেই।

আচমকা ছন্দপতন।

অঙ্কে যেন তেমন আর টান অনুভব করছেন না ব্রজেন্দ্রনাথ। উল্টে সেই পুরনো প্রেম, দর্শন শাস্ত্রে তাঁর অনুরাগ বাড়ছে। সেখানে অবশ্য বড় কারণ সেই হেস্টি সাহেব। ক্লাসে বড় ভাল লাগত অধ্যক্ষ হেস্টির পড়ানো। মাস্টারমশাই বুঝতে পারেননি এই ছাত্রই তাঁকে বিস্মিত করবে।

হেস্টি একদিন লজিকের একটা অত্যন্ত জটিল বই নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ছাত্রটি আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না।

‘‘বইটা দেবেন স্যার? একটু পড়ে দেখতাম।’’

হেস্টি শুনে কিছুতেই এ বই দেবেন না ছাত্রকে। এই বয়সে এ বইয়ের মর্ম ও বুঝবে কী করে! শেষমেশ নাছোড় ছাত্রের কাছে হার মানলেন স্যার। বই হাতে পেয়ে মাত্র তিন দিনে গোগ্রাসে গিলে ফেললেন ব্রজেন্দ্রনাথ।

তবে হেস্টিও ঝানু মাস্টারমশাই। ঠিক করলেন পরখ করে দেখা যাক। ব্রজেন্দ্রনাথ আদৌ বইটার কিছু বুঝেছে কি না। শুরু হল মৌখিক পরীক্ষা। মাস্টারমশাইয়ের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্রজেন্দ্রনাথ সময় নিলেন নামমাত্র।

আরও একবার। তখন এমএ পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। ব্রজেন্দ্রনাথ মেতে উঠলেন অর্থশাস্ত্র, সংস্কৃত, আর ভূতত্ত্বের চর্চায়।

তার মাঝেই এক ভদ্রলোক এলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি দেখেন রাশি রাশি ম্যাপ আর চার্ট ঘরময় ছড়ানো। তার মাঝে বসে ব্রজেন্দ্রনাথ।

ভদ্রলোক অবাক চেয়ে দেখলেন পেশাগত ভাবে দার্শনিক ব্রজেন্দ্রনাথ তখন দক্ষিণ আমেরিকার ভূ-প্রকৃতি কেমন, তারই রহস্য সন্ধানে মগ্ন হয়ে মাথা খুঁড়ছেন!

বহু বিষয়ের চর্চা করা ব্রজেন্দ্রনাথের পাণ্ডিত্যের বিস্তার নিয়ে উনিশ ও বিশ শতকের বাংলায় বহু গল্পকথা ছড়িয়ে।

একবার কলকাতা থেকে মুম্বই যাচ্ছেন বিখ্যত ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড থম্পসন। আচমকা দেখেন তাঁর প্রথম শ্রেণির কামরায় এলাহাবাদ স্টেশনে এক বাঙালি ভদ্রলোক উঠে পড়লেন।

উঠেই তিনি শুরু করলেন কমলালেবু খাওয়া। থম্পসন ভাবলেন এই গেল! বাঙালি ব্যাটা এ বার গোটা কামরাটা না কমলালেবুর খোসা ছড়িয়ে নোংরা করে ফেলে।

কিন্তু তেমন কিছুই তো ঘটল না।

বাঙালি ভদ্রলোকটি একটি প্যাকেটে তুলে রাখলেন কমলালেবুর খোসা। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন থম্পসনও। শুরু হল আলাপ।

ইতিহাস নিয়েই শুরু কথাবার্তা। কিন্তু খানিক দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান— ভূ-ভারতে যতগুলি বিদ্যার শাখা আছে, তা সবই উঠে আসতে থাকল আলাপে। ঠিক আলাপ নয়, একতরফা বাঙালি ভদ্রলোকটিই বলে চলেছেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড শুধুই শ্রোতা। মুম্বই স্টেশনটাও যেন কেমন তাড়াতাড়ি চলে এল। নামার সময় থম্পসন বলে গেলেন, ‘‘আপনার নাম জানতে চাইছি না। ভারতবর্ষে একজনই আছেন, যাঁর প্রজ্ঞা এমন প্রসারিত। আমি নিশ্চিত, আপনিই সেই ব্রজেন্দ্রনাথ শীল।’’

বিলেতেও যে ব্রজেন্দ্রনাথের মান্যতা কতখানি ছিল, তা বোঝা যায় আর একটি ঘটনা থেকে।

একবার সুইৎজারল্যান্ডে পক্ষী প্রদর্শনীর আন্তর্জাতিক আসর। একটি পাখির মূল বাসস্থান কোথায়, তা নিয়ে কর্তৃপক্ষ প়ড়েছেন মহা সমস্যায়।

ব্রজেন্দ্রনাথও উপস্থিত সেখানে। কেউ কেউ ব্রজেন্দ্রর পাণ্ডিত্যের কথা আগে শুনেছিলেন। গেলেন জানতে, যদি কোনও হাল হয়!

পাখিটাকে দেখে একটি অঞ্চলের কথা বললেন ব্রজেন্দ্রনাথ। বিশ্বাস হল না কর্তৃপক্ষের। পরে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেল ব্রজেন্দ্রনাথ যা বলেছিলেন, ঠিক সেই জায়গাটিই পাখিটির আদি বাসস্থান।

বিদেশিদের বেকুব বানাতেও ব্রজেন্দ্রনাথের জুড়ি মেলা ভার।

একবার জাহাজে চড়ে লন্ডন যাচ্ছেন ব্রজেন্দ্রনাথ। জাহাজের ক্যাপ্টেনের ইচ্ছে হল বাঙালি ভদ্রলোককে নিয়ে একটু মশকরা করা যাক।

কথা প্রসঙ্গে ক্যাপ্টেন জেনে নিলেন ব্রজেন্দ্রনাথের পড়াশোনার বিষয় দর্শন। সমুদ্রের দিকে আঙুল তুলে তিনি ব্রজেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘‘ওই যে দূরের জাহাজ। আপনার দর্শন কি ওই জাহাজের গতি নির্ণয় করতে পারবে?’’

প্রশ্নটি করে ক্যাপ্টেনের মুখে কেমন যেন একটা তাচ্ছিল্যের হাসি। ব্রজেন্দ্রনাথ কিন্তু পাল্টা মৃদু হাসি দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে নির্ণয় করে ফেললেন জাহাজের গতি। রীতিমতো বেকুব বনে ডকের উপর দাঁড়িয়ে রইলেন ক্যাপ্টেন।

ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের বসতবাড়ি

অঙ্কে ব্রজেন্দ্রনাথের দক্ষতা ঠিক এমনই ছিল। ভালবাসাও। তাই বোধহয় রাশিবিজ্ঞান নিয়েও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। আগ্রহটা এমনই যে, প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশকে পর্যন্ত এই বিষয়ের গবেষণার জন্য উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন।

আসলে বিজ্ঞান, বিশেষ করে অঙ্কের জন্য সাতখুন মাপ করতেও কসুর করতেন না তিনি।

তেমনই একটি গল্পে আসা যাক।

এটি পাওয়া যায় ব্রজেন্দ্রনাথের ছাত্র কুমুদবন্ধু চক্রবর্তীর লেখা থেকে। একবার বিএ পরীক্ষার টেস্টে এক ছাত্র ইংরেজিতে ভীষণ কম নম্বর পেয়েছে। কিন্তু অঙ্কের ফল নজরকাড়া।

কর্তৃপক্ষ জানালেন, ওই ছাত্রটিকে কিছুতেই বিএ পরীক্ষায় বসতে দেওয়া যাবে না। এগিয়ে এলেন ব্রজেন্দ্রনাথ। পরীক্ষকদের বললেন, ‘‘কিন্তু ও যে অঙ্কে বড় ভাল।’’

সঙ্গে এও জানিয়ে দিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ, তিনি ওই ছাত্রটিকে ইংরেজি শেখাবেন।

ঋদ্ধ, প্রাজ্ঞ ব্রজেন্দ্রনাথের কথায় কারই বা ভরসা নেই! ফলে ইংরেজিতে কম পাওয়া ছাত্রটি রেহাই পেল। ব্রজেন্দ্রনাথ কথামতো তাকে ইংরেজি পড়াতে লাগলেন। যথাসময়ে পরীক্ষার ফল বেরলে দেখা গেল, ভালমতোই উতরে গিয়েছে ছেলেটি।

এমন নজিরবিহীন সু-অভ্যেস ব্রজেন্দ্রনাথের বরাবরই ছিল।

সে একেবারেই ছাত্রবেলা থেকে।

বিএ পরীক্ষা। প্রথম দিন, ওঁর প্রিয় বিষয় দর্শনের পরীক্ষা। কিন্তু প্রশ্নপত্র পেয়েই কেমন যেন হয়ে গেল তাঁর। মাত্র একটা প্রশ্ন লিখতেই পরী‌ক্ষার পুরো সময় পার!

ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন ব্রজেন্দ্রনাথ। ঠিক করলেন আর পরীক্ষা দেবেন না।

ব্রজেন্দ্রর দাদা অবশ্য সে-যাত্রা ঠেলেঠুলে ভাইকে পরীক্ষা দেওয়ালেন। ফল বেরোতে দেখা গেল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক দিয়ে সম্মানিত করছে ব্রজেন্দ্রনাথকে। শোনা যায়, ব্রজেন্দ্রনাথের সেই উত্তরপত্রে পরীক্ষকেরা মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘ওই একটি উত্তরকেই মৌলিক গবেষণা হিসেবে গণ্য করা যায়।’’

এই মাপের একজন পণ্ডিত মানুষ ব্রজেন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবনটা কিন্তু মোটেই তেমন সুখের ছিল না।

জন্ম ১৮৬৪-র ৩ সেপ্টেম্বর। থাকতেন উত্তর কলকাতার রামমোহন সাহা লেনে। বাবা, মহেন্দ্রনাথ শীল। পেশায় ব্যবহারজীবী। আগ্রহ দর্শন, অঙ্ক আর ভাষার চর্চায়। আর ঝোঁক বেহালা বাজানোয়।

কিন্তু বাবার ছায়া আর ক’দিন পেলেন ব্রজেন্দ্রনাথ!

বয়স যখন মাত্র ৮ বছর, চলে গেলেন পিতৃদেব। দিন কয়েকের মধ্যে মা রাধারানিও মারা গেলেন।

বাড়িতে ছোট্ট ব্রজেন্দ্রনাথ। তাঁর থেকে বছর দশেকের বড় দাদা রাজেন্দ্রনাথ শীল। দু’জন ছোট বোন।

ভাগ্যিস ঠাঁই হল মামার বাড়িতে!

সংসারের হাল ধরলেন রাজেন্দ্রনাথ। পড়াশোনা ছেড়ে ঢুকে পড়লেন অল্প মাইনের চাকরিতে।

কায়ক্লেশে জীবন চলল ভাইবোনদের। আর শোক? কিছুতেই যেন পিছু ছাড়ল না ব্রজেন্দ্রর।

অবস্থা কিছুটা শুধরোলে ১৮৮১-তে বিয়ে হল ব্রজেন্দ্রনাথের। পাত্রী অসমের সরকারি ইঞ্জিনিয়ার জয়গোপাল রক্ষিতের মেয়ে ইন্দুমতী।

ইন্দুমতী ছিলেন রীতিমতো শিক্ষিত। তাঁর টান ইংরেজ রোমান্টিক কবিদের লেখায়। স্বামীর সঙ্গে প্রায়ই চলত কোলরিজ, কিটস, ওয়ার্ডসওয়ার্থ নিয়ে আলোচনা।

এ সুখও সইল না। মাত্র ছ’বছরের দাম্পত্য কাটিয়ে ইন্দুমতী মারা গেলেন। রেখে গেলেন, চার ছেলে আর এক মেয়েকে। ছোট ছেলেটিও মারা গেল অল্প বয়সেই। ব্রজেন্দ্রনাথের অবস্থা তখন বেহাল বললেও কম। একে বয়স কম, তার উপরে দেশ-বিদেশ থেকে আলোচনাসভায় যোগ দেওয়ার ডাক আসছে। কিন্তু অমন ক’টি শিশুকে ফেলে যান কোথা!

কিন্তু পিছু হটার লোক নন তিনি। সব কিছু সামলে দিলেন। বড় করলেন ছেলেমেয়েদের।

বড় ছেলে বিনয়েন্দ্রনাথ কেমব্রিজ থেকে পড়াশোনা করে দেশে ফিরে মুম্বইয়ের এলফিনস্টোন কলেজের অধ্যক্ষ হলেন। মেজ ছেলে অমরেন্দ্রনাথ হলেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর আবাস হল লন্ডন। সেজ ছেলে অনিলও পড়াশোনা করতে লাগলেন কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে। সবার ছোট, মেয়ে সরযূবালা। তাঁর সঙ্গে চিত্তরঞ্জন দাসের ভাই বসন্তরঞ্জনের বিয়ে হল।

কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই মারা গেলেন জামাই বসন্তরঞ্জনও।

মেয়েকে নিয়ে এ বার কী করবেন ব্রজেন্দ্রনাথ! ঠিক করলেন মেয়ের লেখালেখিতে উৎসাহ দেওয়া যাক। যদি তাতে খানিক ভাল থাকে সে। সরযূবালা নিয়মিত লিখতে থাকলেন ‘নারায়ণ’ পত্রিকায়।

ব্যক্তিজীবনের ‘বিচ্ছেদ-শোকে’র খানিকটা বোধহয় ব্রজেন্দ্রনাথ ভুলে থাকতে পেরেছিলেন তাঁর ঈর্ষণীয় বন্ধু-সান্নিধ্যের কারণে।

বয়সে ছোট বা বড় যেই-ই হোক না কেন, ব্রজেন্দ্র-সান্নিধ্য লাভে কাউকেই তেমন বেগ পেতে হত না।

ব্রজেন্দ্রনাথের বন্ধুর তালিকায় সব থেকে বড় যে নামটি, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সে সম্পর্ক এতই নিবিড় যে, রবীন্দ্রনাথের লেখাপত্র নিয়েও মন্তব্য করতেন ব্রজেন্দ্রনাথ। একবার তো কবিকে বলেই ফেলেন, ‘গীতাঞ্জলি’ অপেক্ষাও রবীন্দ্রনাথ অনেক ভাল লেখা লিখেছেন।

শুধু তাই নয়, ‘গীতাঞ্জলি’ প্রসঙ্গে যে-সাহেবের মতামত খানিক বেশিই চর্চিত, সেই ডব্লিউ বি ইয়েটসকেও রেয়াত করেননি ব্রজেন্দ্রনাথ। তাঁর মতে, ইয়েটস গীতাঞ্জলি বুঝতে ‘কিয়দংশে ভুল করিয়াছেন।’

স্পষ্টবাদী ব্রজেন্দ্রনাথের প্রতি রবীন্দ্রনাথের অসীম শ্রদ্ধার কথা জানা যায় একটি ঘটনা থেকে।

সময়টা ১৯২১-এর ২৩ ডিসেম্বর।

বিশ্বভারতীর পরিষদ সভার প্রতিষ্ঠা উৎসব। সেখানে সভাপতি হিসেবে যোগ দিলেন ব্রজেন্দ্রনাথই।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর বন্ধুর উদ্দেশে আহ্বান জানালেন, ‘‘বিশ্বের প্রতিনিধিরূপে আমাদের হাত থেকে একে (বিশ্বভারতীকে) গ্রহণ করে বিশ্বের সম্মুখে স্থাপন করুন।’’

রবীন্দ্র-ব্রজেন্দ্র সখ্যের একটি চমৎকার ঘটনার কথা লিখেছেন নির্মলকুমারী মহালানবিশ।

ব্রজেন্দ্রনাথের বেঙ্গালুরুর বাড়ি ‘ব্যালাব্রুয়ি’তে একবার রবীন্দ্রনাথ দিন কয়েকের জন্য উঠেছেন। সেখানে বসেই রবীন্দ্রনাথ শেষ করলেন তাঁর বুড়ো বয়সের একটি লেখা।

ব্রজেন্দ্রনাথ শুনতে চাইলেন।

পড়া শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ।

বৃদ্ধ ব্রজেন্দ্রনাথ বিস্মিত!

দাড়িতে হাত বুলিয়ে মাঝে মাঝে শুধু বলে চলেছেন ‘বাঃ চমৎকার’ ‘ব্রিলিয়ান্ট’ ইত্যাদি।

রবীন্দ্রনাথের পড়া শেষে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘এখনও এই রকম লেখা বেরোচ্ছে? এই বয়সেও?’’

লেখাটির নাম ‘শেষের কবিতা’।

শুধু রবীন্দ্রনাথই নয়।

আড্ডাপ্রিয় ব্রজেন্দ্রনাথের বৈঠকখানায় নিয়মিত দেখা মিলত জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রমেশচন্দ্র মজুমদার, চিকিৎসক নীলরতন সরকারের মতো সেকালের নক্ষত্রদের।

এখানেও সেই ব্রজেন্দ্র-পাণ্ডিত্যের কথা ছড়িয়ে রয়েছে। প্রফুল্লচন্দ্র তখন তাঁর বিখ্যায় ‘হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি’ বই লেখায় ব্যস্ত। কিন্তু একটা বিষয়ে তাঁর তেমন অধিকার নেই বলেই তিনি মনে করলেন। বিষয়টা ‘প্রাচীন ভারতের পরমাণুতত্ত্ব’।

কী করবেন? ছুটলেন ব্রজেন্দ্রনাথের কাছেই। প্রবীণ দার্শনিকের অধ্যায়টি লিখতে অবশ্য তেমন বেগ পেতে হল না।

বন্ধুতার টান ব্রজেন্দ্রনাথকে চিরকাল টেনেছে। ব্রজেন্দ্রনাথ তখন কোচবিহারের কলেজে রয়েছেন।

হঠাৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, তাঁর বন্ধু প্রস্তাব পাঠালেন রাজা পঞ্চম জর্জের সম্মানে তৈরি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অধ্যাপক পদে যোগ দিতে হবে।

অনুরোধ ঠেলতে পারলেন না ব্রজেন্দ্রনাথ। বন্ধুটি যে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়!

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অবশ্য নাড়ির যোগ ব্রজেন্দ্রনাথের।

সে কেমন? একবারের কথা বলা যাক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যা খতিয়ে দেখতে একটি কমিশন তৈরি হল। নেতৃত্বে লিড্‌স বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মাইকেল স্যাডলার।

স্যাডলার পরামর্শের জন্য ছোটেন ব্রজেন্দ্রনাথের কাছেই। বাকিটা ইতিহাস। সেই ভিনদেশি পণ্ডিত ব্রজেন্দ্রনাথের শিক্ষা ও প্রশাসন সম্পর্কে দক্ষতায় বিহ্বল হয়ে যান।

ব্যক্তিজীবনে ব্রজেন্দ্রনাথ আজীবন ছিলেন ব্রাহ্ম। তাঁর আধ্যাত্মিক জীবনের সঙ্গেও একজন মনীষীর নাম জড়িয়ে রয়েছে।

ছাত্রজীবনে তাঁর এক বন্ধু ছিল। ক্লাসে হেস্টি সাহেব একবার ধর্মের কথা বলতে বলতেই শ্রীরামকৃষ্ণের প্রসঙ্গ তুললেন।

ব্রজেন্দ্রনাথ ও তাঁর সেই বন্ধুটি ঠিক করলেন রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করবেন। গেলেনও।

এর পর থেকে বন্ধুটি বাঁধা পড়ে গেলেন পরমহংসের কাছে। বন্ধুটির নাম? নরেন্দ্রনাথ দত্ত। যিনি পরে স্বামী বিবেকানন্দ নামে পরিচিত হন।

বিবেকানন্দের সঙ্গে ব্রাহ্ম ব্রজেন্দ্রনাথের হৃদ্যতায় কোনও দিন ভাঁটা পড়েনি। তাই বোধহয় রামকৃষ্ণের জন্মশতবর্ষে আয়োজিত সর্বধর্ম সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণটিও ব্রজেন্দ্রনাথই দিয়েছিলেন।

আসলে ধর্মতত্ত্বের চর্চা ব্রজেন্দ্রনাথের বহুকালের প্রিয় বিষয়।

এখানেও বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর একটা মিল রয়েছে। ১৮৯৩-এ স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগোতে ‘বিশ্বধর্ম সম্মেলন’-এ স্মরণীয় বক্তৃতা দিলেন।

এর বছর ছয়েক বাদে রোমে বসল ‘আন্তর্জাতিক প্রাচবিদ্যা সম্মেলন’। ব্রজেন্দ্রনাথ তখন কোচবিহারের ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ।

মহারাজার কাছে প্রতিনিধি পাঠানোর জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন সম্মেলনের আয়োজকেরা।

ব্রজেন্দ্রনাথ থাকতে আর কেইই বা যাবেন! ব্রজেন্দ্রনাথের বক্তব্যের বিষয় ছিল খ্রিস্ট ও বৈষ্ণব ধর্মের তুলনামূলক আলোচনা।

তাঁর বক্তৃতা শুনে নড়েচড়ে বসলেন ইউরোপের বিদগ্ধ মহল। এর পরেও বেশ কয়েকটি সভা-সমিতিতে যোগ দিতে ব্রজেন্দ্রনাথ ইউরোপ ও লন্ডন সফর করেন।

দশটি ভাষায় পারদর্শী ব্রজেন্দ্রনাথের কর্মজীবনও বৈচিত্রে ভরা। পড়িয়েছেন সিটি কলেজ, বহরমপুর কলেজ, ভিক্টোরিয়া কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ বিভিন্ন জায়গায়।

বহরমপুর কলেজের অধ্যক্ষ পদে ব্রজেন্দ্রনাথ যখন যোগ দেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মোটে চব্বিশ বছর। কিন্তু শুধু বাংলাতেই মন টেকেনি ব্রজেন্দ্রনাথের। নাগপুরের মরিস কলেজে অধ্যক্ষ এবং মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবেও তাঁর খ্যাতি গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

ন’বছর মহীশূরে উপাচার্য থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামো, পাঠ্যক্রম ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি নজর দিয়েছিলেন সংখ্যালঘুদের উন্নয়নেও।

১৯৩৮-এ ব্রজেন্দ্রনাথ যখন চিরবিদায় নেন, তাঁর বয়স হয়েছিল চুয়াত্তর বছর।

তার আগে কত যে সম্মান!

মহীশূর সরকার ‘রাজতন্ত্র প্রবীণ’। ইংরেজদের নাইটহুড। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিএসসি...।

আরও কত কী!

কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ব্রজেন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছেন ‘সোক্রোতেস বংশের শেষ কুলপ্রদীপ’।

ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড থম্পসনের বন্ধু প্যাট্রিক সেডেড বলেছেন, ‘‘Seal was the greatest brain functioning in this planet’’।

কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, বাঙালির চির-আক্ষেপের বিষয় হল, এই মনীষীর লেখাপত্রের রচনাবলি বা সংকলন আজ অবধি প্রকাশিত হয়নি। এক বার প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশ চেষ্টা করেছিলেন। ব্যর্থ হন।

তার পর থেকে এমন বর্ণময় জীবন, তাঁর রচনা উদ্ধারের আর কোনও চেষ্টাই হল না!

হায়, অবোধ বাঙালি!

ঋণ: কারুভাষ (ব্রজেন্দ্রনাথ শীল সংখ্যা), ‘আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল’, হরিপদ মণ্ডল, ‘আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল— এ লাইফ স্কেচ’, বিভূতিভূষণ সরকার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Brajendra Nath Seal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE