‘খুসরো অ্যায়সি প্রীত কর, জ্যায়সে হিন্দু জোয়ে,
পূত পরায়ে কারনে, জ্বলজ্বল কোয়েলা হোয়ে।’
সময়টা ত্রয়োদশ খ্রিস্টাব্দ। যুদ্ধ, খুনখারাপি, ষড়যন্ত্রের স্থায়ী পরিবেশে ক্লান্ত ও ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক মানচিত্রের ভারতবর্ষ। এক সুফি কবি আবুল হাসান ইয়ামিনুদ্দীন খুসরো দিল্লির মসনদে তিনটি ভিন্ন বংশ এবং প্রায় ন’জন মুসলমান শাসকের শাসনকাল অতিবাহিত করলেন। পেলেন তুতি-এ-হিন্দ খেতাব, সৃষ্টি করলেন কাওয়ালি, কালবানা, তারানা, খেয়াল। গড়ে তুললেন হিন্দভি ভাষা এবং হিংসা, বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্বে জর্জরিত ভারতবর্ষকে। তাঁর শব্দ ও সুরের ছোঁয়ায় দিয়ে গেলেন প্রেমের কাছে আত্মসমর্পণের এক তূরীয় আনন্দ।
গত ২১ জুন কলকাতার জি ডি বিড়লা সভাঘরে কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি-র আয়োজনে অনুষ্ঠিত অভিনেতা মানব কলের প্রযোজনা ‘জো ডুবা সো পার’-এ সেই আমির খুসরোর জীবন এবং জীবনদর্শন নিয়ে এক শ্রুতিমধুর এবং দৃষ্টিনন্দন গীতি-আলেখ্য পরিবেশিত হল। আলেখ্য বললে ভুল হবে, বরং এর কথনশৈলী সুপ্রাচীন ‘দাস্তানগোই’-র মতো করে সাজানো হয়েছিল। হজ়রত আমির হামজা-র কাহিনি বর্ণনা করার এই হাজার বছর পুরনো শৈলী মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারতবর্ষে এসেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে হারিয়েও গিয়েছিল। আধুনিক সময়ে একে পুনরুজ্জীবিত করেন কবি শামসুর রহমান ফারুকী এবং তাঁর ভাইপো মাহমুদ ফারুকী। ‘জো ডুবা সো পার’-এর মূল দুই কথক তথা ‘দাস্তানগো’-এর পরিচালক অজিতেশ গুপ্ত এবং সঙ্গীত পরিচালক মোহিত অগরওয়াল কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলেন বিখ্যাত দাস্তানগো অঙ্কিত চড্ডার কাছে। তাঁর শৈলী দেখে এবং তাঁকে অনুসরণ করে এই পরিবেশনা সাজিয়ে তোলেন অজিতেশ এবং মোহিত। দাস্তানগোই বস্তুত এক বাচিক মাধ্যম। উর্দুতে মুখে মুখে গল্প বলা। যদিও অজিতেশ গুপ্ত তাঁর পরিচালনায় এর মধ্যে কাওয়ালি ব্যবহার করে এক নতুন স্বাদ আনার চেষ্টা করেছেন। সেই কাওয়ালিতে শ্রোতৃমণ্ডলীর সঙ্গে নিয়মিত আদানপ্রদানের মাধ্যমে অভিনয়ের ‘ফোর্থ ওয়াল’ ভেঙে দেওয়ায় এই দাস্তানগোই শৈলী সত্তার বেশ অনেকটাই বজায় রেখেছেন পরিচালক। দুই মূল দাস্তানগো-র পাশাপাশি বাকি ন’জন কাওয়ালও মাঝেমধ্যেই অভিনয় এবং কথনে অংশগ্রহণ করেন। হজরত নিজ়ামুদ্দিনের এক ‘দাস্তান’ শোনানোর সময়ে পুরুষকে নারীচরিত্রে এবং নারীকে পুরুষচরিত্রে অভিনয় করিয়ে, বা খুসরোর চরিত্রে ঘুরিয়েফিরিয়ে দু’জনে মিলে অভিনয় করে কিছুটা বিনির্মাণের প্রচেষ্টাও করেন পরিচালক।
অভিনয়ের শুরু হল তবলা এবং ঢোলক সহযোগে হারমোনিয়ামের একটি আবহ দিয়ে। ‘সচ কেহনা ম্যায়, সচ সুনলে তু’— এই গান এবং রাজস্তুতি ও রাজদণ্ডভীতিতে লেখা ধোঁয়াশাপূর্ণ ইতিহাসে সত্য-মিথ্যার জটিল সমীকরণ নিয়ে একটা আলোচনা দিয়ে দুই দাস্তানগো বলা শুরু করলেন। ক্রমে বালক ইয়ামিনুদ্দিনের মুখে মুখে শের, কাসীদা (কবিতা) বানানোর কাহিনি, রণক্ষেত্রে আব্বা সইফুদ্দিনের মৃত্যু, আম্মাকে নিয়ে ইয়ামিনুদ্দিনের দিল্লি আগমন এবং হজ়রত নিজ়ামুদ্দিন আউলিয়ার সান্নিধ্যপ্রাপ্তির কিস্সা বলা হয়। আমির খুসরোর দিল্লির সুলতানতের নেকনজর প্রাপ্তি এবং বিভিন্ন বাদশার দরবারে তাঁর অবস্থান নিয়ে খুব বেশি কিছু বলেন না পরিচালক। বরং নিজ়ামুদ্দিন আউলিয়ার সঙ্গে তাঁর আলাপ, তাঁর মুরীদ (শিষ্য) হওয়া, সুফি দর্শনে দীক্ষা, আত্মনিরীক্ষণ ও নিজের মুর্শিদের প্রেমে বিলীন হয়ে যাওয়ার আখ্যানগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এখানে ফার্সিতে খুসরোর ‘মন তু শুদম তু মন শুদী’ এই কালামটি ১৪ মাত্রায় বেঁধে এবং পরবর্তীতে তালফেরতা করে কাহারবায় গিয়ে কাওয়ালির অঙ্গে এক অভূতপূর্ব পরিবেশনা করেন সকলে। খুসরোর হিন্দি, ফার্সি, পঞ্জাবি, অওয়ধি— এ সব ভাষার সম্মিলিত ব্যবহারে তৈরি করা হিন্দভি ভাষার কথা ওঁর মতে ফার্সির চেয়ে কম সুন্দর নয়। পরিচালকের মতে, খুসরো এ সবের ঊর্ধ্বে গিয়ে আবিষ্কার করছেন সঙ্গীতের ভাষা, যা কথ্য ভাষায় অবর্ণনীয় ভাবসমূহের একমাত্র আধার। সেখানেও খুসরো ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গীতের মেলবন্ধন ঘটাচ্ছেন। নিজের মুর্শিদকে উপলক্ষ করে রচিত ‘মোরে সইয়াঁ কে রং হাজ়ার’— এই গানটির এক অসাধারণ পরিবেশনা হয় সেই হিন্দভি ভাষায় এবং ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের সুরে। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য মোহিত অগরওয়ালের সঙ্গীতায়োজন। আরও কিছু গান, যেমন ‘ছাপ তিলক’, ‘খুসরো দরিয়া প্রেম কা’ এবং ‘আজ রং দে নি’ মোহিত নতুন ভাবে সুরের মাধ্যমে সাজিয়ে তোলেন। গানের মধ্যে সরগম, কখনও বা সরগমের মাধ্যমে হারমোনাইজ়েশনের ব্যবহার, টনিক শিফট, তালবাদ্যে বোল পড়ন্তের ব্যবহারে তিনি তার সাঙ্গীতিক মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। আমির খুসরোর জীবন, দর্শন, তাঁর রচিত কালাম, শায়েরি, দোঁহা দিয়ে গড়ে তোলা এই প্রযোজনার অবয়বে আরও অন্যান্য সুফি সন্ত, কবি এবং কাওয়ালদের রচনাও কখনও বাচিক এবং কখনও সাঙ্গীতিক ভাবে ব্যবহার করেন পরিচালক। যেমন নিজ়ামুদ্দিন আউলিয়ার মৃত্যুতে মর্মাহত খুসরোর দুঃখ সুফি কবি বাবা গুলাম ফরিদের ‘কাগা সব তন খাইয়ো’— এই কালামটির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়।
আমির খুসরোর জীবন ও সঙ্গীত যথার্থ ভাবে তুলে ধরে এই প্রযোজনা, যা অবশ্যই বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)