গত ২১ মে জ্ঞানমঞ্চে আয়োজিত হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্বাচিত ছোটগল্পের বীক্ষণ ‘ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা’। মুখবন্ধে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যর সঙ্গে শ্রোতাদের পরিচয় করালেন প্রমিতা মল্লিক। যেমন রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্পের ভিতর নিজে কখনও প্রবেশ করেননি। দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো ছোটগল্পেও প্রকৃতি বিরাট জায়গা করে নিয়েছে। তৃতীয়ত, ভাষার স্বচ্ছন্দ বহমানতা। প্রথম গল্পে সূত্র-কথকরা ছিলেন সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুতীর্থ বেদজ্ঞ, রুবাই মাইতি। পরিচয় করালেন ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পের সঙ্গে। গল্প পাঠে সোহাগ সেন আজও স্বমহিমায়। এই গল্পের কিছু অংশ পাঠ করে আজও শ্রোতাদের মনে গভীর ছাপ ফেলেন। পাঠ করেন সেই বিখ্যাত লাইন ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই’। শবনম মৈখালী গেয়ে ওঠেন, ‘আমার যাবার বেলাতে সবাই জয়ধ্বনি কর’।
যে গল্পে নারী-পুরুষের মনের বিচিত্র অভিঘাত প্রকাশের মুনশিয়ানা আমাদের পাঠক-হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়, সেই ‘নষ্টনীড়’ গল্পের অংশ পাঠ করে শোনান সুজয়প্রসাদ, শর্মিষ্ঠা গোস্বামী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এই সব দক্ষ শিল্পী যখন যথেষ্ট অনুশীলনের মধ্য দিয়ে যান, তখনই পাঠ ছবির মতো চোখের সামনে ফুটে ওঠে। শবনম গেয়ে ওঠেন, ‘মনে রয়ে গেল মনের কথা’৷ কী চমৎকার ব্যবহার এই গানের! শবনমের সুরেলা কণ্ঠ ও গানে আত্মনিমগ্নতা মন ভরিয়ে দেয়। চলে আসে ‘বদনাম’ গল্প... যখন সুজয় পাঠ করেন, ‘আমরা দেশের মেয়েরা যদি এই সব সুসন্তানদের আপন প্রাণ দিয়ে রক্ষা না করি, তবে আমাদের নারীধর্মকে ধিক!’ এ যেন পাঠ নয়, সমাজকে বার্তা! ঠাকুর পরিবারে যে সব নারী ছিলেন, তাঁদের কবি দেখেছেন খুব কাছ থেকে। তাঁদের চিন্তার প্রসারতাকে তিনি বুঝতে পেরেছেন। তাঁদের স্বদেশি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া, সাহিত্যচর্চা, আধুনিকমনস্কতা... সবটাই। দেখেছেন সরলা দেবী, সরোজিনী নাইডুর মতো মানুষদের। ফলে সংবেদনশীল রবীন্দ্রনাথের পক্ষে নারীসত্তা, নারীর সংগ্রামের সঙ্কটকে চিহ্নিত করা তেমন কিছু কঠিন হয়নি। ‘স্ত্রীর পত্র’ একশো বছরেরও বেশি সময় আগের গল্প হলেও, আজকের দিনে তা সমান প্রণিধানযোগ্য। চৈতী ঘোষালের ‘স্ত্রীর পত্র’ পাঠে দু’চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। মাথা নত হয় শিল্পীর কাছে। একে একে আসে গল্প ‘মধ্যবর্তিনী’। হরসুন্দরী ও নিবারণের জীবনে আসে শৈলবালা। চলেও যায় অল্প দিনে। থেকে যায় দু’জনের মাঝে, যাকে লঙ্ঘন করা যায় না। শবনমের গাওয়া গান ‘কেহ কারো মন বুঝে না’ বড়ই যথাযথ।
রবিবার গল্পপাঠের দায়িত্বে ছিলেন বিজয়লক্ষ্মী বর্মণ। কণ্ঠের জাদুতে শ্রোতাদের মন জয় করে নেন। অভীকের চিঠি পড়ে বিভা কোনও জবাব দিয়েছিল কি না, আমরা জানি না। কল্পনা করতে পারি, বিভার মনের আগল খুলেছিল। শবনমের গলায় তাই শুনি, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। অনুষ্ঠানের সবশেষ গল্প ‘মুসলমানীর গল্প’। গল্পের শুরুতে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘তখন অরাজকতার চরগুলো কণ্টকিত করে রেখেছিল রাষ্ট্রশাসন, অপ্রত্যাশিত অত্যাচারের অভিঘাতে দোলায়িত হত দিনরাত্রি। দুঃস্বপ্নের জাল জড়িয়ে ছিল জীবনযাত্রার সমস্ত ক্রিয়াকর্মে।’ আজ এত বছর পরেও রাষ্ট্রের অবস্থা ‘মুসলমানী’ গল্পের এই সূচনা অংশের মতো। অবিকলই শুধু নয়... বরং রাষ্ট্রশাসন, দেবতা অপদেবতা ও মানুষের অমানবিক আচরণ যেন আরও ফুলেফেঁপে উঠেছে। গল্পের বৃদ্ধ হাবিব খাঁর সেই কথা, ‘যারা যথার্থ মুসলমান, তারা ধর্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণকে সম্মান করে’— পড়া ও সমাজের কাছে পৌঁছে দেওয়া বড় প্রয়োজন। সেদিনের অনুষ্ঠানে শিল্পীরা সে কাজ করতে পেরেছেন সামাজিক দায়িত্ব এই অনুষ্ঠান পূরণ করেছে। অনুষ্ঠান শেষে পরিবেশিত হয় ‘অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত’। শ্রোতারাও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গলা মেলান। তথাগত মিশ্র ও সুরজিৎ দাসের যন্ত্র সহযোগিতা অনুষ্ঠানকে বিশেষ মাত্রা দেয়। অনুষ্ঠান বাধ্য করে রবীন্দ্রনাথের গল্পে ডুবে যেতে। এখানেই তার সাফল্য ও স্বাতন্ত্র্য।
অনুষ্ঠান
২১ জুন, বিশ্ব সঙ্গীত দিবসে জ্ঞান মঞ্চে সঙ্গীতাচার্য নীহারবিন্দু চৌধুরী ও সঙ্গীতসাধক তবলা বাদক অনিল পালিতের স্মৃতিতে এক মনোজ্ঞ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ‘বন্দীশ’ (কসবা)। শুরুতেই নবনীতা ভট্টাচার্য স্তোত্র ও ভজন পরিবেশন করেন। কত্থকে ছিলেন শ্রেয়া দাস। শিল্পীকে যোগ্য সঙ্গত করেন অমিতানন্দ রায় (তবলা), অভীক মল্লিক (সেতার), সিদ্ধেশ্বর ভৌমিক (গান)। নীহারবিন্দুর কন্যা মন্দিরা চৌধুরী পিতার স্মৃতিচারণ করেন। পরবর্তী শিল্পী পার্থপ্রতিম রায় সেতারে রাগ মিয়াঁমল্লারের মূর্ছনায় শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। পরিবেশন করেন আলাপ, জোড়, ঝালা, ঝাঁপতাল ও ত্রিতাল নিবদ্ধ গৎ। দর্শকের অনুরোধে শিল্পী একটি দাদরা ও ভজনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শেষ করেন। শিল্পীকে তবলায় সহযোগিতা করেন উজ্জ্বল ভারতী। শেষ নিবেদন ছিল পিতা-পুত্রী শিবনাথ ভট্টাচার্য ও দীপমালার তবলা যুগলবন্দি। হারমোনিয়ামে সিদ্ধেশ্বর ভৌমিক। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন মৌমিতা পাল। সব শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ‘বন্দীশ’-এর অন্যতম সদস্যা সুলগ্না রায়।
মঞ্চে পরিবেশনায় শিল্পীরা।
এস এন বি ফাউন্ডেশনের মূল অনুপ্রেরণা সৌম্যেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের উদ্দেশ্যে উত্তম মঞ্চে আয়োজিত ১১তম ঋতচ্ছন্দ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সম্প্রতি। প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে সূচনা করলেন চিন্ময় মিশন কলকাতা শাখার কর্ণধার স্বামী দিবাকর চৈতন্য মহারাজ ও সাংসদ দেবাশিস কুমার। মহারাজ শান্তিমন্ত্র পাঠ করেন। বাঁশিতে শারণ্য সরকার বাজালেন রাগ কলাবতী, কণ্ঠসঙ্গীতে শিবাশিস লাহিড়ী পরিবেশন করেন রাগ শ্যামকল্যাণ। বেহালাতে সৌপর্ণ ঘোষ বাজান রাগ কৌশিকধ্বনি এবং সেতারে সৌভাগ্য কর্মকার বাজান বসন্তের রাগ বাহার। সঙ্গত করেন অর্চিষ্মান সিংহ রায়। চেন্নাই থেকে আগত বেহালা ও কণ্ঠসঙ্গীতের যুগলশিল্পী শ্রীরাম পরশুরাম ও তাঁর স্ত্রী অনুরাধা শ্রীরাম রাগসঙ্গীতে আধারিত ভজন পরিবেশন করেন। শুরু করেন দুর্গা স্তব দিয়ে, তার পর মীরাবাঈয়ের কিছু ভজন, সন্ত তুকারামের মরাঠি ভজন পরিবেশন করেন। এর পর রমা বৈদ্যনাথন পরিবেশন করেন মানুষের জীবনচক্রের দশ অধ্যায়। ঋতছন্দের অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনে উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন ত্রিপর্ণা দে সরকার। পরবর্তী নবীন দুই প্রতিভা যূথিকা পাল ও প্রত্যাশা বিশ্বাস যৌথ কথক নৃত্য পরিবেশন করেন। এই দিনের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের একক তবলা বাদনে। সঙ্গতে শুভাশিস ভট্টাচার্যের তবলা এবং হারমোনিয়ামে ছিলেন হিরন্ময় মিত্র। শেষ নিবেদন ছিল পার্থসারথি চৌধুরীর সরোদ বাদন, সঙ্গে তন্ময় বসুর তবলা সঙ্গত।
রঙ্গকর্মী ৪৯তম বর্ষে পদার্পণ করল। উষা গঙ্গোপাধ্যায়কে স্মরণ করে গত ৪ থেকে ৮ জুন রঙ্গকর্মীর নিজস্ব প্রেক্ষাগৃহ উষা গাঙ্গুলি মঞ্চে উদ্যাপিত হল রঙ্গকর্মীর নাট্য উৎসব ‘উষা কি কিরণ’-এর তৃতীয় সংস্করণ। উৎসবের উদ্বোধন করেন নাট্যব্যক্তিত্ব অসিত বসু, সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত, ড. গগনদীপ, শ্রীপর্ণা ভঞ্জ গুপ্ত এবং রাষ্ট্রীয় নাট্য বিদ্যালয়ের বর্তমান পরিচালক চিত্তরঞ্জন ত্রিপাঠী। পাঁচ দিনব্যাপী নাট্যোৎসবে বিভিন্ন স্বাদের ও বাংলা এবং হিন্দি ভাষার নাটক মঞ্চস্থ হয়। ৪ জুন মঞ্চস্থ হয় নাটক ‘মইয়্যত’। ৫ জুন পরিবেশিত হয় সংযোগসূত্র নাট্যদলের বাংলা নাটক ‘জ্যাজা মশায়’, নির্দেশনা সৌমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ৬ জুন কিসসা কালেক্টিভের (বেঙ্গালুরু) হিন্দি নাটক ‘সিলওয়াটে’, নির্দেশনা শতরূপা ভট্টাচার্য। তার পরের দিন মঞ্চস্থ হয় নাটমণ্ডপের (পটনা) হিন্দি নাটক ‘অকেলি অওরত’, নির্দেশনা পারভেজ আখতার। শেষ দিন মঞ্চস্থ হয় রঙ্গকর্মী নিবেদিত, সাজিদা সাজি নির্দেশিত হিন্দি নাটক ‘পশমিনা’।
ইন্দিরা সঙ্গীত শিক্ষায়তনের আয়োজনে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল দশম সুভাষ চৌধুরী স্মৃতি বক্তৃতা। গত ২৮ জুন যাদবপুরের ইন্দুমতী সভাগৃহে আয়োজিত এই স্মৃতি বক্তৃতায় আমন্ত্রিত ছিলেন অধ্যাপক সর্বানন্দ চৌধুরী। তাঁর বলার বিষয় ছিল, ‘রবীন্দ্রগানে আবহমান’। অনুষ্ঠানের সূচনায় ইন্দিরার ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা পরিবেশন করল দু’টি রবীন্দ্রসঙ্গীত, ‘তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে’ আর ‘আকাশ জুড়ে শুনিনু’। এর পরে অনুষ্ঠানের মূল পর্ব শুরু হয় সর্বানন্দ চৌধুরীর বক্তব্যের মাধ্যমে। চর্যাপদ, বৈষ্ণব-শাক্ত-বাউল পদাবলি, জয়দেব আর চণ্ডীদাসের পদ... এই সব হাজার বছরের গান যে একটি সুতোয় গাঁথা, সেই সুতোরই আর একটি ফুল হিসেবে সর্বানন্দ দেখাতে চাইলেন রবীন্দ্রনাথের গানকে। ব্যক্তিগত শোক, আনন্দ, সব ছেড়ে এক পূর্ণতার উপলব্ধি এনে দেয় সেই আবহমান। এই কথাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন তাঁর গানে গানে— ‘কবে আমি বাহির হলেম তোমারই গান গেয়ে’ অথবা ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে’— এই কথাগুলির ভাবরূপ। রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের আবহমানের পথ দেখায়, তা-ই উঠে এল বক্তৃতায়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)