গত ৩১ মে জ্ঞান মঞ্চে মঞ্জিষ্ঠা কলাকেন্দ্র ‘মঞ্জিষ্ঠা উৎসব’ উপস্থাপিত করেছিল। রাজা দত্ত এই প্রতিষ্ঠানটিকে নিষ্ঠার সঙ্গে গড়ে তুলেছেন, ছাত্রছাত্রীদের নৃত্য নিবেদন দেখলেই তা বোঝা যায়। বাংলার তেমন কোনও শাস্ত্রীয় নৃত্য নেই বলে যে নৃত্যশিল্পীরা আক্ষেপ করতেন, তাঁরা এখন দেখতে পাবেন— ভারতের যে কোনও প্রদেশের শাস্ত্রীয় নৃত্যানুষ্ঠান। খোদ কলকাতায় বসেই শাস্ত্রীয় নৃত্যের তালিম নিয়ে সারা ভারত তথা পৃথিবীর যে কোনও দেশে বাংলার শিল্পীরা শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রদর্শন করে কৃতিত্ব অর্জন করছেন তো বটেই, অন্য প্রদেশ থেকে শাস্ত্রীয় নৃত্যের শিক্ষা গ্রহণ করার পরে নিজ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। পরবর্তী প্রজন্মকে শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতেও সাহায্য করছেন। মঞ্জিষ্ঠা-র প্রাণপুরুষ রাজা দত্ত নৃত্যগুরু সি ভি চন্দ্রশেখরের কাছে ভরতনাট্যম শিখে ‘মঞ্জিষ্ঠা কলাকেন্দ্র’ স্থাপন করে নতুন প্রজন্মকে দক্ষিণ ভারতীয় নৃত্যের শিল্পী হিসেবে দর্শকের সামনে উপস্থাপিত করে চলেছেন।
‘মঞ্জিষ্ঠা উৎসব’ তিনটি পর্বে মঞ্চস্থ করা হয়েছিল। প্রথম পর্ব— নিবেদনম। নৃত্যগুরু সি ভি চন্দ্রশেখর ও অন্যান্য গুরুদের উদ্দেশে এই পর্বটি নিবেদিত। প্রথমে পুষ্পাঞ্জলি ও আলারিপু। এর পর কলাবতী রাগ ও আদি তালে নিবদ্ধ তুলসীদাসের ভজনের সঙ্গে (গায়ে গণপতি) নৃত্য ও দুর্গা রাগ এবং আদি তালে একটি কীর্তনের সঙ্গে নৃত্য প্রদর্শন করেন মঞ্জিষ্ঠার নৃত্যশিল্পীরা। দৃষ্টিনন্দন প্রদর্শনী। আর একটি কীর্তনের সঙ্গে (শঙ্কর রুদ্ররূপে) নৃত্য নিবেদন করেন সম্রাট দত্ত। রাগ শঙ্করায় আধারিত ও আদি তালে নিবদ্ধ ওই কীর্তনের সঙ্গে সম্রাট দত্তের নাচ দর্শকদের মনোরঞ্জন করে। পরবর্তী আকর্ষণ ছিল তিল্লানা— হাম্বীর রাগ ও আদি তালে নিবদ্ধ গানের সঙ্গে নৃত্যাঙ্গনা মন্দাক্রান্তা রায়ের নৃত্য নিবেদন ছিল মনোমুগ্ধকর। এই পর্বের শেষ নিবেদন রাগ মালিকা ও আদি তালে নিবদ্ধ দশাবতার। সুন্দর নৃত্য পরিবেশন করেন চৈতী ঘোষ ও রাজা দত্ত। এই পর্বের গানগুলি গেয়েছেন সি ভি চন্দ্রশেখর— নৃত্যনির্মাণও তাঁরই।
নৃত্যগুরুদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব— অর্পণম। এই পর্বে মঞ্জিষ্ঠা-র নৃত্যশিল্পীরা দেবদেবীদের বন্দনা করেন— দেবা ও দেব। প্রথমে গতিভেদ। নৃত্যের মাধ্যমে পশুদের বিচরণের ভাব চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁরা নৃত্যের ভঙ্গিমায়। পর পর কীর্তনমের সুরে তাঁরা প্রণত হলেন দুর্গা (দমদম দুর্গা), গণপতি (গণপতি—গণপতি), কৃষ্ণ (স্বাগতম কৃষ্ণ) ও সরস্বতী দেবীর কাছে। শেষে দুটি ভজন গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন মঞ্জিরার শিল্পীরা। প্রতিটি নাচেই যত্নের ছাপ রয়েছে। অনুষ্ঠানের তৃতীয় পর্বে ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত সহযোগে নৃত্যের পরিকল্পনা—‘মননে রবি’। এই পর্বে রাজা দত্তের নৃত্য পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় রবীন্দ্রনাথের আটটি গানের সঙ্গে মঞ্জিষ্ঠা-র শিল্পীদের নৃত্য পরিবেশনা।
গান গেয়েছেন যথাক্রমে সৌম্যজিৎ ও সৌরেন্দ্র (‘সকাতরে’), শ্রাবণী সেন (‘কোথাও আমার’), জয়তী চক্রবর্তী (‘ওই যে ঝড়ের’), সুপ্রতীক দাস (বিশ্ববীণা), মনোজ মুরলী ও মনোময় ভট্টাচার্য (চল নিয়ম মতে), জয়তী চক্রবর্তী (হৃদয়ে মন্দ্রিল), লোপামুদ্রা মিত্র (ধানের খেতে) এবং শৌনক চট্টোপাধ্যায় (আলোয় আলোকময়)।
তবে গানের নির্বাচন এলোমেলো। নৃত্যের পরিকল্পনা ভালই, তবে একটি মাত্র শাস্ত্রীয় নৃত্যভিত্তিক নৃত্যনির্মাণ না করে (যা আজকাল সৃজনশীল নৃত্য বা ক্রিয়েটিভ ডান্স নামে মঞ্চায়িত হয়) শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারার অনুসারী হলে আরও উপভোগ্য হত। রাবীন্দ্রিক নৃত্যধারায় কথাকলি, মণিপুরি ও বিভিন্ন প্রদেশের লোকনৃত্য ছাড়াও শ্রীলঙ্কা এবং জাভার নৃত্যধারাকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। কিন্তু সেখানে কোনও একটি শাস্ত্রীয় নৃত্যের আঙ্গিকে নৃত্য পরিবেশনা করলে, ভবিষ্যতে শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারা একদিন হারিয়ে যাবে।
অনুষ্ঠান

অনুষ্ঠানের মুহূর্ত।
- বিশ্ব নৃত্য দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত হলেন নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী মমতাশঙ্কর। শিল্পীর হাতে সম্মান তুলে দিলেন প্রবীণ নৃত্যশিল্পী পূর্ণিমা ঘোষ। ওয়েস্ট বেঙ্গল ডান্স গ্রুপ ফেডারেশন আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে মহাজাতি সদনে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পীরা। বিশ্ব নৃত্য দিবস উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ নৃত্য কর্মশালার কেন্দ্রে ছিল অসমের জনপ্রিয় বিহু নৃত্য। বিহু নৃত্যশিল্পী বিধান দেউড়ি হুকাইয়ের তত্ত্বাবধানে এই কর্মশালা আয়োজিত হয়েছিল, যেখানে ৯৫ জন নৃত্যশিল্পী অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে অংশগ্রহণকারী নৃত্যশিল্পীরা এবং পরে বিধান দেউড়ি হুকাই নৃত্য পরিবেশন করেন। পদ্মশ্রী পাওয়ার জন্য মমতাশঙ্করকে সংবর্ধনা জানানো হয়। পরবর্তী পর্যায়ে ওয়েস্ট বেঙ্গল ডান্স গ্রুপ ফেডারেশনের ১১টি দল নৃত্য পরিবেশন করে। কারও বিষয় ছিল সবুজ রক্ষার সন্দেশ, কোথাও বা জগন্নাথ দেবের নানা রূপের বর্ণনা, কোথাও হয়েছে গাজনের গান, কোথাও বনবিবির আখ্যান। উপস্থিত ছিলেন চন্দ্রোদয় ঘোষ, পার্বতী গুপ্ত, প্রদীপ্ত নিয়োগী, সোমনাথ কুট্টি প্রমুখ।
- গত ২৫ এপ্রিল জিডি বিড়লা সভাঘরে হয়ে গেল বিট ব্লাস্টার্সের দশ বছরের উদ্যাপন ‘মেলোডি থ্রু বিটস’। ২০১৫ থেকে ২০২৫-এর মধ্যে একাধিক অ্যালবাম প্রকাশ করেছে এই ব্যান্ড, অসংখ্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক টুর করেছে। এই বছরের উদ্যাপন কনসার্টটিও সমান ভাবে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকল। অনুষ্ঠানে বলিউড, হলিউড, বাংলা, লোকজ এবং আরও অনেক ধারার শিল্পীরা গান গাইলেন ব্যান্ডের সঙ্গে। গানে ছিলেন সৌরেন্দ্র-সৌম্যজিৎ (‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’), তিমির বিশ্বাস (‘দুই পৃথিবী’), মেখলা (‘বরসো রে মেঘা’), কার্তিক দাস বাউল (‘কলঙ্কিনী রাধা’)-সহ আরও অনেকে। নৃত্য পরিবেশনায় ছিলেন অদ্বিতীয়া ডান্স অ্যাকাডেমির শিল্পীরা, পরিচালনায় অর্পিতা দাস। অনুষ্ঠানের পরিকল্পনায় ব্যান্ডের প্রাণপুরুষ হিমাদ্রি শেখর দাস।
- সম্প্রতি রামগড় কমিউনিটি হলে স্যর নৃপেন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশনের ছাত্ররা মঞ্চস্থ করল ‘পথেই হবে এ পথ চেনা’ নাটক। সলিল চৌধুরীর শতবর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে টালিগঞ্জ স্বপ্নমৈত্রীর উদ্যোগে এই নাটকটি প্রস্তুত করেছে ষষ্ঠ থেকে একাদশ শ্রেণির ছাত্ররা। মূল নাটকটি মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের ‘বর্ণ বিপর্যয়’ নাটকের ছায়ায় তৈরি হয়েছে। নাটকের সম্পাদনা, সংলাপ পরিমার্জনা ও আবহ করেছেন নির্দেশক ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়। আলোর দায়িত্বে ছিলেন সত্রাজিৎ গুপ্ত। মঞ্চ ভাবনা ও রূপায়ণে ছিলেন রবীন্দ্রভারতীর প্রথম বর্ষের ছাত্রী রিয়া খাতুন। সলিল চৌধুরীর গানগুলি গেয়েছেন তনুময় চক্রবর্তী। অভিনয়ে ছিলেন ইন্দ্রাশিস ঘোষ, শুভঙ্কর দাশগুপ্ত, সূর্যাংশু চন্দ্র, স্বর্ণব সেনগুপ্ত, তুষার কর্মকার প্রমুখ ছাত্র।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)