E-Paper

ভাবনা জ্বলতে থাকে মশালের মতো

অনেকটাই সরে এসেছে। এই নাটকটিকে পুনর্গঠন করেছেন পরিচালক কৌশিক সেন। এসেছে কলকাতার শপিং মলের প্রেক্ষাপট। এসেছে নির্মাণকর্মীদের উপস্থিতি।

সৌভিক গুহসরকার

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২৫ ০৭:৪৩
নাটকের দৃশ্যে জয়ন্ত ও সৃজিত।

নাটকের দৃশ্যে জয়ন্ত ও সৃজিত।

গত ৬ জুলাই বিড়লা সভাঘরে মঞ্চস্থ হল স্বপ্নসন্ধানীর নাটক— ‘মার্ক্স ইন কলকাতা’। এটি স্বপ্নসন্ধানীর ইংরেজি ভাষায় করা প্রথম নাটক। আমেরিকার ইতিহাসবিদ ও সমাজবিদ্যার অধ্যাপক হাওয়ার্ড জিনের লেখা ‘মার্ক্স ইন সোহো’ নাটকটি অবলম্বনে ‘মার্ক্স ইন কলকাতা’। মূল নাটকটির রচনার সাল ১৯৯৯। কিন্তু, হাওয়ার্ড জিন কেন রচনা করেছিলেন এই নাটক? নাটকের মুখবন্ধে তিনি বলছেন— ‘আমি মার্ক্সকে দেখাতে চেয়েছিলাম... পরিবারের মানুষ হিসেবে, যিনি নিজের স্ত্রী এবং সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য খুব পরিশ্রম করছেন’। এই নাটকটি তিনি লিখেছিলেন যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সারা পৃথিবীতে মার্ক্সিস্ট চিন্তাধারাকে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছিল— ‘মার্ক্সিজ়ম হ্যাড ফেলড। মার্ক্স ওয়াজ় ট্রুলি ডেড’। মার্ক্সীয় ভাবনার অপপ্রয়োগের মধ্যে যে মার্ক্স নেই— এই মূল কথাটি বলতে চেয়েছিলেন হাওয়ার্ড জিন।

আজও মার্ক্সের মূল ভাবনার সত্যতা যে হারিয়ে যায়নি, তা যে আজকের উদ্ধত ‘ক্যাপিটালিজ়মের’ দিনে দাঁড়িয়েও সমান প্রাসঙ্গিক, এই কথাটা বলাই নাটকটির লক্ষ্য। তবে গোড়াতেই বলা প্রয়োজন যে, স্বপ্নসন্ধানীর ‘মার্ক্স ইন কলকাতা’ কিন্তু মূল নাটক থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। এই নাটকটিকে পুনর্গঠন করেছেন পরিচালক কৌশিক সেন। এসেছে কলকাতার শপিং মলের প্রেক্ষাপট। এসেছে নির্মাণকর্মীদের উপস্থিতি। এ ছাড়াও উঠে এসেছে অন্ধকারের রাজা মেফিস্টোফিলিস, যে ‘ক্যাপিটালিজ়ম’ ও অখণ্ড ভোগবাদের প্রতীক। এর ফলে এই নাটকটিতে একটা স্পষ্ট দ্বন্দ্বের জায়গা তৈরি হয়েছে। মার্ক্স বনাম মেফিস্টোফিলিস। এই দ্বন্দ্বই নাটকটিকে বলিষ্ঠ নাটকীয়তা প্রদান করেছে। কৌশিক সেন যে ভাবে ভেবেছেন, সেটি নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য।

‘মার্ক্স ইন কলকাতা’ নাটকটির কেন্দ্রে বিরাজ করছে জয়ন্ত কৃপলানীর উজ্জ্বল অভিনয়। মার্ক্সের চরিত্রে তাঁকে নির্বাচন করা নাট্য-নির্দেশকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। জয়ন্ত কৃপলানীর একটি স্বকীয় অভিনয় ভঙ্গিমা রয়েছে, উচ্চারণরীতি রয়েছে— যা এই চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। তিনি এই নাটকে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। পাশাপাশি মেফিস্টোফিলিসের ভূমিকায় সৃজিত মুখোপাধ্যায় বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। মেফিস্টোফিলিস এমনিতেই একটি ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্র। সৃজিত তাঁর ব্যক্তিত্বের বিভায় এই চরিত্রটির অন্তরে নিহিত কুটিল তমিস্রা ফুটিয়ে তুলেছেন। বিশেষত মার্ক্সের সঙ্গে মেফিস্টোফিলিসের দ্বৈরথ তীব্র নাটকীয় মুহূর্ত সৃষ্টি করেছে। মার্ক্সের স্ত্রী জেনির ভূমিকায় দিতিপ্রিয়া সরকারের অভিনয় আন্তরিক ও হৃদয়স্পর্শী। জেনির আনন্দ, হতাশা ও যন্ত্রণাকে অভিনয়ের তুলিতে গাঢ় রঙে এঁকেছেন দিতিপ্রিয়া। পাশাপাশি এলেনর মার্ক্সের চরিত্রে শৈলী ভট্টাচার্য প্রাণবন্ত। এ ছাড়া ম্যানেজারের ভূমিকায় মৃন্ময় চক্রবর্তী ও বিনোদ বালার চরিত্রে সময় মোহান্তি ভাল কাজ করেছেন। মেফিস্টোফিলিসের সহচর প্রাণীর চরিত্রে ইলোরা ভট্টাচার্য নজর কেড়েছেন।

‘মার্ক্স ইন কলকাতা’ নাটকে কনস্ট্রাকশন শ্রমিকদের ফর্মেশন মুগ্ধ করে। একেবারে অভিনব। শেষে সেফটি হেলমেটের আলোর ব্যবহার নাটকটিকে অদ্ভুত গতি প্রদান করেছে। এবং অবশ্যই মেফিস্টোফিলিসকে পরিত্যাগ করে উড়ন্ত লাল নিশানের দিকে বিনোদ বালার টলমলিয়ে এগিয়ে চলার সময়ে সলিল চৌধুরীর ‘আহ্বান, শোনো আহ্বান’ গানটি অব্যর্থ। শিরায় রক্তস্রোতের জোয়ার লাগে। এ প্রসঙ্গে বলতেই হয় যে সঞ্চয়ন ঘোষের মঞ্চসজ্জা, শুভদীপ গুহর ধ্বনি পরিকল্পনা, সুদীপ সান্যালের আলোকসম্পাত সমগ্র নাটকটির ভিতরে যে অস্থিরতা, যে ভাঙচুর রয়েছে, সেই সব কিছুকে তীব্র করে তুলেছে। মহম্মদ আলীর রূপসজ্জা নাটকটিকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে। মেফিস্টোফিলিসের শৃঙ্গযুক্ত মুকুটের ব্যবহার ভাল লেগেছে। রেশমী সেনের পোশাক পরিকল্পনা যথাযথ। মেফিস্টোফিলিস ও তার সহচর প্রাণীর পোশাক নাটকে অন্য রকম স্বাদ এনেছে। তবে ‘মার্ক্স ইন কলকাতা’র প্রথম পর্বের কিছুটা অংশ একটু দীর্ঘ লাগে... যেখানে মার্ক্স নিজের চিন্তার কথা অনর্গল বলে চলেছেন। দ্বিতীয় পর্ব মেদহীন ও নাটকীয় উত্থানপতনে উদ্বেলিত।

পরিশেষে বলা প্রয়োজন যে, স্বপ্নসন্ধানী নাট্যদলের প্রথম ইংরেজি প্রযোজনা ‘মার্ক্স ইন কলকাতা’ একটি উৎকৃষ্ট কাজ। কিছু নাটক আছে, যা ভাবায়। পুনর্বিশ্লেষণের দিকে ঠেলে দেয় মনকে। এ নাটক তেমনই। যে তত্ত্বকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়ে গিয়েছে, তা কি সত্যিই মৃত? সত্যিই অপ্রয়োজনীয়? এ নাটক রাজনৈতিক চিন্তা উস্কে দেয়। কার্ল মার্ক্স— এই বিশাল নামের নেপথ্যে যে রক্তমাংসের মানুষটা একদিন বেঁচে ছিলেন, এ নাটক তাঁর কথাও বলে। নির্দেশক কৌশিক সেন নিজের সৃজনশীলতার স্পর্শে এই নাটকের নানা দৃশ্যে স্বকীয়তা এনেছেন, যা এই নাটকের সম্পদ। নাটকটি শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও, ভাবনা জ্বলতে থাকে মশালের মতো।


(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Review

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy